বইপত্র- আন্দালুসিয়ার ঠাকুর by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার বন্ধুভাগ্য ছিল বিরল। সালভাদোর দালি ছিলেন তাঁর এক
বন্ধু, লুইস বুনুয়েল ছিলেন আরেকজন। প্রথমজন ছবি এঁকে দুনিয়া জয় করেছিলেন,
দ্বিতীয়জন ছবি বানিয়ে। আর লোরকা করেছিলেন শব্দে শব্দে ছবি এঁকে। কিন্তু
তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্যও হতো।
বুনুয়েল একবার একটা ছবি বানিয়েছিলেন,
আন্দালুসিয়ার কুকুর নামে এবং লোরকার মনে হয়েছিল, ওই কুকুর বলতে তাঁর দিকেই
ইঙ্গিত করছেন বুনুয়েল। এতে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি নিশ্চয় জানতেন, তাঁর কবিতা একদিন তাঁকে আন্দালুসিয়ার ঠাকুর বানিয়ে ছাড়বে। শুধু আন্দালুসিয়া কেন, সমগ্র স্পেন এবং যত দিন গেল, সমগ্র বিশ্বেরও। ১৯৩৬ সালে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর লোকেরা মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তাঁকে হত্যা করলে বিশ্বের বিবেককে তা নাড়া দেয়। লোরকা হয়ে ওঠেন সুন্দরের, শুভ্রতার, অজেয় জীবনশক্তির পক্ষের এবং অশুভের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের এক প্রতীক এবং সাজ্জাদ শরিফের ভাষায়, ‘কবিতার শহীদ’।
লোরকার কবিতায় নিসর্গ অবারিত—এবং এই নিসর্গ আন্দালুসিয়ার নীলে, সবুজে, কমলায় ও হলুদে ধোয়া দৃশ্য-বর্ণ-স্পর্শ-গন্ধের। এই নিসর্গে সমর্পিত মানুষ। জীবন তাঁর প্রধান উপজীব্য; যদিও মাদ্রিদের মতো শহরের দ্বন্দ্বসংকুল জীবন, আধুনিকতার যন্ত্রশাসন ও যন্ত্রণা, মৃত্যুচিন্তা, দুঃস্বপ্ন—এসবও ছিল তাঁর কবিতায়। তবে তাঁর স্ফূর্তি ছিল আন্দালুসিয়ার জীবন এবং এর লোকজ নানা প্রকাশকে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের অংশ করে তোলাতে। জিপসিদের গান ছিল তাঁর অতিশয় প্রিয়, ছিল তাদের নানা গল্পগাথাও। আন্দালুসিয়ার—এবং গ্রানাডা অঞ্চলের—জীবন ও সংস্কৃতিতে আরব ও পারস্যের প্রভাব পড়েছিল। এসব প্রভাবের মধ্যে ছিল কাসিদা ও হাফিজের দিওয়ারগুলো। লোরকাও কাসিদা লিখেছেন, দিওয়ান লিখেছেন। ফলে তাঁর কবিতা পড়া আর একদিকে রোমান্টিক নানা ঐতিহ্যে এবং অন্যদিকে আধুনিক জীবনের অনিশ্চয়তায় পা রাখা ছিল একই জিনিস। এ জন্য লোরকার কবিতায় দৃশ্যময়তা এতটা স্পষ্ট, শব্দ-গন্ধ-বর্ণের জগৎ এতটা পরিব্যাপ্ত এবং ধ্বনি ও মূর্ছনার অভিঘাত এতটা তীব্র।
ঠিক এ কারণেই লোরকা খুব অনুবাদযোগ্য কবি নন। অনুবাদে তাঁর কবিতার ভাব ঠিক থাকলেও দ্যোতনা, ব্যঞ্জনা, সুর ও ধ্বনি এবং আচ্ছন্ন করা চিত্রময়তা ধরে রাখাটা খুব কঠিন। কাসিদা, গজল বা জিপসিদের গানের ছন্দ ও কাঠামোও হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। আরেক বিপদ আছে তাঁর কবিতা অনুবাদের এবং তা শামসুর রাহমান সম্পাদিত অধুনার ১৯৮৬ সালের একটি সংখ্যায় লোরকার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ প্রকাশের পর ২৩ বছরের কবি সাজ্জাদ শরিফকে আমি যা বলেছিলাম এবং অনেক দিন পর এক মার্কিন কবির একটি কবিতায় যা দেখে বেশ আমোদও পাচ্ছি, আবার বিপদটি সাজ্জাদের ক্ষেত্রে যে খাটবে না, সে বিশ্বাসও যে আমার ছিল:
বিপদটা এই নয় যে তিনি অধিকার করে নেবেন
আমার কবিতাগুলোকে বিপদটা বরং এই যে তিনি যখন তা করবেন আমি জানতেই পারব না,
(মার্ক স্ট্যাটম্যান, ‘গারসিয়া লোরকাকে তর্জমা করা’, ট্যুরিস্ট অ্যাট মিরাকল, ২০১০)
শামসুর রাহমানও বলতেন, লোরকা সে রকম এক কবি—জীবনানন্দ দাশের মতো—যিনি অজান্তে কোনো কবি-অনুবাদককে (জীবনানন্দের ক্ষেত্রে কবি-পাঠককে) দখল করে নেন। তবে সুখের কথা, ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে লোরকার কবিতা তর্জমা করেও সাজ্জাদের কবিতা চলে যায়নি লোরকার হাতে। তবে যা লোরকা আদায় করেছেন, তা সাজ্জাদের সমীহ ও প্রশংসা এবং বোধ করি একধরনের নিষ্ঠা, যা তাঁকে লোরকার ছন্দকে তাঁর তর্জমায় ধরে রাখতে অনুপ্রাণিত করেছে। ফলে তর্জমাটি পড়ে মূলের পূর্ণ স্বাদটা পাওয়া যায়: হাঁটুজলে বসে দুইটি উপত্যকা/
ভারে হেমন্ত কবে আসে কবে আসে।/
গোধূলি গিয়েছে হাতির পদক্ষেপে/
গাছের গুঁড়ি ও শাখা ঠেলে দুই পাশে।
(‘শাখার কাসিদা’)
অথবা, শুধুই তোমার উষ্ণ হূদয়/আর কিছু নয়। (‘ইচ্ছা’)
গারসিয়া মার্কেজকে মূল স্প্যানিশ ভাষায় পড়ার জন্য দুই বছর কসরত করে ভাষাটি সিকি ভাগ রপ্ত করেছিলাম। লাভ হয়েছিল, লোরকাকেও তাঁরই ভাষায় পড়তে পেরেছিলাম। সাজ্জাদের অনুবাদে সেই ভাষাটির অনুরণন শোনা যায়; পড়তে পড়তে চোখ একটুখানি বন্ধ করলে আন্দালুসিয়ার আকাশ-বন অথবা নিউইয়র্কের ‘ডিমের মতো শূন্য চেহারার শিশুদের’ ছবি ভেসে আসে। অনুবাদের এটি এক বড় অর্জন।
কোনো অনুবাদই শ্রেষ্ঠ নয়, কোনো অনুবাদই শেষতম নয়। আমি নিশ্চিত, লোরকার আরও অনুবাদ হবে, চমৎকার অনুবাদ হবে। কিন্তু সে পর্যন্ত লোরকাকে পাওয়া যাবে সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদে। যেভাবে তিনি লোরকার কবিতার মেজাজটা ধরে রেখেছেন, কবিতার কলকবজাকে আয়ত্তে এনে অনুবাদ করেছেন, লোরকার একজন দীর্ঘদিনের পাঠক হিসেবে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে হয় এবং অভিনন্দন জানাতে হয় তথ্যবহুল, বিশ্লেষণী ভূমিকাটির জন্য, যা কবিতাগুলোকে তাদের সময়ের ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে সাহায্য করে।
ধন্যবাদ পেতে পারেন ‘সহূদয়া’ সেই জনস্বাস্থ্যকর্মীও, যাঁর ‘লোরকার জীবন ও সময়’ পাঠকদের লোরকার কবিতার একটা স্বাস্থ্যচিত্র উপহার দেয়।
কিন্তু তিনি নিশ্চয় জানতেন, তাঁর কবিতা একদিন তাঁকে আন্দালুসিয়ার ঠাকুর বানিয়ে ছাড়বে। শুধু আন্দালুসিয়া কেন, সমগ্র স্পেন এবং যত দিন গেল, সমগ্র বিশ্বেরও। ১৯৩৬ সালে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর লোকেরা মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তাঁকে হত্যা করলে বিশ্বের বিবেককে তা নাড়া দেয়। লোরকা হয়ে ওঠেন সুন্দরের, শুভ্রতার, অজেয় জীবনশক্তির পক্ষের এবং অশুভের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের এক প্রতীক এবং সাজ্জাদ শরিফের ভাষায়, ‘কবিতার শহীদ’।
লোরকার কবিতায় নিসর্গ অবারিত—এবং এই নিসর্গ আন্দালুসিয়ার নীলে, সবুজে, কমলায় ও হলুদে ধোয়া দৃশ্য-বর্ণ-স্পর্শ-গন্ধের। এই নিসর্গে সমর্পিত মানুষ। জীবন তাঁর প্রধান উপজীব্য; যদিও মাদ্রিদের মতো শহরের দ্বন্দ্বসংকুল জীবন, আধুনিকতার যন্ত্রশাসন ও যন্ত্রণা, মৃত্যুচিন্তা, দুঃস্বপ্ন—এসবও ছিল তাঁর কবিতায়। তবে তাঁর স্ফূর্তি ছিল আন্দালুসিয়ার জীবন এবং এর লোকজ নানা প্রকাশকে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের অংশ করে তোলাতে। জিপসিদের গান ছিল তাঁর অতিশয় প্রিয়, ছিল তাদের নানা গল্পগাথাও। আন্দালুসিয়ার—এবং গ্রানাডা অঞ্চলের—জীবন ও সংস্কৃতিতে আরব ও পারস্যের প্রভাব পড়েছিল। এসব প্রভাবের মধ্যে ছিল কাসিদা ও হাফিজের দিওয়ারগুলো। লোরকাও কাসিদা লিখেছেন, দিওয়ান লিখেছেন। ফলে তাঁর কবিতা পড়া আর একদিকে রোমান্টিক নানা ঐতিহ্যে এবং অন্যদিকে আধুনিক জীবনের অনিশ্চয়তায় পা রাখা ছিল একই জিনিস। এ জন্য লোরকার কবিতায় দৃশ্যময়তা এতটা স্পষ্ট, শব্দ-গন্ধ-বর্ণের জগৎ এতটা পরিব্যাপ্ত এবং ধ্বনি ও মূর্ছনার অভিঘাত এতটা তীব্র।
ঠিক এ কারণেই লোরকা খুব অনুবাদযোগ্য কবি নন। অনুবাদে তাঁর কবিতার ভাব ঠিক থাকলেও দ্যোতনা, ব্যঞ্জনা, সুর ও ধ্বনি এবং আচ্ছন্ন করা চিত্রময়তা ধরে রাখাটা খুব কঠিন। কাসিদা, গজল বা জিপসিদের গানের ছন্দ ও কাঠামোও হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। আরেক বিপদ আছে তাঁর কবিতা অনুবাদের এবং তা শামসুর রাহমান সম্পাদিত অধুনার ১৯৮৬ সালের একটি সংখ্যায় লোরকার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ প্রকাশের পর ২৩ বছরের কবি সাজ্জাদ শরিফকে আমি যা বলেছিলাম এবং অনেক দিন পর এক মার্কিন কবির একটি কবিতায় যা দেখে বেশ আমোদও পাচ্ছি, আবার বিপদটি সাজ্জাদের ক্ষেত্রে যে খাটবে না, সে বিশ্বাসও যে আমার ছিল:
বিপদটা এই নয় যে তিনি অধিকার করে নেবেন
আমার কবিতাগুলোকে বিপদটা বরং এই যে তিনি যখন তা করবেন আমি জানতেই পারব না,
(মার্ক স্ট্যাটম্যান, ‘গারসিয়া লোরকাকে তর্জমা করা’, ট্যুরিস্ট অ্যাট মিরাকল, ২০১০)
শামসুর রাহমানও বলতেন, লোরকা সে রকম এক কবি—জীবনানন্দ দাশের মতো—যিনি অজান্তে কোনো কবি-অনুবাদককে (জীবনানন্দের ক্ষেত্রে কবি-পাঠককে) দখল করে নেন। তবে সুখের কথা, ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে লোরকার কবিতা তর্জমা করেও সাজ্জাদের কবিতা চলে যায়নি লোরকার হাতে। তবে যা লোরকা আদায় করেছেন, তা সাজ্জাদের সমীহ ও প্রশংসা এবং বোধ করি একধরনের নিষ্ঠা, যা তাঁকে লোরকার ছন্দকে তাঁর তর্জমায় ধরে রাখতে অনুপ্রাণিত করেছে। ফলে তর্জমাটি পড়ে মূলের পূর্ণ স্বাদটা পাওয়া যায়: হাঁটুজলে বসে দুইটি উপত্যকা/
ভারে হেমন্ত কবে আসে কবে আসে।/
গোধূলি গিয়েছে হাতির পদক্ষেপে/
গাছের গুঁড়ি ও শাখা ঠেলে দুই পাশে।
(‘শাখার কাসিদা’)
অথবা, শুধুই তোমার উষ্ণ হূদয়/আর কিছু নয়। (‘ইচ্ছা’)
গারসিয়া মার্কেজকে মূল স্প্যানিশ ভাষায় পড়ার জন্য দুই বছর কসরত করে ভাষাটি সিকি ভাগ রপ্ত করেছিলাম। লাভ হয়েছিল, লোরকাকেও তাঁরই ভাষায় পড়তে পেরেছিলাম। সাজ্জাদের অনুবাদে সেই ভাষাটির অনুরণন শোনা যায়; পড়তে পড়তে চোখ একটুখানি বন্ধ করলে আন্দালুসিয়ার আকাশ-বন অথবা নিউইয়র্কের ‘ডিমের মতো শূন্য চেহারার শিশুদের’ ছবি ভেসে আসে। অনুবাদের এটি এক বড় অর্জন।
কোনো অনুবাদই শ্রেষ্ঠ নয়, কোনো অনুবাদই শেষতম নয়। আমি নিশ্চিত, লোরকার আরও অনুবাদ হবে, চমৎকার অনুবাদ হবে। কিন্তু সে পর্যন্ত লোরকাকে পাওয়া যাবে সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদে। যেভাবে তিনি লোরকার কবিতার মেজাজটা ধরে রেখেছেন, কবিতার কলকবজাকে আয়ত্তে এনে অনুবাদ করেছেন, লোরকার একজন দীর্ঘদিনের পাঠক হিসেবে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে হয় এবং অভিনন্দন জানাতে হয় তথ্যবহুল, বিশ্লেষণী ভূমিকাটির জন্য, যা কবিতাগুলোকে তাদের সময়ের ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে সাহায্য করে।
ধন্যবাদ পেতে পারেন ‘সহূদয়া’ সেই জনস্বাস্থ্যকর্মীও, যাঁর ‘লোরকার জীবন ও সময়’ পাঠকদের লোরকার কবিতার একটা স্বাস্থ্যচিত্র উপহার দেয়।
No comments