ফেয়ারলি হাউসের বাগান by দ্বিজেন শর্মা
পরীবাগের এই বাগানটির পুবপাশের একটি গাছে জেঁকে বসা নীলমণি লতাটি বছর বছর
বাসন্তী প্রস্ফুটনের নীলিমাবন্যায় বৃথাই পথিকদের অন্দরমহলে আমন্ত্রণ জানাত,
কেননা রিভার-স্টিমার কোম্পানির এই নিজস্ব চৌহদ্দিতে সাধারণের প্রবেশ
নিষিদ্ধ ছিল।
১৯৬৫ সালে আমার জন্য এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল নটর ডেম কলেজের
অধ্যাপক ফাদার জেমস বেনাসের বদৌলতে। ক্ষণিকের সেই দেখা আজও মনে আছে: পথের
পাশে ও অন্যত্র বড় বড় আমগাছ, মাঝখানে চওড়া লন, চৌচালা ঘরের পোর্টিকোর গায়ে
সেঁধে থাকা মস্ত বাগানবিলাস, দূরে জ্যাকারান্ডা, কুরচি ও কাঠগোলাপ,
আঁকাবাঁকা কেয়ারিতে সুবিন্যস্ত গুল্মসজ্জা—নিটোল এক ইংলিশ হোম-গার্ডেন,
অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপিং। মালিক না থাকায় বাগান সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেল
না।
প্রকৃতি-লেখক মোকারম হোসেন সম্ভবত ২০০৫ সালের কোনো একসময় বাগান-বিষয়ক একটি বইয়ের মালমসলার খোঁজে অনেক কষ্টে ফেয়ারলি হাউসে ঢোকার অনুমতি জোগাড় করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। দেখলাম, বাগানটি আগের মতোই আছে, তবে অযত্নে মলিন। বাড়ির লোকেরা কেউই এই হাউস-উদ্যানের ইতিবৃত্ত জানাতে পারলেন না। কয়েক দিন পর আমেনে ইস্পাহানির সঙ্গে দেখা, তাঁকে চিনি অনেক দিন তাঁদের গার্ডেন ক্লাবে যাতায়াতের সুবাদে। ফেয়ারলি হাউসের বাগান দেখার কাহিনি তাঁকে বললাম এবং তিনি তথ্যাদি জোগাড়ের আশ্বাস দিলেন। বলা প্রয়োজন, তখনো এই ভবনের পুবপাশের একাংশ নতুন ফুটপাত তৈরিতে লোপাট হয়নি, নীলমণি লতাটিও বহাল ছিল।
আমেনে বর্তমানে ইংল্যান্ডবাসী মাইকেল হিল্ডকে চিঠি লিখলেন, যিনি একদা ফেয়ারলি হাউসে থাকতেন। ব্যবসাসূত্রে আমেনের স্বামী আলীযুন ইস্পাহানির সঙ্গে মাইকেলের যোগাযোগ ছিল, ছিল বন্ধুত্ব ও যাতায়াত। উত্তর এল দ্রুত। লিখেছেন, মাইকেলের স্ত্রী মার্গারেট হিল্ড স্বামীর জবানিতে, কারণ মাইকেল বার্ধক্যে লেখালেখিতে অশক্ত।
সৌজন্যকথন ও কিছু স্মৃতিচারণা শেষে মার্গারেট লিখেছেন: ‘খাজা শাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে পুরোনো জয়েন্ট রিভার কোম্পানির কেনা পরীবাগের আমবাগানে ১৯৫০ সালে বাড়িটি বানান টেড বেরি। বাগানের নকশা তৈরিতে তিনি কলকাতার হর্টিকালচারাল গার্ডেনসের সাহায্য নিয়েছিলেন। ঘর পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে অ্যাভিনিউর আদলে আমগাছের একটি সারি রেখে দেওয়া হয়েছিল, আরও কয়েকটি বাগানের অংশ হিসেবে। মাইকেল এ বাড়িতে আসে ১৯৫৪ সালে এবং বাগানটি নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলে, যা আপনারা ষাটের দশকে দেখে থাকবেন।
‘বাগানের সরলরৈখিক জ্যামিতিক গড়ন বদলে ঋজু ঘোরালো কেয়ারিতে লাগানো হয় নানা জাতের গুল্ম এবং ফাঁকে ফাঁকে কলাবতী ও মৌসুমি ফুল। মাঝখানের এক একর আয়তনের লনের একপাশে আমগাছের তলার ছোট একটি সুইমিংপুল ঘিরে ছিল অনেকটা বাঁধানো জায়গা। মাইকেল নানা রঙের বাগানবিলাস লাগিয়ে সেগুলো গাছে তুলে দেয়। লনের পাশে ছিল চিতাফুলের একটি কেয়ারি, লালচে কুন্দ, নীলমণিলতা ও গন্ধরাজ। আরও ছিল জ্যাকারান্ডা, কৃষ্ণচূড়াসহ কিছু বড় বড় ফুলগাছ। গোটা এলাকা ঘিরে ছিল উঁচু দেয়ালের আড়াল।’
মার্গারেটকে পাঠানো চিঠিতে আমেনে লিখেছিলেন, ‘ঢাকা এখন বহুতল ভবন ও ফ্ল্যাটবাড়ির এক জেল্লাদার মহানগর। বাংলোবাড়ি ও বাগান অতীতের দূরস্মৃতি।’ সব উন্নয়নশীল দেশেই আজ এ এক অনিবার্য বাস্তবতা। ভালো কি মন্দ বলা কঠিন। কষ্টটা শুধু বয়স্ক প্রজন্মের। ‘যা হবার তা হবে/ যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে।’ এটুকুই আপাতত সান্ত্বনা।
প্রকৃতি-লেখক মোকারম হোসেন সম্ভবত ২০০৫ সালের কোনো একসময় বাগান-বিষয়ক একটি বইয়ের মালমসলার খোঁজে অনেক কষ্টে ফেয়ারলি হাউসে ঢোকার অনুমতি জোগাড় করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। দেখলাম, বাগানটি আগের মতোই আছে, তবে অযত্নে মলিন। বাড়ির লোকেরা কেউই এই হাউস-উদ্যানের ইতিবৃত্ত জানাতে পারলেন না। কয়েক দিন পর আমেনে ইস্পাহানির সঙ্গে দেখা, তাঁকে চিনি অনেক দিন তাঁদের গার্ডেন ক্লাবে যাতায়াতের সুবাদে। ফেয়ারলি হাউসের বাগান দেখার কাহিনি তাঁকে বললাম এবং তিনি তথ্যাদি জোগাড়ের আশ্বাস দিলেন। বলা প্রয়োজন, তখনো এই ভবনের পুবপাশের একাংশ নতুন ফুটপাত তৈরিতে লোপাট হয়নি, নীলমণি লতাটিও বহাল ছিল।
আমেনে বর্তমানে ইংল্যান্ডবাসী মাইকেল হিল্ডকে চিঠি লিখলেন, যিনি একদা ফেয়ারলি হাউসে থাকতেন। ব্যবসাসূত্রে আমেনের স্বামী আলীযুন ইস্পাহানির সঙ্গে মাইকেলের যোগাযোগ ছিল, ছিল বন্ধুত্ব ও যাতায়াত। উত্তর এল দ্রুত। লিখেছেন, মাইকেলের স্ত্রী মার্গারেট হিল্ড স্বামীর জবানিতে, কারণ মাইকেল বার্ধক্যে লেখালেখিতে অশক্ত।
সৌজন্যকথন ও কিছু স্মৃতিচারণা শেষে মার্গারেট লিখেছেন: ‘খাজা শাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে পুরোনো জয়েন্ট রিভার কোম্পানির কেনা পরীবাগের আমবাগানে ১৯৫০ সালে বাড়িটি বানান টেড বেরি। বাগানের নকশা তৈরিতে তিনি কলকাতার হর্টিকালচারাল গার্ডেনসের সাহায্য নিয়েছিলেন। ঘর পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে অ্যাভিনিউর আদলে আমগাছের একটি সারি রেখে দেওয়া হয়েছিল, আরও কয়েকটি বাগানের অংশ হিসেবে। মাইকেল এ বাড়িতে আসে ১৯৫৪ সালে এবং বাগানটি নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলে, যা আপনারা ষাটের দশকে দেখে থাকবেন।
‘বাগানের সরলরৈখিক জ্যামিতিক গড়ন বদলে ঋজু ঘোরালো কেয়ারিতে লাগানো হয় নানা জাতের গুল্ম এবং ফাঁকে ফাঁকে কলাবতী ও মৌসুমি ফুল। মাঝখানের এক একর আয়তনের লনের একপাশে আমগাছের তলার ছোট একটি সুইমিংপুল ঘিরে ছিল অনেকটা বাঁধানো জায়গা। মাইকেল নানা রঙের বাগানবিলাস লাগিয়ে সেগুলো গাছে তুলে দেয়। লনের পাশে ছিল চিতাফুলের একটি কেয়ারি, লালচে কুন্দ, নীলমণিলতা ও গন্ধরাজ। আরও ছিল জ্যাকারান্ডা, কৃষ্ণচূড়াসহ কিছু বড় বড় ফুলগাছ। গোটা এলাকা ঘিরে ছিল উঁচু দেয়ালের আড়াল।’
মার্গারেটকে পাঠানো চিঠিতে আমেনে লিখেছিলেন, ‘ঢাকা এখন বহুতল ভবন ও ফ্ল্যাটবাড়ির এক জেল্লাদার মহানগর। বাংলোবাড়ি ও বাগান অতীতের দূরস্মৃতি।’ সব উন্নয়নশীল দেশেই আজ এ এক অনিবার্য বাস্তবতা। ভালো কি মন্দ বলা কঠিন। কষ্টটা শুধু বয়স্ক প্রজন্মের। ‘যা হবার তা হবে/ যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে।’ এটুকুই আপাতত সান্ত্বনা।
No comments