জুম পাহাড়ে সুখ-দুঃখ ভূমি সমস্যার সমাধানই শান্তির শর্ত by হরি কিশোর চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি
কমিশন আইন, ২০০১ সংশোধন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার অস্থিরতা শুরু
হয়েছে। বাঙালি সংগঠনগুলো ইতিমধ্যে পৃথকভাবে এক দিন অবরোধ ও এক দিন হরতাল
পালন করেছে।
গত রোববার ভোর ছয়টা থেকে শুরু হয়েছে টানা ৭২
ঘণ্টার হরতাল। অপরদিকে বাঙালিদের হরতাল-অবরোধে আদিবাসীরা উদ্বেগ প্রকাশ
করেছেন। পাশাপাশি আদিবাসীদের আশঙ্কা, ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনীতে এমন কিছু
শব্দ বাদ দেওয়া হয়েছে যে শব্দগুলো না থাকায় ভূমি সমস্যার ৭০ শতাংশ
অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়ে যাবে (প্রথম আলোর আলোকিত চট্টগ্রাম, তারিখ: ৯ জুন,
২০১৩)।
গত ২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর সংশোধনী নীতিগতভাবে অনুমোদন লাভ করে। পরে ৩ জুন তা মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। ১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সই হওয়া পার্বত্য চুক্তিতে ভূমি সমস্যাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই ভূমি সমস্যা সমাধানে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ভূমি কমিশন গঠন করার শর্ত রাখা হয় চুক্তিতে। সেই শর্তে কীভাবে ভূমি কমিশন গঠিত হবে, কমিশনের আওতা কী হবে, সেসবের নির্দেশনা রয়েছে পার্বত্য চুক্তিতে।
২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শেষ সময়ে পৌঁছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদে পাস করে। কিন্তু সেই আইনের ২৩টি ধারা পার্বত্য চুক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক বলে অভিযোগ তোলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জনসংহতি সমিতিসহ বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। এর পর থেকে বিএনপি সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে প্রায় ১১ বছর ধরে আলোচনা করে।
শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালের ৩০ জুলাই আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে ১৩টি ধারা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১০টি ধারা সংশোধন না করার বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ আদিবাসী সংগঠনগুলো ছাড় দেয়। পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে আইনটির সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাসের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। অবশেষে ওই ১৩ দফা সংশোধনীর কিছু শব্দ বাদ দিয়ে গত ২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধিত) আইন, ২০১৩ নীতিগত অনুমোদন লাভ করে। পরে ৩ জুন তা চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে (প্রথম আলো, পৃষ্ঠা ৩, তারিখ: ৪ জুন, ২০১৩)।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের অসীম কোনো ক্ষমতা নেই। কমিশনকে কার্যক্রম চালাতে হবে অবশ্যই সীমিত ক্ষমতা ও গণ্ডির মধ্যে। কমিশন আইনের কমিশনের কার্যাবলি ও ক্ষমতা অংশে ৬-এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, কমিশনের কার্যাবলি নিম্নরূপ হইবে: (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা; (খ) আবেদনে উল্লেখিত ভূমিতে আবেদনকারী বা ক্ষেত্রমতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নির্ধারণ বা প্রয়োজনবোধে দখল পুনর্বহাল; (গ) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইনবহির্ভূতভাবে কোনো ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল; তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীন অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং রক্ষিত (Reserved) বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পকারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এই উপধারা প্রযোজ্য হইবে না।
তা হলে দেখা যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বাঙালি বিতাড়ন বা কাউকে অন্যায়ভাবে নিজস্ব জায়গাজমি থেকে উচ্ছেদের কোনো এখতিয়ার নেই। কেউ কারও জায়গা বা স্থাপনা জবরদস্তিমূলকভাবে বেদখল করলে উচ্ছেদ ব্যক্তি বা পরিবারকে সেখানে পুনর্বহাল করার এখতিয়ার প্রচলিত আইনেই আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কমিশন গঠন করা হয়েছে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা দূর করা এবং আইনকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য। এ ছাড়া আইনটি সংশোধনের অনুমোদন দেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে পাহাড়ি-বাঙালি সবার মঙ্গলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হচ্ছে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ব্রিটিশ আমল থেকে বারবার উচ্ছেদ হয়েছেন। প্রথমে ১৮৮০-এর দশকে সংরক্ষিত বনভূমি স্থাপনের নামে প্রথম উচ্ছেদ-প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তারপর ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সময়। পরবর্তী সময়ে সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৮৯ সাল থেকে কয়েক বছর ধরে বাঙালি পুনর্বাসন কার্যক্রমের ফলে হাজার হাজার আদিবাসী পরিবার এক থেকে তিনবার পর্যন্ত উদ্বাস্তু হয়েছে বলে ইউএনডিপির এক জরিপে উল্লেখ রয়েছে (Socio-Economic Baseline survey of Chittagong Hill Tracts, April 8, 2009)। সে কারণে ভূমি বিষয়ে আদিবাসীদের মধ্যে সব সময় একটা আশঙ্কার মধ্যে থাকার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। তার পরও আদিবাসীদের সংগঠনগুলোর কোনো কর্মসূচি নেই ভূমি কমিশন আইন সংশোধনী নিয়ে। কিন্তু বাঙালি সংগঠনগুলোর একের পর এক কর্মসূচি দেওয়ার যুক্তি কী? সমস্যাটাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা, নাকি আদিবাসীদের ভূমি বেদখল অব্যাহত রাখা? আদিবাসীদের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত সরকারি হিসাবে এক লাখ ২৭ হাজারের বেশি পরিবার নিজেদের ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। এর মধ্যে ৯০ হাজার আদিবাসী ও ৩৭ হাজার বাঙালি পরিবার রয়েছে। এদের সরকারিভাবে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু আখ্যায়িত করা হয়েছে। এসব অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত থেকে ফিরে আসা ১২ হাজারের বেশি পাহাড়ি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য গঠন করা হয়েছে ‘ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তু পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্স’। টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ি জেলা থেকে নির্বাচিত সরকারি দলের সাংসদ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা একাধিকবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ভূমি সমস্যার সমাধান না হলে তাদের (টাস্কফোর্স) করার কিছুই নেই। কারণ, উদ্বাস্তু এবং শরণার্থীদের প্রধান সমস্যা ভূমি সমস্যা। তারা (উদ্বাস্তু ও শরণার্থী) নিজেদের বাস্তুভিটা ফেরত না পেলে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব নয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটির সঙ্গে অন্যগুলোর সম্পর্ক বিদ্যমান। তার মধ্যে ভূমি সমস্যাটাই প্রধান। ভূমি সমস্যা সমাধান ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান অকল্পনীয়। তাই অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও উন্নয়ন নির্ভর করছে ভূমি সমস্যা সমাধানের ওপর। যত বাধাবিপত্তি আসুক, সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানে হাত দিতেই হবে। তা না হলে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তির যে কথা বলা হয়, তা হবে মুখের কথা; বাস্তবে কোনো দিন সম্ভব হবে না।
হরি কিশোর চাকমা: সাংবাদিক।
গত ২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর সংশোধনী নীতিগতভাবে অনুমোদন লাভ করে। পরে ৩ জুন তা মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। ১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সই হওয়া পার্বত্য চুক্তিতে ভূমি সমস্যাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই ভূমি সমস্যা সমাধানে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ভূমি কমিশন গঠন করার শর্ত রাখা হয় চুক্তিতে। সেই শর্তে কীভাবে ভূমি কমিশন গঠিত হবে, কমিশনের আওতা কী হবে, সেসবের নির্দেশনা রয়েছে পার্বত্য চুক্তিতে।
২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শেষ সময়ে পৌঁছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদে পাস করে। কিন্তু সেই আইনের ২৩টি ধারা পার্বত্য চুক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক বলে অভিযোগ তোলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জনসংহতি সমিতিসহ বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। এর পর থেকে বিএনপি সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে প্রায় ১১ বছর ধরে আলোচনা করে।
শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালের ৩০ জুলাই আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে ১৩টি ধারা সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১০টি ধারা সংশোধন না করার বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ আদিবাসী সংগঠনগুলো ছাড় দেয়। পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে আইনটির সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাসের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। অবশেষে ওই ১৩ দফা সংশোধনীর কিছু শব্দ বাদ দিয়ে গত ২৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধিত) আইন, ২০১৩ নীতিগত অনুমোদন লাভ করে। পরে ৩ জুন তা চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে (প্রথম আলো, পৃষ্ঠা ৩, তারিখ: ৪ জুন, ২০১৩)।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের অসীম কোনো ক্ষমতা নেই। কমিশনকে কার্যক্রম চালাতে হবে অবশ্যই সীমিত ক্ষমতা ও গণ্ডির মধ্যে। কমিশন আইনের কমিশনের কার্যাবলি ও ক্ষমতা অংশে ৬-এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, কমিশনের কার্যাবলি নিম্নরূপ হইবে: (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা; (খ) আবেদনে উল্লেখিত ভূমিতে আবেদনকারী বা ক্ষেত্রমতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নির্ধারণ বা প্রয়োজনবোধে দখল পুনর্বহাল; (গ) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইনবহির্ভূতভাবে কোনো ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল; তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীন অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং রক্ষিত (Reserved) বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পকারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এই উপধারা প্রযোজ্য হইবে না।
তা হলে দেখা যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বাঙালি বিতাড়ন বা কাউকে অন্যায়ভাবে নিজস্ব জায়গাজমি থেকে উচ্ছেদের কোনো এখতিয়ার নেই। কেউ কারও জায়গা বা স্থাপনা জবরদস্তিমূলকভাবে বেদখল করলে উচ্ছেদ ব্যক্তি বা পরিবারকে সেখানে পুনর্বহাল করার এখতিয়ার প্রচলিত আইনেই আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কমিশন গঠন করা হয়েছে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা দূর করা এবং আইনকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য। এ ছাড়া আইনটি সংশোধনের অনুমোদন দেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে পাহাড়ি-বাঙালি সবার মঙ্গলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হচ্ছে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ব্রিটিশ আমল থেকে বারবার উচ্ছেদ হয়েছেন। প্রথমে ১৮৮০-এর দশকে সংরক্ষিত বনভূমি স্থাপনের নামে প্রথম উচ্ছেদ-প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তারপর ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সময়। পরবর্তী সময়ে সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৮৯ সাল থেকে কয়েক বছর ধরে বাঙালি পুনর্বাসন কার্যক্রমের ফলে হাজার হাজার আদিবাসী পরিবার এক থেকে তিনবার পর্যন্ত উদ্বাস্তু হয়েছে বলে ইউএনডিপির এক জরিপে উল্লেখ রয়েছে (Socio-Economic Baseline survey of Chittagong Hill Tracts, April 8, 2009)। সে কারণে ভূমি বিষয়ে আদিবাসীদের মধ্যে সব সময় একটা আশঙ্কার মধ্যে থাকার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। তার পরও আদিবাসীদের সংগঠনগুলোর কোনো কর্মসূচি নেই ভূমি কমিশন আইন সংশোধনী নিয়ে। কিন্তু বাঙালি সংগঠনগুলোর একের পর এক কর্মসূচি দেওয়ার যুক্তি কী? সমস্যাটাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা, নাকি আদিবাসীদের ভূমি বেদখল অব্যাহত রাখা? আদিবাসীদের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত সরকারি হিসাবে এক লাখ ২৭ হাজারের বেশি পরিবার নিজেদের ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। এর মধ্যে ৯০ হাজার আদিবাসী ও ৩৭ হাজার বাঙালি পরিবার রয়েছে। এদের সরকারিভাবে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু আখ্যায়িত করা হয়েছে। এসব অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত থেকে ফিরে আসা ১২ হাজারের বেশি পাহাড়ি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য গঠন করা হয়েছে ‘ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তু পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্স’। টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ি জেলা থেকে নির্বাচিত সরকারি দলের সাংসদ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা একাধিকবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ভূমি সমস্যার সমাধান না হলে তাদের (টাস্কফোর্স) করার কিছুই নেই। কারণ, উদ্বাস্তু এবং শরণার্থীদের প্রধান সমস্যা ভূমি সমস্যা। তারা (উদ্বাস্তু ও শরণার্থী) নিজেদের বাস্তুভিটা ফেরত না পেলে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব নয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটির সঙ্গে অন্যগুলোর সম্পর্ক বিদ্যমান। তার মধ্যে ভূমি সমস্যাটাই প্রধান। ভূমি সমস্যা সমাধান ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান অকল্পনীয়। তাই অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও উন্নয়ন নির্ভর করছে ভূমি সমস্যা সমাধানের ওপর। যত বাধাবিপত্তি আসুক, সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধানে হাত দিতেই হবে। তা না হলে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তির যে কথা বলা হয়, তা হবে মুখের কথা; বাস্তবে কোনো দিন সম্ভব হবে না।
হরি কিশোর চাকমা: সাংবাদিক।
No comments