মনের কোণে হীরে-মুক্তো-আইনের শাসন যথেষ্ট নয় প্রয়োজন সু-আইনের সুশাসন by ড. সা'দত হুসাইন
সেই ছোটবেলা থেকে আইনের শাসন বা Rule of
Law-এর কথা শুনে আসছি। তখন এর তাৎপর্য বুঝতাম না। শুধু এটুকু বুঝতাম যে
মুরব্বিরা যখন সবাই ভালো বলেন, তখন এটি বোধ হয় ভালো জিনিসই হবে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে
এসে ধীরে ধীরে এর তাৎপর্য বুঝতে শুরু করলাম। আইনের চোখে সবাই সমান, আইন
নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করে না। সমাজ-রাষ্ট্রের সুব্যবস্থাপনা ও
শান্তিশৃঙ্খলার প্রয়োজনে সবাইকে আইন মেনে চলতে হয়। আইনের পরিপন্থী কাজ করে
কেউ পার পাবে না। প্রবক্তাগোষ্ঠীর স্লোগানধর্মী অতি প্রচার সাধারণ্যে এমন
ধারণার জন্ম দিল যে আইনের শাসন হচ্ছে সমাজ তথা রাষ্ট্রে সুখ, শান্তি ও
সমৃদ্ধির একমাত্র উৎস। এর অভাব হচ্ছে সব সংকটের মূল কারণ। আপাতদৃষ্টিতে এ
বক্তব্যকে নিখাদ সত্য বলে মনে হয়। তবে নিবিড় পর্যালোচনায় ভিন্নরূপ ফলাফল
পরিদৃষ্ট হয়।
আইনের শাসনের পেছনে যে অনুকল্পটি কাজ করে, তা হচ্ছে সব আইন ন্যায়ানুগ এবং তাদের প্রয়োগপদ্ধতি স্বচ্ছ, সমতাভিত্তিক এবং জনকল্যাণে নিবেদিত। কোনো হীন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এসব আইন প্রণীত বা প্রযুক্ত হয়নি। নাগরিকের সমুদয় অধিকারের সুরক্ষণ নিশ্চিত করাই আইনের মূল উদ্দেশ্য। বিনা তর্কে আইন মেনে চলা সুনাগরিকের লক্ষণ। পক্ষান্তরে আইন অমান্য করা একটি অপরাধ, যা সর্বতোভাবে নিন্দনীয়। সেদিক থেকে আইনের প্রতি অনুগত নাগরিক দেশের এক মূল্যবান সম্পদ, আইন ভঙ্গকারী এক বিরাট দায়। আইনের শাসনের প্রতি নিরন্তর সমর্থন জানানো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।
উপরোক্ত বক্তব্যের যথার্থতা মূল্যায়ন করতে হলে আইন প্রণয়নের উৎসমুখে যেতে হয়। আইন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, আইন মানুষের সৃষ্টি। এর অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দেশের কর্তৃত্বে রয়েছে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারাই শক্তিমান; তারাই আইনের প্রণেতা এবং প্রবক্তা। হয়তো বা এ জন্যই বলা হয়ে থাকে, আইন হচ্ছে সার্বভৌম শক্তির (ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যা-ই হোক না কেন) ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশের জনগণই হচ্ছে সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তবে ভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণের এ অধিকার নাও থাকতে পারে। রাজা-বাদশাহ, দেশবিজয়ী সেনাপতি, স্বৈরাচারী একনায়ক বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব জনসাধারণকে তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে সার্বভৌম ক্ষমতা পুরো মাত্রায় তাদের দখলে নিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে জনগণ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক না কেন, উপরোক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। উপরোক্ত ব্যক্তিরা তখন নিজেদের ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করে। অন্যভাবে বলা যায়, তারা নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে আইনে রূপান্তরিত করে জনগণকে সে আইন মানতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে জনগণ সে আইনকেই দেশের স্থায়ী আইন বলে মনে করে।
প্রচলিত আইনে দেশ এবং সমাজের ক্ষমতার কাঠামো প্রতিফলিত হয়। ক্ষমতাবানরা যা চায়, তা তারা আদায় করবেই, আর ক্ষমতাহীনদের তা দিতেই হবে। এ কাজ নির্বিঘ্নে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে থাকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। আইনি কাঠামো ক্ষমতাবানদের স্বার্থ রক্ষার পদ্ধতি-প্রক্রিয়াকে আনুষ্ঠানিক রূপদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কোনো আইন আলাদা ভাসা ভাসাভাবে দেখলে আইনের পেছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য কী রয়েছে, তা হয়তো বোঝা যাবে না, আইনটিকে নির্দোষ এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে প্রণীত বলে মনে হতে পারে। বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক পরিভাষা এবং দ্ব্যর্থক শব্দের বেড়াজালে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি আড়াল করে রাখা সম্ভব হতে পারে।
আসলে আইনের শাসন কি সত্যিকার অর্থে আমজনতার স্বার্থ সুরক্ষণের মাধ্যমে সমাজের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে, না এটি ক্ষমতাবানদের শাসন-শোষণ প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে নিছক স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া সে প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়া যথার্থ হবে না। আইনের শাসন কখনো কখনো বঞ্চিত ব্যক্তির সংক্ষোভ এবং বিড়ম্বনা দূরীকরণে সহায়ক হতে পারে। হম্বিতম্বি করা দুর্বৃত্তকে সময়বিশেষে কিছুটা নিবৃত্ত করতে পারে। ফলে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে আইনসমূহ একচোখা নয়; আইন অপরাধীকে শাস্তি দেয় এবং ক্ষতিগ্রস্তকে সাহায্য করে। এর ফলে অসহায় ব্যক্তিরা দুর্বৃত্তদের কবল থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পায়। বাস্তব চিত্র এ ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গরিব, পদদলিত এবং হতভাগ্য ব্যক্তিরা আইনের শাসন থেকে কোনো ন্যায়ানুগ সুবিধা পায় না। আইনের আশ্রয় পেতে হলে যে সম্পদ এবং শক্তির প্রয়োজন হয়, গরিব মানুষের তা নেই। তা ছাড়া হয়তো দেখা যাবে যে আইনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রাখা আছে সম্পদশালী ক্ষমতাবানদের জন্য বিশেষ সুবিধা। এমন গণবিরোধী আইন থেকে সাধারণ মানুষ কেমন করে সুবিধা পাবে?
এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেখানে মানবিক কারণে আইন ভাঙা সম্পূর্ণরূপে যৌক্তিক ছিল; কারণ আইনটি ছিল গণবিরোধী, মানবাধিকারের পরিপন্থী। এটি ছিল অত্যাচারের হাতিয়ার, শোষণের যন্ত্র এবং বর্বরতার দলিল। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী আইন। এ আইনের কোনো নৈতিক ভিত্তি ছিল না। এটি ছিল একটি কালো আইন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ওই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মৌলিক অধিকারকে পদদলিত করে ঔপনিবেশিক স্বার্থ চরিতার্থ করা। এই আইনের আওতায় দক্ষিণ আফ্রিকার মূল অধিবাসী অশ্বেতাঙ্গ জনগণের ওপর যে জুলুম, অত্যাচার, দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে, তা আইনের শাসনের দিক থেকে যৌক্তিক বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু মানবতার যুক্তিতে, নৈতিকতার যুক্তিতে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পাকিস্তান আমলে এবডো (Electoral Bodies Disqualification Ordinance) এবং প্রোডো (Public Representative Office Disqualification Ordinance) নামে দুটি অধ্যাদেশ বা আইন জারি করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের জাতীয় সংসদ এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। এ দুটি আইনের আওতায় গৃহীত ব্যবস্থা আইনানুগ হলেও ন্যায়ানুগ হয়নি। আইনের শাসনের নামে এ আইনের আওতায় গৃহীত ব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায় না, কারণ এ দুটি আইনই ছিল কালো আইন। এ ধরনের আইন ভাঙার সংগ্রাম আইনের শাসনের পরিপন্থী হলেও নৈতিক এবং মানবিক বিবেচনায় প্রত্যেক সুনাগরিকের পক্ষে সে সংগ্রামে যোগ দেওয়া অপরিহার্য কর্তব্য।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্থার প্রধান এবং সদস্যবৃন্দের নিয়োগ আইন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছা অনুযায়ী হতে পারে; বাস্তবেও তা-ই হয়ে থাকে। শিক্ষিত লোকজন এ পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেন। মোটামুটি সচেতন নাগরিকদের প্রায় সবাই মনে করেন, সাংবিধানিক সংস্থার এসব পদে যাঁরা নিয়োগ পাবেন তাঁরা অত্যন্ত নীতিবান এবং দলনিরপেক্ষ হবেন। রাজনৈতিকভাবে তাঁরা প্রভাবিত হবেন না। এ ধরনের পদের নিয়োগ কোনো না কোনোভাবে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নির্বাচন কমিটি এবং সু-প্রণীত পদ্ধতির মাধ্যমে হওয়া প্রয়োজন। তা না হওয়ার কারণে অতীতে কখনো কখনো রাজনৈতিক ঘরানার লোক, আবার কখনো বা দৃষ্টিকটুভাবে অযোগ্য লোককে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার আলাপ হয়েছে। দলীয় ঘরানার বা নিম্নমানের লোকদের এরূপ গুরুত্বপূর্ণ পদে কেন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বলেছেন, 'আমরা তো কোনো বে-আইনি কাজ করিনি, সব কিছুই আইন (সংবিধান)-এর বিধান অনুযায়ী করেছি।' তাঁদের উত্তর আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। আইন তাঁদের কোনো কিছুর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের ইচ্ছামতো লোক নিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে। এখানেও আইনটি ত্রুটিপূর্ণ, বিনা বাক্য ব্যয়ে এরূপ আইন মেনে নেওয়া বা এর প্রবক্তা হওয়া সুনাগরিকের লক্ষণ নয়।
এখন আসছি 'শাসন'-এর অংশে। শাসনের মান নির্ভর করে প্রয়োগের রীতিনীতি, পদ্ধতি এবং প্রয়োগাচরণের ওপর। কূটকৌশল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রয়োগের কারণে ভালো আইনও নিরপরাধ, সজ্জন ব্যক্তির জীবন দুর্বিষহ করে দিতে পারে। আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগ নাগরিকের জীবনে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সাধারণ নাগরিকরাও এর ফলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। মনে রাখতে হবে, আইনের প্রয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, যারা সাধারণত শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। উন্নয়নশীল দেশে এরা বেশির ভাগ সময়ই নিরপেক্ষ এবং ন্যায়ানুগভাবে কাজ করে না। শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশ তারা যাচাই-বাছাই, বিচার-বিবেচনা ছাড়াই পালন করে। শাসকগোষ্ঠী যদি সৎ ও সুবিবেচক প্রকৃতির না হয়, তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ আইনকে বিকৃতভাবে, বৈষম্যমূলকভাবে এবং কূটচালে পেঁচিয়ে প্রয়োগ করে। একেই তারা আইনের শাসন বলে চালিয়ে দেয়, যদিও সেখানে সুশাসনের লেশমাত্র থাকে না। আমরা দেখেছি যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে এমন ব্যক্তিবৃন্দ প্রকাশ্যে সরকারের উচ্চতম ফোরামে এসে সভা করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন তাদের দেখেও দেখেনি, তারা নিশ্চল-নিশ্চুপ থেকেছে। পক্ষান্তরে গ্রামের নিরীহ লোককে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির অব্যবহিত আগে গ্রাম থেকে বাসে এসে ঢাকায় নামা মাত্র বিনা কারণে, বিনা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুশাসনের বিষয়টি এসব ক্ষেত্রে উহ্য থেকে গেছে।
নাগরিকের কল্যাণ বিধানের জন্য আইনের শাসনই তাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হচ্ছে সু-আইনের সুশাসন। সু-আইন হবে জনস্বার্থ এবং মানবতার অনুকূলে এবং তার প্রয়োগ হবে ন্যায়ানুগ, নিরপেক্ষ এবং সুউদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শাসকগোষ্ঠীকে মনে রাখতে হবে যে জনকল্যাণই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। নিছক আইনের শাসন এ মানদণ্ডের নিরিখে প্রায়ই টেকে না। এ মানদণ্ডের বিচারে মাথা উঁচিয়ে টিকে থাকে 'সু-আইনের সুশাসন'।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব
আইনের শাসনের পেছনে যে অনুকল্পটি কাজ করে, তা হচ্ছে সব আইন ন্যায়ানুগ এবং তাদের প্রয়োগপদ্ধতি স্বচ্ছ, সমতাভিত্তিক এবং জনকল্যাণে নিবেদিত। কোনো হীন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এসব আইন প্রণীত বা প্রযুক্ত হয়নি। নাগরিকের সমুদয় অধিকারের সুরক্ষণ নিশ্চিত করাই আইনের মূল উদ্দেশ্য। বিনা তর্কে আইন মেনে চলা সুনাগরিকের লক্ষণ। পক্ষান্তরে আইন অমান্য করা একটি অপরাধ, যা সর্বতোভাবে নিন্দনীয়। সেদিক থেকে আইনের প্রতি অনুগত নাগরিক দেশের এক মূল্যবান সম্পদ, আইন ভঙ্গকারী এক বিরাট দায়। আইনের শাসনের প্রতি নিরন্তর সমর্থন জানানো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।
উপরোক্ত বক্তব্যের যথার্থতা মূল্যায়ন করতে হলে আইন প্রণয়নের উৎসমুখে যেতে হয়। আইন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, আইন মানুষের সৃষ্টি। এর অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দেশের কর্তৃত্বে রয়েছে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারাই শক্তিমান; তারাই আইনের প্রণেতা এবং প্রবক্তা। হয়তো বা এ জন্যই বলা হয়ে থাকে, আইন হচ্ছে সার্বভৌম শক্তির (ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যা-ই হোক না কেন) ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশের জনগণই হচ্ছে সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তবে ভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণের এ অধিকার নাও থাকতে পারে। রাজা-বাদশাহ, দেশবিজয়ী সেনাপতি, স্বৈরাচারী একনায়ক বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব জনসাধারণকে তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে সার্বভৌম ক্ষমতা পুরো মাত্রায় তাদের দখলে নিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে জনগণ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক না কেন, উপরোক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। উপরোক্ত ব্যক্তিরা তখন নিজেদের ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করে। অন্যভাবে বলা যায়, তারা নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে আইনে রূপান্তরিত করে জনগণকে সে আইন মানতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে জনগণ সে আইনকেই দেশের স্থায়ী আইন বলে মনে করে।
প্রচলিত আইনে দেশ এবং সমাজের ক্ষমতার কাঠামো প্রতিফলিত হয়। ক্ষমতাবানরা যা চায়, তা তারা আদায় করবেই, আর ক্ষমতাহীনদের তা দিতেই হবে। এ কাজ নির্বিঘ্নে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে থাকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। আইনি কাঠামো ক্ষমতাবানদের স্বার্থ রক্ষার পদ্ধতি-প্রক্রিয়াকে আনুষ্ঠানিক রূপদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কোনো আইন আলাদা ভাসা ভাসাভাবে দেখলে আইনের পেছনে প্রকৃত উদ্দেশ্য কী রয়েছে, তা হয়তো বোঝা যাবে না, আইনটিকে নির্দোষ এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে প্রণীত বলে মনে হতে পারে। বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক পরিভাষা এবং দ্ব্যর্থক শব্দের বেড়াজালে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি আড়াল করে রাখা সম্ভব হতে পারে।
আসলে আইনের শাসন কি সত্যিকার অর্থে আমজনতার স্বার্থ সুরক্ষণের মাধ্যমে সমাজের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে, না এটি ক্ষমতাবানদের শাসন-শোষণ প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে নিছক স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া সে প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়া যথার্থ হবে না। আইনের শাসন কখনো কখনো বঞ্চিত ব্যক্তির সংক্ষোভ এবং বিড়ম্বনা দূরীকরণে সহায়ক হতে পারে। হম্বিতম্বি করা দুর্বৃত্তকে সময়বিশেষে কিছুটা নিবৃত্ত করতে পারে। ফলে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে আইনসমূহ একচোখা নয়; আইন অপরাধীকে শাস্তি দেয় এবং ক্ষতিগ্রস্তকে সাহায্য করে। এর ফলে অসহায় ব্যক্তিরা দুর্বৃত্তদের কবল থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পায়। বাস্তব চিত্র এ ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গরিব, পদদলিত এবং হতভাগ্য ব্যক্তিরা আইনের শাসন থেকে কোনো ন্যায়ানুগ সুবিধা পায় না। আইনের আশ্রয় পেতে হলে যে সম্পদ এবং শক্তির প্রয়োজন হয়, গরিব মানুষের তা নেই। তা ছাড়া হয়তো দেখা যাবে যে আইনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রাখা আছে সম্পদশালী ক্ষমতাবানদের জন্য বিশেষ সুবিধা। এমন গণবিরোধী আইন থেকে সাধারণ মানুষ কেমন করে সুবিধা পাবে?
এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেখানে মানবিক কারণে আইন ভাঙা সম্পূর্ণরূপে যৌক্তিক ছিল; কারণ আইনটি ছিল গণবিরোধী, মানবাধিকারের পরিপন্থী। এটি ছিল অত্যাচারের হাতিয়ার, শোষণের যন্ত্র এবং বর্বরতার দলিল। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী আইন। এ আইনের কোনো নৈতিক ভিত্তি ছিল না। এটি ছিল একটি কালো আইন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ওই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মৌলিক অধিকারকে পদদলিত করে ঔপনিবেশিক স্বার্থ চরিতার্থ করা। এই আইনের আওতায় দক্ষিণ আফ্রিকার মূল অধিবাসী অশ্বেতাঙ্গ জনগণের ওপর যে জুলুম, অত্যাচার, দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে, তা আইনের শাসনের দিক থেকে যৌক্তিক বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু মানবতার যুক্তিতে, নৈতিকতার যুক্তিতে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পাকিস্তান আমলে এবডো (Electoral Bodies Disqualification Ordinance) এবং প্রোডো (Public Representative Office Disqualification Ordinance) নামে দুটি অধ্যাদেশ বা আইন জারি করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের জাতীয় সংসদ এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। এ দুটি আইনের আওতায় গৃহীত ব্যবস্থা আইনানুগ হলেও ন্যায়ানুগ হয়নি। আইনের শাসনের নামে এ আইনের আওতায় গৃহীত ব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায় না, কারণ এ দুটি আইনই ছিল কালো আইন। এ ধরনের আইন ভাঙার সংগ্রাম আইনের শাসনের পরিপন্থী হলেও নৈতিক এবং মানবিক বিবেচনায় প্রত্যেক সুনাগরিকের পক্ষে সে সংগ্রামে যোগ দেওয়া অপরিহার্য কর্তব্য।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্থার প্রধান এবং সদস্যবৃন্দের নিয়োগ আইন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছা অনুযায়ী হতে পারে; বাস্তবেও তা-ই হয়ে থাকে। শিক্ষিত লোকজন এ পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেন। মোটামুটি সচেতন নাগরিকদের প্রায় সবাই মনে করেন, সাংবিধানিক সংস্থার এসব পদে যাঁরা নিয়োগ পাবেন তাঁরা অত্যন্ত নীতিবান এবং দলনিরপেক্ষ হবেন। রাজনৈতিকভাবে তাঁরা প্রভাবিত হবেন না। এ ধরনের পদের নিয়োগ কোনো না কোনোভাবে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নির্বাচন কমিটি এবং সু-প্রণীত পদ্ধতির মাধ্যমে হওয়া প্রয়োজন। তা না হওয়ার কারণে অতীতে কখনো কখনো রাজনৈতিক ঘরানার লোক, আবার কখনো বা দৃষ্টিকটুভাবে অযোগ্য লোককে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার আলাপ হয়েছে। দলীয় ঘরানার বা নিম্নমানের লোকদের এরূপ গুরুত্বপূর্ণ পদে কেন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বলেছেন, 'আমরা তো কোনো বে-আইনি কাজ করিনি, সব কিছুই আইন (সংবিধান)-এর বিধান অনুযায়ী করেছি।' তাঁদের উত্তর আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। আইন তাঁদের কোনো কিছুর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের ইচ্ছামতো লোক নিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে। এখানেও আইনটি ত্রুটিপূর্ণ, বিনা বাক্য ব্যয়ে এরূপ আইন মেনে নেওয়া বা এর প্রবক্তা হওয়া সুনাগরিকের লক্ষণ নয়।
এখন আসছি 'শাসন'-এর অংশে। শাসনের মান নির্ভর করে প্রয়োগের রীতিনীতি, পদ্ধতি এবং প্রয়োগাচরণের ওপর। কূটকৌশল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রয়োগের কারণে ভালো আইনও নিরপরাধ, সজ্জন ব্যক্তির জীবন দুর্বিষহ করে দিতে পারে। আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগ নাগরিকের জীবনে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সাধারণ নাগরিকরাও এর ফলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। মনে রাখতে হবে, আইনের প্রয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, যারা সাধারণত শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। উন্নয়নশীল দেশে এরা বেশির ভাগ সময়ই নিরপেক্ষ এবং ন্যায়ানুগভাবে কাজ করে না। শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশ তারা যাচাই-বাছাই, বিচার-বিবেচনা ছাড়াই পালন করে। শাসকগোষ্ঠী যদি সৎ ও সুবিবেচক প্রকৃতির না হয়, তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ আইনকে বিকৃতভাবে, বৈষম্যমূলকভাবে এবং কূটচালে পেঁচিয়ে প্রয়োগ করে। একেই তারা আইনের শাসন বলে চালিয়ে দেয়, যদিও সেখানে সুশাসনের লেশমাত্র থাকে না। আমরা দেখেছি যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে এমন ব্যক্তিবৃন্দ প্রকাশ্যে সরকারের উচ্চতম ফোরামে এসে সভা করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন তাদের দেখেও দেখেনি, তারা নিশ্চল-নিশ্চুপ থেকেছে। পক্ষান্তরে গ্রামের নিরীহ লোককে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির অব্যবহিত আগে গ্রাম থেকে বাসে এসে ঢাকায় নামা মাত্র বিনা কারণে, বিনা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুশাসনের বিষয়টি এসব ক্ষেত্রে উহ্য থেকে গেছে।
নাগরিকের কল্যাণ বিধানের জন্য আইনের শাসনই তাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হচ্ছে সু-আইনের সুশাসন। সু-আইন হবে জনস্বার্থ এবং মানবতার অনুকূলে এবং তার প্রয়োগ হবে ন্যায়ানুগ, নিরপেক্ষ এবং সুউদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শাসকগোষ্ঠীকে মনে রাখতে হবে যে জনকল্যাণই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। নিছক আইনের শাসন এ মানদণ্ডের নিরিখে প্রায়ই টেকে না। এ মানদণ্ডের বিচারে মাথা উঁচিয়ে টিকে থাকে 'সু-আইনের সুশাসন'।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব
No comments