অভিমত-বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষায় নিঃস্বার্থ ভূমিকা by বেগম খালেদা জিয়া

ওয়াশিংটন টাইমস সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রচার সংখ্যার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন পোস্ট ষষ্ঠ স্থানে কিন্তু ওয়াশিংটন টাইমসের অবস্থান প্রথম ১০০
দৈনিকের মধ্যেও নেই।
৩০ জানুয়ারি ২০১৩ ওই পত্রিকার ওপিনিয়ন পেইজে ছাপা হওয়া ১০টি লেখার মধ্যে অনলাইন সংস্করণে বেগম খালেদা জিয়ার লেখাটি ১০ নম্বর স্থানে প্রদর্শিত হচ্ছে। পত্রিকা হিসেবে ওয়াশিংটন টাইমসের সম্পাদকীয় নীতি 'কনজারভেটিভ'।
ওয়াশিংটন টাইমসের তহবিল জুগিয়ে থাকে ইউনিফিকেশন চার্চ নামে একটি খ্রিস্টান ধর্মীয় আন্দোলন।
১৯৯৮ সালে মিসরীয় দৈনিক আল-আহরাম ওয়াশিংটন টাইমসের সমালোচনা করে লিখেছিল, পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি অন্ধভাবে অ্যান্টি-আরব, অ্যান্টি-মুসলিম এবং প্রো-ইসরায়েল
তথ্যসূত্র :
http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_newspapers_in_the_United_States_by_circulation
http://en.wikipedia.org/wiki/The_Washington_Times


বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০১৩ সাল কি সন্ধিক্ষণ হতে চলেছে? ভারত এবং মিয়ানমারের মাঝামাঝি অঞ্চলে অবস্থিত ১৫ কোটি মানুষের আমার দেশটি ১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে বিশ্বের যে ক'টি দেশ প্রথমদিকে স্বীকৃতি দেয়, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। তা সত্ত্ব্বেও গত বছরগুলোতে দু'দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন এমন এক পর্যায়ে পেঁৗছে, যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চেষ্টতাকে দায়ী করা যায়। কারণ বাংলাদেশের গণতন্ত্র যখন দুর্বল হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক যখন অন্যান্য উদীয়মান বিশ্বশক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র এটা চেয়ে চেয়ে দেখছে।
এর অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার, কংগ্রেস বা তাদের এজেন্সিগুলো এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই পালন করেনি। ছয় মাস আগে বিশ্বব্যাংক ৪০ বছরের মধ্যে একক বৃহত্তম বাংলাদেশের অবকাঠামোগত প্রকল্প চার মাইল দীর্ঘ সেতু প্রকল্প থেকে প্রায় দু'শ' কোটি ডলারের অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং মন্ত্রণালয় পর্যায়ে প্রকল্পের অর্থ নয়ছয় করা ও দুর্নীতির জন্য তদন্তের দাবি করেছে।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের সদস্যরা গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণের কারণে বাংলাদেশে সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিন্দা করেছেন। কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করার ক্ষেত্রে অবদান রাখা ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকও নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। তাকে অপসারণের কারণ কী? অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, পুরস্কারটি একজন ভুল ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে :'যদি বাংলাদেশে কেউ নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন, তাহলে তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।'
শেখ হাসিনা এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য_ এ ধরনের দাবির সঙ্গে অধিকাংশ বাংলাদেশিই একমত হবেন না। পুলিশের আধাসামরিক শাখা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিখোঁজ হওয়া ৩শ'র মতো ব্যক্তির পরিবারের কাছে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করুন। অথবা খুন হওয়া শ্রমিকদের অধিকারের প্রবক্তা আমিনুল ইসলামের পরিবারের কথাই বিবেচনা করুন। তার হত্যাকাণ্ডের পর আইএফএল-সিআইও যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সুবিধা বাতিলের জন্য প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানকার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংসতায় সংশ্লিষ্টতার দায়ে যেসব রাজনৈতিক নেতা ও তাদের সমর্থকদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তারাও শেখ হাসিনার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।
শুধু বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে এ বিচার করার জন্য যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের দূত হাসিনা সরকারের নিন্দা করেছেন। গত ডিসেম্বর মাসে ইকোনমিস্টে প্রকাশিত ফাঁস হওয়া ই-মেইল ও ফোনালাপও প্রমাণ করে, এ বিচার নিয়ে হাসিনা সরকার কী ধরনের কুকর্ম করেছে এবং তারা কীভাবে হাসিনার রাজনৈতিক বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাঁয়তারা করছে!
চাঁচাছোলা সত্যটা হলো, বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক দেশের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে দ্রুত একটি পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতা-কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। নির্বাচনের আগে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অপরিহার্যতাকে তুলে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। অথচ এ ধরনের ব্যবস্থা প্রচলনে তার অবদান ছিল। এই অদলীয় সরকার ব্যবস্থা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে।
নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিশ্চয়তা দিয়ে আসছে। যদি ভোটাররা নতুন সরকারের জন্য ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তবেই ক্ষমতার হাতবদল ঘটে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার পরও হাসিনা তার অবস্থানে অটল রয়েছেন। তার বিশ্বাস, জনপ্রিয় বিরোধী দল যতই তার বিরোধিতা করুক না কেন, তিনি এভাবে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন।
পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার সফর করে দেশটির একঘরে অবস্থা দূর করেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ যদি একটি পরিবারের শাসনে আটকা পড়ে, তাহলে তা হবে গোটা অঞ্চলের জন্যই পশ্চাৎপদতার দিকে যাত্রা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখন পরিপূর্ণ সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল হয়ে উঠতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতার বাণী নিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বলেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে জনগণ ব্যালটবাক্সের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ লাভ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা, যেমন ব্রিটেন ভোটারদের মতামতের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের ওপর চাপ খাটাতে পারে। বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের পথ থেকে পিছলে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য এসব দেশের বক্তব্য ও পদক্ষেপ আরও শক্তিশালী হওয়া উচিত। দারিদ্র্য দূরীকরণে মুহাম্মদ ইউনূস যে ভূমিকা রেখেছেন, তার জন্য মার্কিন কংগ্রেস ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে তার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে। শেখ হাসিনা অবশ্য এ ধরনের স্বীকৃতির জন্য লালায়িত।
এসব দেশকে শেখ হাসিনার কাছে স্পষ্ট করতে হবে যে, যারা শ্রমিক অধিকারকে সমর্থন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করেন, তাদেরকে যদি তাদের মতপ্রকাশ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রদত্ত সুবিধা তুলে নেওয়া হবে। এ সরকারের যারা গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে, বাক-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, তাদের ভ্রমণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার বিষয়টি পশ্চিমা শক্তিগুলোকে বিবেচনা করা উচিত। তাদের এসব কাজ খোলাখুলিভাবেই করতে হবে, যাতে আমাদের দেশের মানুষ জানতে পারেন, বুঝতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বে তার গণতান্ত্রিক মিশনে ব্যাপৃত আছে, এভাবেই সেটা নিশ্চিত করতে পারে।
কথায় বলে_ আইন-আদালতের চেয়ে বড় হচ্ছে মানুষের বিবেকের আদালত। বিবেকের দায়বদ্ধতা নিয়ে বলা চলে না যে, শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। উপরন্তু এসবই রয়েছে ভয়ানক বিপদের মধ্যে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বের পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।

বেগম খালেদা জিয়া :বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা; দ্য ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধের ভাষান্তর

No comments

Powered by Blogger.