আমার বাবা: বহুমাত্রিক লেখক ও অধ্যাপক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর মেয়ে মৌলি আজাদ ভালো থেকো মেঘ
বেশ কদিন ধরেই বিভিন্ন পত্রিকার পাতা
উল্টালেই দেখছি বিজ্ঞাপন। বাবা দিবস উপলক্ষে দেশের নামকরা
বিপণিপ্রতিষ্ঠানগুলো বাবাদের জন্য নানা রকম পোশাক, কার্ড বা মগ তৈরি করে
রেখেছে বলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।
জানি, শহুরে জীবনে অভ্যস্ত
সন্তানেরা ভিড়ও জমাচ্ছে সেসব দোকানে। উদ্দেশ্য একটাই, ব্যতিক্রমধর্মী কোনো
উপহার কিনে বিশেষ দিনে বাবাকে চমকে দেওয়া। কিন্তু আমার বাবা প্রায় নয় বছর
ধরে এ পৃথিবীতে নেই বলে সেসব চকচকে বিজ্ঞাপনের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র
আগ্রহ নেই। আমি যাব না (যাইও না বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল) সেসব দোকানে। কারণ,
বাবাদের জন্য তৈরি করা নানা জিনিস দেখলে আমার আজ আনন্দের বদলে বুকটা কেবল
ধক করে ওঠে। বাবা দিবসের জন্য প্রস্তুত করা শাল, পাঞ্জাবি, কার্ড, মগের
দিকে হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হই যেন। কারণ, এসব উপহার কিনে বাড়ি
ফিরে যাঁর হাতে দিলে একরাশ গালভরা হাসি হাসতেন, তিনি আমার বাবা হুমায়ুন
আজাদ।
২০০৪ সালে তাঁর লিখিত অনবদ্য গ্রন্থ পাক সার জমিন সাদ বাদ-এ মৌলবাদের মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে তিনি হন রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। এবং পরিশেষে দেশের মাটি ছেড়ে ভিন দেশে গিয়ে হয়ে যান মহাকালের অংশ। তাই বাবা দিবসে কেনা হয় না আমার কোনো উপঢৌকন, শুধু চোখের সামনে ভেসে আসে তাঁর মায়াভরা সাদা চুলে আবৃত মুখমণ্ডল, জিনসের প্যান্ট-শার্ট, চশমা, অ্যাশ-ট্রে ভর্তি তাঁর ধূমপান করা সিগারেটের খোসা। বাসায় তাঁর জন্য তৈরি করা পাঠাগারে ঢুকে তাঁর লিখিত ঢাউস ঢাউস সাইজের বইয়ের দিকে তাকালে আমার পড়ে অবিরাম দীর্ঘশ্বাস। মাঝেমধ্যে ভাবি, বাবা বেঁচে থাকাকালীন যখন ভাবতাম বাবার না-থাকার কথা, তখন কেমন যেন বুকটা হিম হয়ে আসত অথচ আজ নয়টি বছর তাঁকে ছাড়াই কাটিয়ে দিচ্ছি। ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না তাঁর শূন্যতা। হয়তো মানুষকে সব শোক সামলে এগিয়ে চলার শক্তি প্রকৃতিপ্রদত্তই। চোখের সামনে কারণে-অকারণে ভাসে রাঢ়িখালে করা তাঁর শেষ সমাধিখানি। জানি না, কেমন আছেন তিনি পরপারে। চিরাচরিত নিয়মে অন্য ভুবনে তিনি আজ কেমন আছেন, সে বিষয় কল্পনা করি না কখনো। শুধু যখন দেখি চারপাশে হিংস্র দানবেরা, যারা দেশের মাটিকে খুবলে খেতে চায়, তখন ভীষণভাবে তাঁকে মনে পড়ে। চোখের সামনে ভাসে তাঁর লেখা আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম বইয়ের উৎসর্গপত্রটি: ‘তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাংলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না। জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমণ্ডলী, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ। মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতো যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন করে আমাকে পীড়ন করো না। আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না।’ বাবা বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন প্রগাঢ়ভাবে। তাই তাকে যখন ছিন্নভিন্ন হতে দেখতেন, তা সহ্য করতে না পেরে কলম ও ভাষার জোরে তা প্রকাশ করতেন। চাই না বাবার লেখা উৎসর্গপত্রের মতো হোক তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের পরিণতি। বাবা দিবসে বাবার লেখা ‘ভালো থেকো’ নামের সেই অনবদ্য কবিতাই যেন তাঁর সব পাঠকের মুখ থেকে উচ্চারিত হতে দেখি:
‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালী গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।’
পৃথিবীর সব বাবাকে আমি বলতে চাই, ‘ভালো থেকো, বাবা, ভালো থেকো।’
২০০৪ সালে তাঁর লিখিত অনবদ্য গ্রন্থ পাক সার জমিন সাদ বাদ-এ মৌলবাদের মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে তিনি হন রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। এবং পরিশেষে দেশের মাটি ছেড়ে ভিন দেশে গিয়ে হয়ে যান মহাকালের অংশ। তাই বাবা দিবসে কেনা হয় না আমার কোনো উপঢৌকন, শুধু চোখের সামনে ভেসে আসে তাঁর মায়াভরা সাদা চুলে আবৃত মুখমণ্ডল, জিনসের প্যান্ট-শার্ট, চশমা, অ্যাশ-ট্রে ভর্তি তাঁর ধূমপান করা সিগারেটের খোসা। বাসায় তাঁর জন্য তৈরি করা পাঠাগারে ঢুকে তাঁর লিখিত ঢাউস ঢাউস সাইজের বইয়ের দিকে তাকালে আমার পড়ে অবিরাম দীর্ঘশ্বাস। মাঝেমধ্যে ভাবি, বাবা বেঁচে থাকাকালীন যখন ভাবতাম বাবার না-থাকার কথা, তখন কেমন যেন বুকটা হিম হয়ে আসত অথচ আজ নয়টি বছর তাঁকে ছাড়াই কাটিয়ে দিচ্ছি। ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না তাঁর শূন্যতা। হয়তো মানুষকে সব শোক সামলে এগিয়ে চলার শক্তি প্রকৃতিপ্রদত্তই। চোখের সামনে কারণে-অকারণে ভাসে রাঢ়িখালে করা তাঁর শেষ সমাধিখানি। জানি না, কেমন আছেন তিনি পরপারে। চিরাচরিত নিয়মে অন্য ভুবনে তিনি আজ কেমন আছেন, সে বিষয় কল্পনা করি না কখনো। শুধু যখন দেখি চারপাশে হিংস্র দানবেরা, যারা দেশের মাটিকে খুবলে খেতে চায়, তখন ভীষণভাবে তাঁকে মনে পড়ে। চোখের সামনে ভাসে তাঁর লেখা আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম বইয়ের উৎসর্গপত্রটি: ‘তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাংলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না। জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমণ্ডলী, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ। মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতো যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন করে আমাকে পীড়ন করো না। আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না।’ বাবা বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন প্রগাঢ়ভাবে। তাই তাকে যখন ছিন্নভিন্ন হতে দেখতেন, তা সহ্য করতে না পেরে কলম ও ভাষার জোরে তা প্রকাশ করতেন। চাই না বাবার লেখা উৎসর্গপত্রের মতো হোক তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের পরিণতি। বাবা দিবসে বাবার লেখা ‘ভালো থেকো’ নামের সেই অনবদ্য কবিতাই যেন তাঁর সব পাঠকের মুখ থেকে উচ্চারিত হতে দেখি:
‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালী গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।’
পৃথিবীর সব বাবাকে আমি বলতে চাই, ‘ভালো থেকো, বাবা, ভালো থেকো।’
No comments