আমার বাবা: অভিনেতা আলী যাকেরকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর ছেলে ইরেশ যাকের আমার ‘সুপার শিশু’
বাবার ডাকনাম ছোটলু। নামকরণের সময় অসাধারণ
দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন দাদা-দাদি। নইলে বড়সড় সাইজের বাচ্চাটা যে
প্রায় ৭০ বছর পরও ছোটই থেকে যাবে, সেটা সেই ১৯৪৪ সালে তাঁদের কোনোভাবেই
বোঝার কথা নয়।
ভিমের গঠন ও বটবৃক্ষের বিশালতা ধারণ করেও ছোটলু এখনো শিশুই থেকে গেছে। উদাহরণ দিই।
গত বছর বাংলাদেশের এশিয়া কাপের খেলা চলছে ভারতের বিপক্ষে। খেলার পুরোটা সময়ই আমার প্রায় শয্যাশায়ী অবস্থা। ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয় হয়। পাশে ছোটলু বসে প্রায় ৭০ ওভার ধরে আমাকে সবক দিচ্ছে, ‘বাবা, এটা জাস্ট একটা খেলা। এত টেনশন করতে হয় না। শরীর খারাপ হয়ে যাবে।’ শেষের কয়েকটি ওভার। ছোটলু না পারে বসতে, না পারে দাঁড়াতে। দুই সেকেন্ড পরপর ‘না এইগুলাকে দিয়ে কিস্যু হবে না’ বলে উঠে চলে যায়। আবার তিন পা গিয়ে ফেরত এসে বসে। বাংলাদেশের জয়ের পর, পা রাখার ছোট টেবিলটার ওপর দড়াম করে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। ভারসাম্য হারিয়ে একাকার অবস্থা। তার পরও তার উৎসাহ কমে না। নাচানাচি শেষে পা মালিশ করতে করতে বলে, ‘হে হে। একটু বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম মনে হয়।’ এই আমার বাবা ওরফে ছোটলু। তার শিশুসুলভ আচরণ যে সব সময় কৌতুকপূর্ণ, তা নয়। শিশুর মতো কষ্ট পায়, আবার শিশুর মতো অভিমান করে। শিশুর মতোই আবেগপ্রবণ। উঠতে-বসতে আমার ছোট বোনের কাছে বকা খায়। এটা শুধু এখনকার কথা নয়, সেই ছোট্টটি থেকেই এই দেখে আসছি।
আরেকটা গল্প বলি। বছর বিশেক আগের কথা। আমি তখন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাচ্ছি। বিমানবন্দরের দিকে গাড়ি যাত্রা করার আগেই কান্নার রোল পড়ে গেছে। আমি কাঁদছি, মা কাঁদছে, বোন কাঁদছে, কাজের লোকেরা কাঁদছে, এমনকি বাসার কুকুরটাও কিউ কিউ করছে। এই নাটকের মধ্যে বাবা সবার ‘স্পিরিট আপ’ করার দায়িত্ব নিল। ‘এত কান্নাকাটির কী আছে? কিছুদিন পরই তো দেখা হবে। ছেলে বড় হয়েছে, বিদেশে যাবে না?’ এ রকম নানা ধরনের কথা বলে আমাদের শক্ত করার চেষ্টা। বাবার ধারাভাষ্যের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাঁদতে কাঁদতে পৌঁছালাম বিমানবন্দরে। গেটে ঢোকার আগে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরল। উপলব্ধি করলাম, তার সারা গা আবেগে কাঁপছে। পুরোপুরি একটা বাচ্চার মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করল লোকটা। মহা মুশকিল। এ রকম অবস্থায় বিদেশে যেতে কার ইচ্ছা করে?
বাবার ছোটলুমির এ রকম অগণিত ঘটনা আছে। প্রায় প্রতিদিনই সে বাচ্চার মতো কিছু না কিছু করে। লোভে পড়ে ক্যামেরা কিনে ফেলে, তারপর মায়ের কাছ থেকে বকা খাওয়ার ভয়ে সেটা লুকিয়ে রাখে। সবজি ছাড়া কিছু খাবে না বলে তীব্র প্রতিজ্ঞা করে লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিজ থেকে বের করে গরুর মাংস খায়। সকাল-বিকাল অফিস থেকে শেষবারের মতো অবসর নেয়, আবার কোনো কাজে তাকে ‘ইনভলব’ না করলে মন খারাপ করে মুখ ঝুলিয়ে বসে থাকে।
কীর্তিকথা পড়ে হয়তো মনে হবে, বাবাই শিশু আর আমরা বড়। বিষয়টা অনেকখানি সত্য। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই শিশুই তার চারপাশের মানুষকে শত বিপদ থেকে আগলে রেখেছে। এই শিশুর সুবিশাল ছায়ায় আমরা নিরাপদ বোধ করি। আমরা জানি, কখনো যদি পড়ে যাই, এই শিশুই আমাদের টেনে ওঠাবে। প্রকৃত সরলতাই হয়তো তার এই অসাধারণ শক্তির উৎস। সঠিক বলতে পারব না, কারণ বাবার মতো সরল আমি হতে পারিনি। ‘সুপার শিশু’ হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু চাই, আরও অনেক বছর ছোটলুর শিশু হয়ে বেঁচে থাকতে।
বাবাকে অনেক আদর আর ভালোবাসা।
গত বছর বাংলাদেশের এশিয়া কাপের খেলা চলছে ভারতের বিপক্ষে। খেলার পুরোটা সময়ই আমার প্রায় শয্যাশায়ী অবস্থা। ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয় হয়। পাশে ছোটলু বসে প্রায় ৭০ ওভার ধরে আমাকে সবক দিচ্ছে, ‘বাবা, এটা জাস্ট একটা খেলা। এত টেনশন করতে হয় না। শরীর খারাপ হয়ে যাবে।’ শেষের কয়েকটি ওভার। ছোটলু না পারে বসতে, না পারে দাঁড়াতে। দুই সেকেন্ড পরপর ‘না এইগুলাকে দিয়ে কিস্যু হবে না’ বলে উঠে চলে যায়। আবার তিন পা গিয়ে ফেরত এসে বসে। বাংলাদেশের জয়ের পর, পা রাখার ছোট টেবিলটার ওপর দড়াম করে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। ভারসাম্য হারিয়ে একাকার অবস্থা। তার পরও তার উৎসাহ কমে না। নাচানাচি শেষে পা মালিশ করতে করতে বলে, ‘হে হে। একটু বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম মনে হয়।’ এই আমার বাবা ওরফে ছোটলু। তার শিশুসুলভ আচরণ যে সব সময় কৌতুকপূর্ণ, তা নয়। শিশুর মতো কষ্ট পায়, আবার শিশুর মতো অভিমান করে। শিশুর মতোই আবেগপ্রবণ। উঠতে-বসতে আমার ছোট বোনের কাছে বকা খায়। এটা শুধু এখনকার কথা নয়, সেই ছোট্টটি থেকেই এই দেখে আসছি।
আরেকটা গল্প বলি। বছর বিশেক আগের কথা। আমি তখন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাচ্ছি। বিমানবন্দরের দিকে গাড়ি যাত্রা করার আগেই কান্নার রোল পড়ে গেছে। আমি কাঁদছি, মা কাঁদছে, বোন কাঁদছে, কাজের লোকেরা কাঁদছে, এমনকি বাসার কুকুরটাও কিউ কিউ করছে। এই নাটকের মধ্যে বাবা সবার ‘স্পিরিট আপ’ করার দায়িত্ব নিল। ‘এত কান্নাকাটির কী আছে? কিছুদিন পরই তো দেখা হবে। ছেলে বড় হয়েছে, বিদেশে যাবে না?’ এ রকম নানা ধরনের কথা বলে আমাদের শক্ত করার চেষ্টা। বাবার ধারাভাষ্যের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাঁদতে কাঁদতে পৌঁছালাম বিমানবন্দরে। গেটে ঢোকার আগে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরল। উপলব্ধি করলাম, তার সারা গা আবেগে কাঁপছে। পুরোপুরি একটা বাচ্চার মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করল লোকটা। মহা মুশকিল। এ রকম অবস্থায় বিদেশে যেতে কার ইচ্ছা করে?
বাবার ছোটলুমির এ রকম অগণিত ঘটনা আছে। প্রায় প্রতিদিনই সে বাচ্চার মতো কিছু না কিছু করে। লোভে পড়ে ক্যামেরা কিনে ফেলে, তারপর মায়ের কাছ থেকে বকা খাওয়ার ভয়ে সেটা লুকিয়ে রাখে। সবজি ছাড়া কিছু খাবে না বলে তীব্র প্রতিজ্ঞা করে লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিজ থেকে বের করে গরুর মাংস খায়। সকাল-বিকাল অফিস থেকে শেষবারের মতো অবসর নেয়, আবার কোনো কাজে তাকে ‘ইনভলব’ না করলে মন খারাপ করে মুখ ঝুলিয়ে বসে থাকে।
কীর্তিকথা পড়ে হয়তো মনে হবে, বাবাই শিশু আর আমরা বড়। বিষয়টা অনেকখানি সত্য। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই শিশুই তার চারপাশের মানুষকে শত বিপদ থেকে আগলে রেখেছে। এই শিশুর সুবিশাল ছায়ায় আমরা নিরাপদ বোধ করি। আমরা জানি, কখনো যদি পড়ে যাই, এই শিশুই আমাদের টেনে ওঠাবে। প্রকৃত সরলতাই হয়তো তার এই অসাধারণ শক্তির উৎস। সঠিক বলতে পারব না, কারণ বাবার মতো সরল আমি হতে পারিনি। ‘সুপার শিশু’ হওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু চাই, আরও অনেক বছর ছোটলুর শিশু হয়ে বেঁচে থাকতে।
বাবাকে অনেক আদর আর ভালোবাসা।
No comments