ঐতিহ্য-গোল্লাছুট প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতা ২০১১ সালে পুরস্কার পাওয়া গল্পগুলো ছাপা হচ্ছে- অবাক অপরাধ by তাবাসসুম ফেরদৌস

খ-বিভাগ: প্রথম এত দিন ঠিকমতোই চলছিল সবকিছু। প্রতিদিন মা মিষ্টি সুরে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াত। জোর করে ধরে ভাত খাওয়াত। হঠাৎ করে কী হলো কে জানে? সবাই কেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাদের এই ছোট্ট শহরটা ছেড়ে সবাই কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। সবার মনে কেমন একটা ভয়।
কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না পাঁচ বছরের শিশু মাহিন। এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সে। দুই-আড়াই মাসের মতো ক্লাসও করেছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর চকলেটের লোভ দেখিয়ে বাবা পড়াতে বসাত। অ, আ, ক, খ অনেকটুকু শিখেও ফেলেছিল সে। তার পাড়ার বন্ধুরা অমৃত, আলম, নিশি, রিনা একে একে সবাই চলে যাচ্ছে। তার বাবা তাকে বলেছে: কিছু দুষ্ট মানুষ নাকি তাদের বাংলা ভাষায় কথা বলতে দিতে চায় না। কথাটা ঠিক বুঝল না মাহিন। বাবা বুঝিয়ে দিলেন: কিছু লোক চায় না যে মাহিন তার প্রিয় অ, আ, ক, খ শিখুক। মাহিন এখানে দোষের কিছু দেখল না। পড়াশোনা করতে তার মোটেও ভালো লাগে না। তার বন্ধুদের সঙ্গে ‘রেলগাড়ি রেলগাড়ি’ খেলতে ও পাতা দিয়ে গাড়ি বানাতেই বেশ লাগে। যদি অ, আ, ক, খ না-ই শিখতে হয়, তবে তো ভালোই হলো। সারা দিন সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারবে। কিন্তু এটা নিয়ে এত ঝামেলা করার কী আছে? এর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তাকে ছেড়ে দাদুর বাড়িতে চলে গিয়েছে। বাবাও প্রতিদিন সন্ধ্যায় চকলেট আনে না। আগে বাবা সারা দিন অফিসে থাকত। এখন সারা দিন বাসায় বসে রেডিও শোনে।
কয়েক দিন পর পর, দূর থেকে বেলুন ফাটানোর মতো আওয়াজ আসে। তখন তার মা ঘরের দরজা-জানালা লাগিয়ে তাকে কোলে নিয়ে বুকে শক্ত করে চেপে ধরে থাকে। মাহিনের যে তখন কী ভালো লাগে! বেলুনটা নিশ্চয়ই অনেক বড়। কত জোরে শব্দ হয়। প্রায় প্রতিদিনই বাসার সামনে দিয়ে মিছিল যায়। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে। অনেক মানুষ থাকে মিছিলে। সে এক থেকে ছেচল্লিশ পর্যন্ত গুনতে পারে। মিছিলে মনে হয় ছেচল্লিশ থেকেও বেশি মানুষ থাকে। মিছিলে মানুষেরা ছোট ছোট ছড়া বলে। সবচেয়ে ছোট ছড়াটি হলো ‘জয় বাংলা’। ছোট বলে এই ছড়াটি তার মুখস্থ হয়ে গেছে। সারা দিন খেলাধুলা, ছড়ার দল আর বেলুনের শব্দ তার খুবই ভালো লাগে। মনে হয়, যদি সব সময় এমন থাকত! কিন্তু মা-বাবার মনে কেন জানি দুঃখ। হয়তো এগুলো তাদের ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। মা এখন তাকে একটা গল্পও শোনায় না। বাবার মুখেও কোনো হাসি নেই। দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাহিন দেখে, তার বাবা বাসায় নেই। মা বিছানার ওপর বসে কাঁদছে। ‘আমাদের ছেড়ে কোথায় গেল বাবা?’ মাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘তোমার বাবা অনেক দূরে গিয়েছে।’
‘কেন?’
‘তোমার জন্য চকলেট আনতে, সোনা।’
মাহিনের খুশি তখন দেখে কে? বাবা নিশ্চয়ই দূর থেকে অনেক মজার মজার চকলেট নিয়ে আসবে। মাহিন ঠিক করেছে, নিশিকে একটা চকলেটও দেবে না। কারণ, কয় দিন আগে সে নিশির কাছে হাওয়াই মিঠাই চেয়েছিল। নিশি তাকে দেয়নি।
অনেক দিন পার হয়ে গেছে। এখনো বাবা চকলেট নিয়ে এল না। অবশ্য এখন আনলেও কোনো লাভ হতো না। নিশি এখনো দাদুর বাড়ি থেকে আসেনি। ওহ্! তোমাদের তো একটা কথা বলতে ভুলেই গিয়েছি। সেই যে মজার মানুষগুলো ছিল না, ওই যে বেলুন ফাটাত, তারা মাহিনদের শহরেও এসে পড়েছে। এখন প্রতিদিন তারা বেলুন ফাটায়। মাহিন শুধু শব্দ শুনেছে। এখনো নিজের চোখে দেখেনি। তারা আসায় একটা সমস্যাও হয়েছে। মা তাকে বাসা থেকে বের হতে দেয় না। এখন সে মিছিলও দেখতে পারে না। শুধু ঘরে বসে শোনে যে মানুষেরা বলছে ‘জয় বাংলা’।
গভীর রাতে দরজায় ঠকঠক শব্দ। মাহিনের ভয় করছে। ভূতটুত এল কি না? মা ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘কে?’
‘আমরা খালাম্মা। মালেক চাচা আমাদের পাঠিয়েছেন।’ দরজার ওপাশ থেকে শোনা গেল। মাহিন চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা পাঠিয়েছে। তাহলে ওদের দিয়েই চকলেট পাঠিয়েছে।’ দরজা খোলার পর দুজন ভেতরে এল। মায়ের সঙ্গে কী জানি কথা হলো ছেলে দুটোর। তারপর ভাত খেয়ে, মাহিনের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করে চলে গেল। সে ছেলেগুলোকে ‘জয় বাংলা’ ছড়াটা শুনিয়ে দিল। শুনে তারা কী খুশি! মাহিনের কপালে চুমো খেল একজন। কিন্তু মাহিনের দুঃখ, সে ছোট বলে তাকে কেউ কিছু বলে না। কিছু বুঝিয়ে দেয় না। বাবা চকলেট আনতে গেছে ভালো কথা। এই ছেলেগুলোর সঙ্গে কেন যাবে? তারা কার জন্য চকলেট আনবে? মা বলল, তারা নাকি মুক্তিযোদ্ধা। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ জিনিসটাই বা কী? মাহিনের খুব রাগ হলো। সে ঠিক করেছে, সে যখন বড় হবে, তখন তাদের দেখে নেবে। তাদের কিছুটি বলবে না। আর যারা ছোট, তাদের সব বুঝিয়ে দেবে। ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর মা মাহিনকে কাছে ডেকে বললেন, ‘ওরা যে এসেছিল, এ কথা কাউকে বোলো না। ঠিক আছে?’ বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল মাহিন, ‘আচ্ছা।’
সবে সন্ধ্যা হলো। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে এর মধ্যেই। মা ভাত রান্না করছে। মাহিন বসে বসে রংচঙে ছবির বই দেখছে। এমন সময় দরজায় আবার শব্দ ঠকঠক। আজও ওই ছেলেরা এল নাকি? ‘মুক্তিযোদ্ধা’ না কী যেন বলে? মাহিন দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। না। দুজন নয়। এবারে অনেকগুলো মানুষ এসেছে। সুন্দর টুপি পরা। এগুলোকেই তাহলে ‘হ্যাট’ বলে? তাদের গায়ে পুলিশের মতো পোশাক। কী সুন্দর দেখতে! সঙ্গে আছেন আসাদ চাচা। ইনিই তো মসজিদে নামাজ পড়ান।
মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এল। মাকে দেখে মনে হলো অনেক ভয় পাচ্ছে। ভয় পাওয়ার কী আছে? তারা কি বিচিত্র ভাষায় কথা বলছে। মাহিন কিছু বুঝতে পারছে না। শুধু একবার তার বাবার নাম শুনল। আসাদ চাচা মাকে বাবার কথা জিগ্যেস করল। মা নিশ্চুপ। এবার সবচেয়ে সুন্দর হ্যাট পরা লোকটি মাকে কী জানি বলল। মাহিন বুঝতে পারেনি। নিশ্চয়ই তারা মাকে কোনো বকা দিয়েছে। কারণ, কথাটি অনেক জোরে বলেছে। আসাদ চাচা বলছে, ‘ভাবি, আমার নাম জানেন তো কী? আরবিতে বলে “আসাদুন”। বাংলা অর্থ সিংহ। আমরা যখন গর্জন করে উঠি, মালেক ভাইয়ের মতো ইন্দুরেরা তখন জান নিয়ে পালায়। হা হা হা...’
আচ্ছা, পুলিশের মতো মানুষগুলোর হাতে এটা কী? মাহিন শুনেছে, এটা দিয়েই তারা বেলুন ফাটায়। কিন্তু বেলুনটাই বা কোথায়? এখানে মনে হয় বেলুন ফাটাবে। কী মজা! খুশিতে হাততালি দিয়ে মাহিন বলে ওঠে, ‘জয় বাংলা’।
কথাটা কেন বলল, মাহিন তা নিজেও জানে না। ‘জয় বাংলা’র অর্থ কী, তাও সে বোঝে না। ইদানীং খুশি হলেই সে ছড়াটা বলে। এটা শুনে হ্যাট পরা পুলিশটা, বেলুনের মেশিনটা উঁচিয়ে তার দিকে ধরল। এখনই বেলুন বের করবে নাকি? খুশিতে আত্মহারা সে। মেশিনে ধরে চাপ দিল পুলিশটা। অবাক চোখে দেখছে মাহিন। কী একটা বিঁধেছে তার বুকে। অনেক জোরে চিৎকার করে উঠল, মা। যন্ত্রণাটুকু টের পাওয়ার সময়ও পেল না সে। শুধু মনে হলো, এটা বড় কালো রঙের বেলুন তার কাছ থেকে পৃথিবীটাকে ঢেকে ফেলছে। মাহিনের কাছ থেকে তার মাকে আলাদা করে দিচ্ছে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাহিন চলে গেল না ফেরার দেশে।
 বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

No comments

Powered by Blogger.