হরতালের সংঘাতে নিহত ৫-বগুড়ায় জামায়াত-শিবিরের তিন নেতা-কর্মী মণিরামপুরে এক পুলিশ, ফেনীতে অটোরিকশার চালক নিহত
জামায়াতে ইসলামীর ডাকা গতকাল
বৃহস্পতিবারের হরতাল চলাকালে বগুড়ায় পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে
সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরের তিন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। ১০ শিবিরকর্মী
গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।
দফায় দফায় চলা
ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও গোলাগুলিতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বগুড়া শহর। এর
প্রতিবাদে আগামীকাল শনিবার বগুড়ায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াত।
যশোরের মণিরামপুরে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় অসুস্থ হয়ে এক
পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। ফেনীতে পিকেটারদের ধাওয়া খেয়ে সিএনজি অটোরিকশা
উল্টে নিহত হয়েছেন এর চালক। এ ছাড়া হরতালে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা,
রংপুর, কঙ্বাজার, লক্ষ্মীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর,
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর,
অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলা এবং পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে হরতাল
সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের অন্তত ৬৬ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল ও জামায়াতের আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে ঢাকায় গত বুধবার সমাবেশ করতে চেয়েছিল জামায়াত-শিবির। অনুমতি না পেয়ে ওই দিনই গতকালের হরতালের ঘোষণা দেয় তারা। ঢাকা ও চট্টগ্রামে আধাবেলা এবং সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যার এ হরতালে সমর্থন জানায় বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট।
বগুড়া রণক্ষেত্র : হরতাল সফল করতে গতকাল ভোর থেকে মাঠে নামে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। দুপুর থেকে পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কয়েক দফা সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন সরকারি আযিযুল হক কলেজ পুরাতন ভবন শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু রোহানী (২২), শিবিরকর্মী আবদুল্লাহ (২০) ও জামায়াতকর্মী মিজানুর রহমান মিজান (২৮)। রোহানী আযিযুল হক কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আবদুল্লাহ ওই কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ও শহরের স্টেডিয়াম শাখা শিবিরের কর্মী। আর জামায়াতকর্মী মিজান শহরতলির সাবগ্রাম বাজারের মুরগির খামারের মালিক।
এদিকে সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় বিজিবি সদস্যদের তলব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বগুড়ার জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদ। তিনি জানান, প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল থেকেই শিবিরের নেতা-কর্মীরা শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় মহিলা কলেজের সামনে পিকেটিং করছিল। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একদল ছাত্রলীগকর্মী ওই পথ দিয়ে সরকারি আযিযুল হক কলেজের পুরাতন ভবনে যাচ্ছিল। মহিলা কলেজ এলাকায় পৌঁছালে শিবিরকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেয়। ধাওয়া খেয়ে তারা কলেজ এলাকায় গিয়ে সংগঠিত হয়ে শিবিরকে পাল্টা ধাওয়া দেয়। তখন শিবিরের নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পাঁচ শিবিরকর্মীকে ধরে উপর্যুপরি মারধর ও কুপিয়ে আহত করা হয়। স্থানীয় লোকজন আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর শিবিরের নেতা আবু রোহানী মারা যান।
এদিকে শহরতলির সাবগ্রাম এলাকায় দুপুর পৌনে ১টার দিকে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল শেষে চলে যাওয়ার পর সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা সেখানে গিয়ে জামায়াতকর্মীদের খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে সেখানে তারা মিজানুর রহমান মিজানকে পেয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। শহর জামায়াতের সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান জুয়েল দাবি করেন, নিহত মিজান তাঁদের কর্মী। পিকেটিং করার কারণে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকর্মীরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে বলে তাঁর দাবি।
এরপর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জামায়াত-শিবির মিছিল নিয়ে শহরে ঢুকতে গেলে গোহাইল রোডে পুলিশ বাধা দেয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে উপর্যুপরি গোলাগুলি, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ পিছু হটলে শহরের সাতমাথা চত্বর জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন তারা বেসরকারি টিভি চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধি রউফ জালালসহ পাঁচজনের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয়। একই সময় শেরপুর রোডের বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এসে গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়। তারা আবার গোহাইল রোডের জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে ধাওয়া খেয়ে স্টেশন রোডে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
এক পর্যায়ে তারা সরকারি আযিযুল হক কলেজ নতুন ভবনের সামনে গিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করে। কলেজের দক্ষিণ পাশে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত জুয়েল ভিলা-২ নামের এক ছাত্রাবাসে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে হামলাকারীদের ধাওয়া করতে গেলে আবার সংঘর্ষ বাধে। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও গুলিবিনিময় হয়। পুলিশের গুলিতে শিবিরের অন্তত ১০ নেতা-কর্মী আহত হয়। তাদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর গুলিবিদ্ধ শিবিরকর্মী আবদুল্লাহ নিহত হন।
এদিকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিবিরকর্মী নিহত হওয়ার খবর পেয়ে শিবিরের নেতা-কর্মীরা মেডিক্যাল কলেজে গেলে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। সেখান থেকে অন্তত ২০ শিবিরকর্মীকে আটক করে পুলিশ।
বগুড়া শহর জামায়াতের সেক্রেটারি জুয়েল বলেন, পরিকল্পিতভাবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা শিবিরের দুজন ও জামায়াতের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এ ছাড়া অর্ধশত নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে। হত্যাকাণ্ড ও গুলির প্রতিবাদে আগামীকাল বগুড়ায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মোজাম্মেল হক বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবার থেকে মামলা দায়ের করা হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। তবে প্রতিবাদের নামে শহরজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে জামায়াত-শিবির। তাদের হটিয়ে দিতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে।
মণিরামপুরে পুলিশ সদস্যের মৃত্যু : যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ধানোহাটা মোড়ে পুলিশের সঙ্গে শিবিরকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে অসুস্থ হয়ে জহুরুল ইসলাম (৫৫) নামের এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ১৫ জন। আটক করা হয়েছে চার শিবিরকর্মীকে। নিহত পুলিশ সদস্যের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার কামালপোতা গ্রামে। দুই মাস পর তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল পৌনে ৬টার দিকে শতাধিক শিবিরকর্মী লাঠিসোঁটা, রামদা ও দেশীয় অস্ত্র হাতে 'জয় বাংলা' স্লোগান দিতে দিতে ছয়-সাতটি নছিমনে করে নওয়াপাড়া-জয়পুর সড়ক হয়ে ধানোহাটা মেড়ে আসে। তাদের প্রায় সবারই পরনে জিন্সের প্যান্ট ও গায়ে জ্যাকেট ছিল। ধানোহাটা মোড়ে পৌঁছেই তারা স্লোগান পরিবর্তন করে 'নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর' ধ্বনিতে জঙ্গি মিছিল শুরু করে এবং ১৫-২০টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। মিছিল থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবি করা হয়।
পুলিশ জানায়, মণিরামপুর থানা থেকে ছয় পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে পৌঁছা মাত্রই শিবিরকর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার এক পর্যায়ে পুলিশ কনস্টেবল জহুরুল ইসলাম (৫৫) পড়ে যান। আহত হন আরো দুজন। জহুরুলকে প্রথমে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে যশোর পুলিশ লাইন হাসপাতাল ও পরে যশোর সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
মণিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আশরাফুল ইসলাম আরিফ বলেন, 'পুলিশ সদস্য জহুরুলের ইনজুরি ছিল সামান্য। তবে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। যশোরে রেফার করা হলে পথিমধ্যে তিনি মারা যান।'
মণিরামপুর থানার ওসি আলী আজম জানান, খবর পেয়ে থানা ও স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তখনো শিবিরকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও কাচের বোতল ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগকর্মীরা এসে শিবিরকর্মীদের ধাওয়া দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ ৩০টি শটগানের গুলি ও ছয়টি টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে বলে জানান তিনি।
ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত উপপরিদর্শক জামিরুল ইসলাম বলেন, 'জহুরুল আমার সঙ্গেই ছিলেন। ইটের আঘাতে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যান।' পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্র বলেন, জহুরুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
আহত শিবিরকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনার বিভিন্ন কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র। মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে তারা মণিরামপুরে জড়ো হয়েছিল।
এদিকে মণিরামপুর উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, 'সকালে আমরা হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে জামায়াত নেতা নূর মোহাম্মদ ও শিবিরকর্মী মোবারক হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ আমাদের ২০ জন নেতা-কর্মীকে আটক করেছে।'
ফেনীতে পিকেটারদের ধাওয়ায় একজন নিহত : শহরের খাজুরিয়া রাস্তার মাথায় পিকেটারদের ধাওয়া খেয়ে পালাতে গিয়ে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক নিহত হয়েছেন। নিহত ইমন উদ্দিনের (২৪) বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শিলরি গ্রামে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল ১০টার দিকে ফেনী শহরের পাঠানবাড়ী রাস্তার মাথা থেকে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে ইমন সদর উপজেলার শর্শদি যাচ্ছিলেন। তাঁর গাড়িটি খাজুরিয়া রাস্তার মাথায় গেলে পিকেটাররা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এ সময় দ্রুত পালাতে গিয়ে গাড়িটি রাস্তার পাশে একটি বড় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। এতে চালক ইমন গুরুতর এবং তিন যাত্রী সামান্য আহত হন।
ফেনী থানার ওসি মো. মাইনুল আবসার জানান, ইমনকে আশপাশের লোকজন ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে দুপুর আড়াইটার দিকে তিনি মারা যান। বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের অন্তত ৬৬ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল ও জামায়াতের আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে ঢাকায় গত বুধবার সমাবেশ করতে চেয়েছিল জামায়াত-শিবির। অনুমতি না পেয়ে ওই দিনই গতকালের হরতালের ঘোষণা দেয় তারা। ঢাকা ও চট্টগ্রামে আধাবেলা এবং সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যার এ হরতালে সমর্থন জানায় বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট।
বগুড়া রণক্ষেত্র : হরতাল সফল করতে গতকাল ভোর থেকে মাঠে নামে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। দুপুর থেকে পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কয়েক দফা সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে নিহত ব্যক্তিরা হলেন সরকারি আযিযুল হক কলেজ পুরাতন ভবন শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু রোহানী (২২), শিবিরকর্মী আবদুল্লাহ (২০) ও জামায়াতকর্মী মিজানুর রহমান মিজান (২৮)। রোহানী আযিযুল হক কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আবদুল্লাহ ওই কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ও শহরের স্টেডিয়াম শাখা শিবিরের কর্মী। আর জামায়াতকর্মী মিজান শহরতলির সাবগ্রাম বাজারের মুরগির খামারের মালিক।
এদিকে সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় বিজিবি সদস্যদের তলব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বগুড়ার জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদ। তিনি জানান, প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল থেকেই শিবিরের নেতা-কর্মীরা শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় মহিলা কলেজের সামনে পিকেটিং করছিল। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একদল ছাত্রলীগকর্মী ওই পথ দিয়ে সরকারি আযিযুল হক কলেজের পুরাতন ভবনে যাচ্ছিল। মহিলা কলেজ এলাকায় পৌঁছালে শিবিরকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেয়। ধাওয়া খেয়ে তারা কলেজ এলাকায় গিয়ে সংগঠিত হয়ে শিবিরকে পাল্টা ধাওয়া দেয়। তখন শিবিরের নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পাঁচ শিবিরকর্মীকে ধরে উপর্যুপরি মারধর ও কুপিয়ে আহত করা হয়। স্থানীয় লোকজন আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর শিবিরের নেতা আবু রোহানী মারা যান।
এদিকে শহরতলির সাবগ্রাম এলাকায় দুপুর পৌনে ১টার দিকে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল শেষে চলে যাওয়ার পর সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা সেখানে গিয়ে জামায়াতকর্মীদের খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে সেখানে তারা মিজানুর রহমান মিজানকে পেয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। শহর জামায়াতের সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান জুয়েল দাবি করেন, নিহত মিজান তাঁদের কর্মী। পিকেটিং করার কারণে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকর্মীরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে বলে তাঁর দাবি।
এরপর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জামায়াত-শিবির মিছিল নিয়ে শহরে ঢুকতে গেলে গোহাইল রোডে পুলিশ বাধা দেয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে উপর্যুপরি গোলাগুলি, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ পিছু হটলে শহরের সাতমাথা চত্বর জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন তারা বেসরকারি টিভি চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধি রউফ জালালসহ পাঁচজনের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয়। একই সময় শেরপুর রোডের বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এসে গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়। তারা আবার গোহাইল রোডের জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে ধাওয়া খেয়ে স্টেশন রোডে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
এক পর্যায়ে তারা সরকারি আযিযুল হক কলেজ নতুন ভবনের সামনে গিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করে। কলেজের দক্ষিণ পাশে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত জুয়েল ভিলা-২ নামের এক ছাত্রাবাসে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে হামলাকারীদের ধাওয়া করতে গেলে আবার সংঘর্ষ বাধে। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও গুলিবিনিময় হয়। পুলিশের গুলিতে শিবিরের অন্তত ১০ নেতা-কর্মী আহত হয়। তাদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর গুলিবিদ্ধ শিবিরকর্মী আবদুল্লাহ নিহত হন।
এদিকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিবিরকর্মী নিহত হওয়ার খবর পেয়ে শিবিরের নেতা-কর্মীরা মেডিক্যাল কলেজে গেলে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। সেখান থেকে অন্তত ২০ শিবিরকর্মীকে আটক করে পুলিশ।
বগুড়া শহর জামায়াতের সেক্রেটারি জুয়েল বলেন, পরিকল্পিতভাবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা শিবিরের দুজন ও জামায়াতের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এ ছাড়া অর্ধশত নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে। হত্যাকাণ্ড ও গুলির প্রতিবাদে আগামীকাল বগুড়ায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মোজাম্মেল হক বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবার থেকে মামলা দায়ের করা হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। তবে প্রতিবাদের নামে শহরজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে জামায়াত-শিবির। তাদের হটিয়ে দিতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে।
মণিরামপুরে পুলিশ সদস্যের মৃত্যু : যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ধানোহাটা মোড়ে পুলিশের সঙ্গে শিবিরকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে অসুস্থ হয়ে জহুরুল ইসলাম (৫৫) নামের এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ১৫ জন। আটক করা হয়েছে চার শিবিরকর্মীকে। নিহত পুলিশ সদস্যের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার কামালপোতা গ্রামে। দুই মাস পর তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল পৌনে ৬টার দিকে শতাধিক শিবিরকর্মী লাঠিসোঁটা, রামদা ও দেশীয় অস্ত্র হাতে 'জয় বাংলা' স্লোগান দিতে দিতে ছয়-সাতটি নছিমনে করে নওয়াপাড়া-জয়পুর সড়ক হয়ে ধানোহাটা মেড়ে আসে। তাদের প্রায় সবারই পরনে জিন্সের প্যান্ট ও গায়ে জ্যাকেট ছিল। ধানোহাটা মোড়ে পৌঁছেই তারা স্লোগান পরিবর্তন করে 'নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর' ধ্বনিতে জঙ্গি মিছিল শুরু করে এবং ১৫-২০টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। মিছিল থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবি করা হয়।
পুলিশ জানায়, মণিরামপুর থানা থেকে ছয় পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে পৌঁছা মাত্রই শিবিরকর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার এক পর্যায়ে পুলিশ কনস্টেবল জহুরুল ইসলাম (৫৫) পড়ে যান। আহত হন আরো দুজন। জহুরুলকে প্রথমে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে যশোর পুলিশ লাইন হাসপাতাল ও পরে যশোর সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
মণিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আশরাফুল ইসলাম আরিফ বলেন, 'পুলিশ সদস্য জহুরুলের ইনজুরি ছিল সামান্য। তবে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। যশোরে রেফার করা হলে পথিমধ্যে তিনি মারা যান।'
মণিরামপুর থানার ওসি আলী আজম জানান, খবর পেয়ে থানা ও স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তখনো শিবিরকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও কাচের বোতল ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগকর্মীরা এসে শিবিরকর্মীদের ধাওয়া দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ ৩০টি শটগানের গুলি ও ছয়টি টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে বলে জানান তিনি।
ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত উপপরিদর্শক জামিরুল ইসলাম বলেন, 'জহুরুল আমার সঙ্গেই ছিলেন। ইটের আঘাতে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যান।' পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্র বলেন, জহুরুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
আহত শিবিরকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনার বিভিন্ন কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র। মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে তারা মণিরামপুরে জড়ো হয়েছিল।
এদিকে মণিরামপুর উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, 'সকালে আমরা হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে জামায়াত নেতা নূর মোহাম্মদ ও শিবিরকর্মী মোবারক হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ আমাদের ২০ জন নেতা-কর্মীকে আটক করেছে।'
ফেনীতে পিকেটারদের ধাওয়ায় একজন নিহত : শহরের খাজুরিয়া রাস্তার মাথায় পিকেটারদের ধাওয়া খেয়ে পালাতে গিয়ে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক নিহত হয়েছেন। নিহত ইমন উদ্দিনের (২৪) বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শিলরি গ্রামে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল ১০টার দিকে ফেনী শহরের পাঠানবাড়ী রাস্তার মাথা থেকে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে ইমন সদর উপজেলার শর্শদি যাচ্ছিলেন। তাঁর গাড়িটি খাজুরিয়া রাস্তার মাথায় গেলে পিকেটাররা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এ সময় দ্রুত পালাতে গিয়ে গাড়িটি রাস্তার পাশে একটি বড় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। এতে চালক ইমন গুরুতর এবং তিন যাত্রী সামান্য আহত হন।
ফেনী থানার ওসি মো. মাইনুল আবসার জানান, ইমনকে আশপাশের লোকজন ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে দুপুর আড়াইটার দিকে তিনি মারা যান। বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
No comments