কালের পুরাণ ‘প্রার্থী’ জিতবে না ‘দল’ জিতবে? by সোহরাব হাসান

আজ সকালে যখন পাঠকের হাতে প্রথম আলো পৌঁছাবে, তখন বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট—এই চার সিটি করপোরেশনে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের খবর বা বিশ্লেষণ
পড়ার চেয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করাকে নিশ্চয়ই অধিক জরুরি কাজ মনে করবেন। কেননা, সাধারণ মানুষের হাতে একটি মাত্র অস্ত্র আছে—ভোট। বাংলাদেশে ভোট হলো খরস্রোতা নদীর মতো, যা মুহূর্তে রাজাকে নিঃস্ব বানায়, আবার নিঃস্বকেও রাজা বানায়। চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হবে, এর ভবিষ্যৎ রাজা কারা হবেন, তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
নির্বাচন কমিশন নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের যে প্রস্তুতি নিয়েছে, তাতে তারা মোটামুটি উতরে গেছে। যেসব প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় আইন ভঙ্গ করেছেন তাঁদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আইন ভঙ্গকারী উপজেলা চেয়ারম্যানদের কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে, কেন তাঁরা নির্বাচনী এলাকায় সরকারি গাড়ি নিয়ে গেছেন?
তবে নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে আজ ভোর আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। ভোটের পর্বটা ঠিকমতো পার করতে পারলে, অর্থাৎ ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে এসে যদি পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেন, তাহলে বুঝব কমিশন চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। আর এ কথাও সত্য, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার দায়িত্ব কেবল নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনের নয়; প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং তাঁদের পেছনের রাজনৈতিক শক্তিরও ভূমিকা আছে। তাঁরা বেয়াড়া আচরণ করলে নির্বাচন কমিশন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করবে? তারা বড়জোর ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দিতে পারে।
চার সিটি করপোরেশনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এটা বুঝতে পেরেছেন যে ভোটের বাক্স দখল করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যাবে না। জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সুবিধা করা যাবে না। নির্বাচনে পেশিশক্তির ব্যবহার আগেই কমে গেছে। কালোটাকার প্রভাব থাকলেও তা এমন নয় যে, নির্বাচনী ফলকে একেবারে উল্টে দেবে। নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত বলেই মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটা বেশ জমে উঠেছিল। সুসমাচার হলো এই, লড়াইটা প্রকাশ্যে সংঘাতে রূপ নেয়নি।

দুই
কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন যখন দায়িত্ব নেয়, তখন অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, কমিশন একটি নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে করতে পারবে কি না। কিন্তু রংপুর সিটি করপোরেশনসহ যে কটি নির্বাচন তারা করেছে, সেসব সম্পর্কে তেমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশনের দাবি, তারা কথার চেয়ে কাজে বিশ্বাসী। তাদের সেই কাজের বিশ্বাসটা আজ প্রমাণিত হবে। নির্বাচনে যে-ই জিতুক বা হারুক, নির্বাচনটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হলে গণতন্ত্র বাঁচবে। নির্বাচন কমিশন যদি সেই কাজটি করতে পারে, আমরা তাদের দুই হাত তুলে মোবারকবাদ জানাব, আর না পারলে রাজনৈতিক সমস্যা আরও ঘনীভূত হবে। বিরোধী দল ইতিমধ্যে আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, সিটি নির্বাচনে সরকার কারচুপির চেষ্টা চালালে পরদিন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে।
আশার কথা, দুই দলের প্রার্থীরা মনে করছেন, তাঁরা জিতবেনই। ফলে আগ বাড়িয়ে কেউ নির্বাচনী প্রক্রিয়া ভন্ডুল করতে চাইছেন না। তবে প্রার্থীরা যা চান, সব ক্ষেত্রে তা সফল হয় না, দলের অতি উৎসাহ কর্মী বা বাইরের কেউ অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করতে পারে। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সে আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছে। আমরা সব আশঙ্কার মুখে ছাই দিয়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করছি। ভোটের সময় কেউ অঘটনের চেষ্টা চালালে নির্বাচন কমিশনকে শক্ত হাতে তা মোকাবিলা করতে হবে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা যেন কথার কথা না হয়। এই নির্বাচন কমিশনের জন্য অগ্নিপরীক্ষাও। এই পরীক্ষায় তারা পাস করলে জাতীয় নির্বাচন করা কঠিন হবে না। আর পাস না করলে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যত সমঝোতাই হোক না কেন, কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, সাবেক সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফ মাস্তানদের বিরুদ্ধে তিন গুণ মাস্তানি করে হলেও তাদের অপতৎপরতা বন্ধের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি পারেননি। মাগুরা ও মিরপুরে মাস্তানেরাই জয়ী হয়েছিল। মাগুরা উপনির্বাচন যেমন বিএনপি সরকারের পাশাপাশি গণতন্ত্রেরও বিদায়ঘণ্টা বাজিয়েছিল, চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।

তিন
চার সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে ১২ জন প্রার্থী হলেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আটজন। এই আটজনের মধ্যে চারজন সদ্য বিদায়ী মেয়র, যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক ও স্থানীয় নেতা। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে ১৪ দল, বিএনপি প্রার্থীকে ১৮ দল ও হেফাজতে ইসলাম। জাতীয় পার্টি মাঝামাঝি অবস্থানে। সম্ভবত বামদের ভোটও আওয়ামী লীগ প্রার্থী পাবেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরীক্ষিত হলেও বিএনপির প্রার্থীরা এখনো পরীক্ষা প্রার্থনীয় কাতারে। সরকারবিরোধী অবস্থানের কারণে তাঁরা বাড়তি সুবিধা পাবেন বলে আশা করছেন। কেননা, মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অনেকটাই নড়ে গেছে। ভোটাররা তাঁদের হতাশার বিপরীতে নতুন আশা খুঁজতে চাইবেন বিরোধী দলের কাছে।
অন্যদিকে ব্যক্তি ইমেজে চারটি সিটি করপোরেশনেই সদ্য বিদায়ী মেয়ররা প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। গত পাঁচ বছরে তাঁরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। স্থানীয়ভাবে এই চারজন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েননি। কিন্তু রাজশাহী ছাড়া বাকি তিনটি সিটি করপোরেশনেই বিএনপির সমর্থক প্রার্থীর বিপক্ষে দলের ভেতরেই একটি ধারা রয়েছে, প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে। সেই ধারার কর্মী-সমর্থকেরা কতটা আন্তরিকভাবে প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন, তার ওপর ফলাফল নির্ভর করছে।
প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও দক্ষতায় চার সিটিতেই আওয়ামী লীগের সমর্থক প্রার্থীরা ভালো অবস্থানে। এই ভালো অবস্থানটা যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সৃষ্ট জনমতের চেয়ে সবল হয়, তাহলে তাঁরা জিতে যাবেন। যদি দুর্বল হয় জয়ী হওয়া কঠিন হবে। অন্যদিকে বিএনপির সমর্থক প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির ঘাটতিটা যদি দলীয় সমর্থন পুষিয়ে নিতে পারে, তাহলে তাঁদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর না পারলে তাঁরাও কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়বেন। বিরোধী দলের আগাম হুঁশিয়ারি সেই চাপেরই অংশ কি না, সেটি দেখতে আমাদের আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
তাহলে আমরা নির্বাচনী ফলাফলের সমীকরণটি কীভাবে টানতে পারি? সব সম্ভবের দেশে নাটকীয় অনেক কিছুই ঘটতে পারে। যেহেতু চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উভয় পক্ষ সমান শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে, তাদের লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হবে। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, ইতিনেতি মিলিয়ে দুই দুই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার যেখানে একটি ভোট বেশি পেলে কেউ বিজয়ী হন, সেখানে সেই দুই বনাম দুই, তিন বনাম এক-এও রূপ নিতে পারে। অন্যদিক থেকে যাদের দুই পাওয়ার সম্ভাবনা, তারা একটু চেষ্টা চালিয়ে দুইকে তিন করে নিতে পারে। এমনকি চার বনাম শূন্য হলেও অবাক হব না।
এই সিটি নির্বাচনে সরকার বদলাবে না। বিরোধী দল যদি চারটি সিটি করপোরেশনেও জয়ী হয়, তাতে সরকারের ক্ষতির কারণ দেখি না; তাদের ‘সর্বকালের সর্বজনপ্রিয়’ খেতাবটি হাতছাড়া হবে মাত্র। আবার বিরোধী দল যদি চারটি সিটি করপোরেশনে কাঙ্ক্ষিত ফল না পায়, তাতেও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু কোনো পক্ষ যদি জবরদস্তিভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চায়, ফলাফল নিজের পক্ষে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং সেটি না পেরে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়, তাহলে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যাবে। দুই পক্ষকেই মানতে হবে, জনগণ যাঁদের বেশি ভোট দেবেন, তাঁরা জয়ী হবেন। মেয়র-কাউন্সিলর হবেন। যাঁরা পরাজিত হবেন, তাঁরা পরেরবার জেতার জন্য চেষ্টা করবেন। কিন্তু জনগণের ভোটের অধিকার খর্ব করা যাবে না। গণতন্ত্রকে হারতে দেওয়া যাবে না।

চার
এবারের চার সিটি নির্বাচনে অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে। নির্বাচনটি অরাজনৈতিক হলেও নিজ নিজ মেয়র পদপ্রার্থীর পক্ষে দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারযুদ্ধে নেমেছিলেন। আমাদের জাতীয় নেতারা নিজেদের নির্বাচন ছাড়া এলাকায় যান না। সিটি নির্বাচন তাঁদের এলাকায় টেনে নিয়ে গেছে। যে দেশের রাজনীতিকেরা সবকিছু কেন্দ্রের চশমায় দেখতে অভ্যস্ত, সে দেশে এটি বড় পরিবর্তন বলে মনে করি। আশা করি, নির্বাচনের পরও কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন এলাকায় যাবেন, থাকবেন এবং ভোটারদের সুখ-দুঃখের কথা শুনবেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ, মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখেছি, গত দুই সপ্তাহে কোনো সিটি করপোরেশন এলাকায় সেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ, তখন স্থানীয় নেতারা পরস্পরে আলিঙ্গন করছেন, মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। এক মঞ্চে বসে নিজের নির্বাচনী ওয়াদার কথা ভোটারদের জানাচ্ছেন। দুই দলের পুরোহিত নেতারা স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক সহ-অবস্থানের ভাষা শিখে নিতে পারেন। নির্বাচনে প্রচারণা লড়াইয়ের শেষ মুহূর্তে কিছু নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে; যেমন নির্বাচনী প্রচারে ধর্মের ব্যবহার, কোনো প্রার্থীর পক্ষে এবং কোনো প্রার্থীর বিপক্ষে ‘অরাজনৈতিক’ ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের জিহাদ ঘোষণা। যেমন প্রতিপক্ষের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে গিয়ে বরিশালে অপ্রীতিকর ঘটনা, যা নির্বাচনী আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই অসহিষ্ণুতা আর কত দিন চলবে? সিটি নির্বাচনে সরকার বদলাবে জানি। অন্তত আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা বদলাক।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.