সুনেত্র ভূগঠনে অসফল কূপ এবং বাপেক্স by মুহাম্মদ জামালুদ্দীন
সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা (সুনেত্র) ভূগঠনে
সাড়ে চার কিলোমিটার গভীর কূপ খনন করার পর গ্যাস আবিষ্কারে অসফল হওয়াটা
বাংলাদেশের জ্বালানি খাত, একই সঙ্গে বাপেক্সের জন্য একটি বড় রকমের ধাক্কা।
এই এলাকায় পরিচালিত দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের ফলাফল প্রাপ্তির পর
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ২০০৯ সালে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে
বলেছিলেন, সুনেত্র এলাকায় একটি বড় গ্যাসক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে, কিন্তু তিনি
ভূগঠন বলেননি। এটিতে কমপক্ষে দুই টিসিএফ গ্যাস রয়েছে, এমনকি কালক্রমে এটি
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র প্রমাণিত হতে পারে। ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে
গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনাময় ভূগঠন চিহ্নিত করা আর কূপ খননের মাধ্যমে
গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন
ধরে লক্ষ করা যাচ্ছিল, কোনো অনুসন্ধান কূপ খনন ব্যতিরেকেই পেট্রোবাংলা তথা
বাপেক্স কেবল ভূকম্পন জরিপ সম্পন্ন করেই একের পর এক তেল ও গ্যাসক্ষেত্র
আবিষ্কার করে যাচ্ছে।
সুনেত্র ভূগঠনে গ্যাস আবিষ্কারে অসফলতার কথা পেট্রোবাংলা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করলেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ ব্যাপারে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। ভূগঠনের চেহারা দেখেই গ্যাস আবিষ্কার এবং গ্যাসের মজুতের ঘোষণা দেওয়া যে নিতান্তই অপেশাদারি আচরণ, বর্তমান অসফলতা সেটি দেখিয়ে দিচ্ছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন (ওএনজিসি) ২০০৭ সালে কৃষ্ণা-গোদাবরী বেসিনে দুই টিসিএফের অধিক মজুতসম্পন্ন একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারবাজারে ওএনজিসির শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। ভারতীয় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব হাইড্রোকার্বনস (ডিজিএইচ) ওএনজিসির ঘোষণা এ অজুহাতে বাতিল করে দেয় যে শেয়ারের দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে গ্যাস প্রবাহিত হওয়ার আগেই ওএনজিসি গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে। ওএনজিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ডিজিএইচের পাকড়াও থেকে নিস্তার পায়নি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে কখনো কূপ খনন ছাড়াই গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
দেশের জন্য এটা অত্যন্ত দুঃসংবাদ যে বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে একের পর এক অসফল কূপ খনন করা হচ্ছে। সমুদ্রবক্ষে মগনামা ভূগঠনে অসফল কূপ খনন করার পর ব্রিটিশ তেল কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি বাংলাদেশে তাদের সমুদয় স্বার্থ অস্ট্রেলিয়ান তেল কোম্পানি স্যান্টোসের কাছে বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করে। এর অব্যবহিত পরে বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেভরন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পটুয়াখালীর চরকাজল ভূগঠনে কূপ খনন করে গ্যাস আবিষ্কারে অসফল হয়। এদিকে বাপেক্স গাজীপুরের কাপাসিয়া ভূগঠনে একটি শুষ্ক কূপ খনন করে। অতঃপর বাপেক্স নোয়াখালীর সুন্দলপুর ভূগঠনে কূপ খনন করে ৪০ বিসিএফ মজুতের একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। উল্লেখ্য, দেশের বর্তমান মাসিক গ্যাসের চাহিদা ৬০ বিসিএফের বেশি। সুতরাং ৪০ বিসিএফ মজুতের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার কার্যত অসফল কূপ খননেরই নামান্তর। সর্বশেষ সুনেত্র ভূগঠনে গ্যাস আবিষ্কারে সফল হতে না পারাটা দেশের জন্য একটি বিপৎসংকেত।
সুনেত্র ভূগঠনে গ্যাস আবিষ্কৃত না হওয়ার ফলে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞজনের তির্যক মন্তব্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। একজন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, সুনেত্র ভূগঠনে ত্রিমাত্রিক জরিপ করে গ্যাস পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হয়ে কূপ খনন করে কেন এত বিপুল টাকা ব্যয় করা হলো, তার জবাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে। অপর একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, দ্বিমাত্রিকের পরিবর্তে ত্রিমাত্রিক জরিপ করা হলে এখানে গ্যাস আছে কি না, তা সঠিকভাবে অনুমান করা সম্ভব হতো। কিন্তু কোনো ধরনের অনুমান ছাড়াই কূপ খনন করার ফলে রাষ্ট্রের শতকোটি টাকা গচ্চা গেছে। উভয় মন্তব্যই অজ্ঞতাপ্রসূত।
বস্তুত ভূকম্পন জরিপ, সেটি দ্বিমাত্রিক কিংবা ত্রিমাত্রিক—যা-ই হোক না কেন, কখনোই তেল-গ্যাস আবিষ্কারের নিশ্চয়তা দেয় না। পূর্বে কূপ খনন করা হয়নি এমন এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে পরিচালিত দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক জরিপ প্রধানত মাটির কয়েক কিলোমিটার গভীরে পাহাড় আকৃতির ভূগঠন খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু এ ধরনের ভূগঠন (Four way closure) তেল-গ্যাসের সর্বোৎকৃষ্ট আধার হিসেবে বিবেচিত হলেও সব ভূগঠনে তেল-গ্যাস পাওয়া যাবেই, এমন নিশ্চয়তা কখনোই দেয় না। উল্লেখ্য, সমুদ্রবক্ষের ভূগঠন মগনামা এবং স্থলভাগের ভূগঠন কুমিল্লার রসুলপুরে ত্রিমাত্রিক জরিপ সম্পন্ন করার পর কূপ খনন করা হয়েছিল এবং সেখানে বাণিজ্যিক তেল-গ্যাস পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া সমুদ্রে ত্রিমাত্রিক জরিপ পরিচালনা তুলনামূলক কম ব্যয়সাপেক্ষ। বলা হয়ে থাকে, স্থলভাগে ত্রিমাত্রিক জরিপ পরিচালন ব্যয় অনুসন্ধান কূপ খনন ব্যয়ের প্রায় সমান। বাংলাদেশে এযাবৎ যে ২৩টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, এর কোনোটিই ত্রিমাত্রিক জরিপ করে আবিষ্কৃত হয়নি। বরং তিতাস, রশিদপুর, হবিগঞ্জ ইত্যাদি গ্যাসক্ষেত্র পঞ্চাশ-ষাটের দশকের প্রাথমিক যুগের দ্বিমাত্রিক জরিপের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত বাঙ্গোরা, শ্রীকাইল, সুন্দলপুর ইত্যাদি ক্ষুদ্র গ্যাসক্ষেত্র কম্পিউটারনির্ভর অতি উন্নত মানের দ্বিমাত্রিক জরিপের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছে।
তেল বা গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে এমন ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করা হলে কূপ খননের মাধ্যমে চিহ্নিত তেল বা গ্যাস স্তরগুলোর নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে বিস্তার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা যায়। ফলে ক্ষেত্রটিতে তেল বা গ্যাসের আধারের বিস্তৃতি ও মজুত সম্পর্কে বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়। এ ছাড়া পরবর্তী উৎপাদন কূপগুলোর স্থান নির্ধারণ নিখুঁতভাবে করা যায়। তেল-গ্যাসক্ষেত্রের স্তরগুলোর পুরুত্ব এবং বিস্তৃতি নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে কখনোই একই রকম থাকে না। কোথাও পাতলা আবার কোথাও পুরু, প্রাকৃতিক কারণে কখনো অংশবিশেষ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কিছু দূর গিয়ে পুনরায় খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রীকাইলে প্রথম কূপ এবং বেগমগঞ্জে দ্বিতীয় কূপ ক্ষয়প্রাপ্ত গ্যাসস্তরের ওপর খনন করায় অসফল হয়েছিল।
মগনামা, চরকাজল, কাপাসিয়া, সুন্দলপুর ও সুনেত্র—এ পাঁচটি ভূগঠনই Four way closure। এ ধরনের ভূগঠনে কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়াটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ রকম ধারাবাহিক ব্যর্থতার ঘটনা বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের ইতিহাসে ইতিপূর্বে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। বাংলাদেশে কূপের সংখ্যার সঙ্গে গ্যাস আবিষ্কারে সফলতার অনুপাত ৩:১। নিঃসন্দেহে উল্লিখিত পাঁচটি ভূগঠনের মধ্যে সুনেত্র সর্বাধিক সম্ভাবনাময় ছিল। ভূগঠনটি বিশালাকার এবং এতে বিপুল পরিমাণ গ্যাস থাকার সব সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্থলভাগে এ ধরনের সম্ভাবনাময় এবং বিশালাকার ভূগঠন আর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বাপেক্সের ভবিষ্যৎ অনুসন্ধান কূপ খনন পরিকল্পনায় যেসব ভূগঠন রয়েছে, এর প্রতিটিই তুলনামূলকভাবে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে কিছু আছে নতুন ভূগঠন, যেগুলো গঠনগতভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ এবং আকারে ছোট। আর কিছু ভূগঠন আছে, যেগুলো প্রাথমিক বিবেচনায় সম্ভাবনাময় ছিল; কিন্তু কূপ খনন করে তেল-গ্যাস কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রথম অনুসন্ধান কূপ অসফল হলে, সংশ্লিষ্ট ভূগঠনের প্রতি আকর্ষণ স্বভাবতই হ্রাস পেয়ে যায় এবং দ্বিতীয় অনুসন্ধান কূপ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হয়।
একটি অনুসন্ধান কূপ খননে বাপেক্স ব্যয় করে ৬০ থেকে ৮০ কোটি টাকা। গ্যাস আবিষ্কৃত হলে অনেকেই তার কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে যায়। কিন্তু অসফল কূপ খনন করা হলে সব দায় বাপেক্সের কাঁধেই চাপে। বিশেষজ্ঞরা তখন বাপেক্সকে লক্ষ্য করে সমালোচনার তির ছুড়তে থাকেন। সুতরাং ভবিষ্যৎ কূপ খনন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাসের লক্ষ্যে বাপেক্সের উচিত হবে প্রয়োজনে আরও নিবিড় অনুসন্ধান কার্যক্রম গ্রহণ করে অর্থ অপচয়ের সম্ভাবনা হ্রাস করা। সুনেত্র ভূগঠনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হাল ছেড়ে দিয়ে এ ভূগঠন ত্যাগ করা বাপেক্সের কোনোমতেই সমীচীন হবে না। প্রাপ্ত খনন-উপাত্ত পার্শ্ববর্তী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উপাত্তের সঙ্গে সমন্বয় করে, প্রয়োজনে আরও ভূকম্পন জরিপ চালিয়ে এখানে এক বা একাধিক কূপ খনন করা উচিত হবে। একের পর এক অসফল কূপ খনন বাপেক্সের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
মুহাম্মদ জামালুদ্দীন: সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাপেক্স।
সুনেত্র ভূগঠনে গ্যাস আবিষ্কারে অসফলতার কথা পেট্রোবাংলা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না করলেও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ ব্যাপারে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। ভূগঠনের চেহারা দেখেই গ্যাস আবিষ্কার এবং গ্যাসের মজুতের ঘোষণা দেওয়া যে নিতান্তই অপেশাদারি আচরণ, বর্তমান অসফলতা সেটি দেখিয়ে দিচ্ছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন (ওএনজিসি) ২০০৭ সালে কৃষ্ণা-গোদাবরী বেসিনে দুই টিসিএফের অধিক মজুতসম্পন্ন একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারবাজারে ওএনজিসির শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। ভারতীয় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব হাইড্রোকার্বনস (ডিজিএইচ) ওএনজিসির ঘোষণা এ অজুহাতে বাতিল করে দেয় যে শেয়ারের দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে গ্যাস প্রবাহিত হওয়ার আগেই ওএনজিসি গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে। ওএনজিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ডিজিএইচের পাকড়াও থেকে নিস্তার পায়নি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে কখনো কূপ খনন ছাড়াই গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
দেশের জন্য এটা অত্যন্ত দুঃসংবাদ যে বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে একের পর এক অসফল কূপ খনন করা হচ্ছে। সমুদ্রবক্ষে মগনামা ভূগঠনে অসফল কূপ খনন করার পর ব্রিটিশ তেল কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি বাংলাদেশে তাদের সমুদয় স্বার্থ অস্ট্রেলিয়ান তেল কোম্পানি স্যান্টোসের কাছে বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করে। এর অব্যবহিত পরে বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেভরন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পটুয়াখালীর চরকাজল ভূগঠনে কূপ খনন করে গ্যাস আবিষ্কারে অসফল হয়। এদিকে বাপেক্স গাজীপুরের কাপাসিয়া ভূগঠনে একটি শুষ্ক কূপ খনন করে। অতঃপর বাপেক্স নোয়াখালীর সুন্দলপুর ভূগঠনে কূপ খনন করে ৪০ বিসিএফ মজুতের একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। উল্লেখ্য, দেশের বর্তমান মাসিক গ্যাসের চাহিদা ৬০ বিসিএফের বেশি। সুতরাং ৪০ বিসিএফ মজুতের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার কার্যত অসফল কূপ খননেরই নামান্তর। সর্বশেষ সুনেত্র ভূগঠনে গ্যাস আবিষ্কারে সফল হতে না পারাটা দেশের জন্য একটি বিপৎসংকেত।
সুনেত্র ভূগঠনে গ্যাস আবিষ্কৃত না হওয়ার ফলে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞজনের তির্যক মন্তব্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। একজন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, সুনেত্র ভূগঠনে ত্রিমাত্রিক জরিপ করে গ্যাস পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হয়ে কূপ খনন করে কেন এত বিপুল টাকা ব্যয় করা হলো, তার জবাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে। অপর একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, দ্বিমাত্রিকের পরিবর্তে ত্রিমাত্রিক জরিপ করা হলে এখানে গ্যাস আছে কি না, তা সঠিকভাবে অনুমান করা সম্ভব হতো। কিন্তু কোনো ধরনের অনুমান ছাড়াই কূপ খনন করার ফলে রাষ্ট্রের শতকোটি টাকা গচ্চা গেছে। উভয় মন্তব্যই অজ্ঞতাপ্রসূত।
বস্তুত ভূকম্পন জরিপ, সেটি দ্বিমাত্রিক কিংবা ত্রিমাত্রিক—যা-ই হোক না কেন, কখনোই তেল-গ্যাস আবিষ্কারের নিশ্চয়তা দেয় না। পূর্বে কূপ খনন করা হয়নি এমন এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে পরিচালিত দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক জরিপ প্রধানত মাটির কয়েক কিলোমিটার গভীরে পাহাড় আকৃতির ভূগঠন খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু এ ধরনের ভূগঠন (Four way closure) তেল-গ্যাসের সর্বোৎকৃষ্ট আধার হিসেবে বিবেচিত হলেও সব ভূগঠনে তেল-গ্যাস পাওয়া যাবেই, এমন নিশ্চয়তা কখনোই দেয় না। উল্লেখ্য, সমুদ্রবক্ষের ভূগঠন মগনামা এবং স্থলভাগের ভূগঠন কুমিল্লার রসুলপুরে ত্রিমাত্রিক জরিপ সম্পন্ন করার পর কূপ খনন করা হয়েছিল এবং সেখানে বাণিজ্যিক তেল-গ্যাস পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া সমুদ্রে ত্রিমাত্রিক জরিপ পরিচালনা তুলনামূলক কম ব্যয়সাপেক্ষ। বলা হয়ে থাকে, স্থলভাগে ত্রিমাত্রিক জরিপ পরিচালন ব্যয় অনুসন্ধান কূপ খনন ব্যয়ের প্রায় সমান। বাংলাদেশে এযাবৎ যে ২৩টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, এর কোনোটিই ত্রিমাত্রিক জরিপ করে আবিষ্কৃত হয়নি। বরং তিতাস, রশিদপুর, হবিগঞ্জ ইত্যাদি গ্যাসক্ষেত্র পঞ্চাশ-ষাটের দশকের প্রাথমিক যুগের দ্বিমাত্রিক জরিপের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছিল। পক্ষান্তরে সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত বাঙ্গোরা, শ্রীকাইল, সুন্দলপুর ইত্যাদি ক্ষুদ্র গ্যাসক্ষেত্র কম্পিউটারনির্ভর অতি উন্নত মানের দ্বিমাত্রিক জরিপের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছে।
তেল বা গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে এমন ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করা হলে কূপ খননের মাধ্যমে চিহ্নিত তেল বা গ্যাস স্তরগুলোর নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে বিস্তার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা যায়। ফলে ক্ষেত্রটিতে তেল বা গ্যাসের আধারের বিস্তৃতি ও মজুত সম্পর্কে বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়। এ ছাড়া পরবর্তী উৎপাদন কূপগুলোর স্থান নির্ধারণ নিখুঁতভাবে করা যায়। তেল-গ্যাসক্ষেত্রের স্তরগুলোর পুরুত্ব এবং বিস্তৃতি নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে কখনোই একই রকম থাকে না। কোথাও পাতলা আবার কোথাও পুরু, প্রাকৃতিক কারণে কখনো অংশবিশেষ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কিছু দূর গিয়ে পুনরায় খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রীকাইলে প্রথম কূপ এবং বেগমগঞ্জে দ্বিতীয় কূপ ক্ষয়প্রাপ্ত গ্যাসস্তরের ওপর খনন করায় অসফল হয়েছিল।
মগনামা, চরকাজল, কাপাসিয়া, সুন্দলপুর ও সুনেত্র—এ পাঁচটি ভূগঠনই Four way closure। এ ধরনের ভূগঠনে কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়াটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ রকম ধারাবাহিক ব্যর্থতার ঘটনা বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের ইতিহাসে ইতিপূর্বে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। বাংলাদেশে কূপের সংখ্যার সঙ্গে গ্যাস আবিষ্কারে সফলতার অনুপাত ৩:১। নিঃসন্দেহে উল্লিখিত পাঁচটি ভূগঠনের মধ্যে সুনেত্র সর্বাধিক সম্ভাবনাময় ছিল। ভূগঠনটি বিশালাকার এবং এতে বিপুল পরিমাণ গ্যাস থাকার সব সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্থলভাগে এ ধরনের সম্ভাবনাময় এবং বিশালাকার ভূগঠন আর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বাপেক্সের ভবিষ্যৎ অনুসন্ধান কূপ খনন পরিকল্পনায় যেসব ভূগঠন রয়েছে, এর প্রতিটিই তুলনামূলকভাবে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে কিছু আছে নতুন ভূগঠন, যেগুলো গঠনগতভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ এবং আকারে ছোট। আর কিছু ভূগঠন আছে, যেগুলো প্রাথমিক বিবেচনায় সম্ভাবনাময় ছিল; কিন্তু কূপ খনন করে তেল-গ্যাস কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রথম অনুসন্ধান কূপ অসফল হলে, সংশ্লিষ্ট ভূগঠনের প্রতি আকর্ষণ স্বভাবতই হ্রাস পেয়ে যায় এবং দ্বিতীয় অনুসন্ধান কূপ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হয়।
একটি অনুসন্ধান কূপ খননে বাপেক্স ব্যয় করে ৬০ থেকে ৮০ কোটি টাকা। গ্যাস আবিষ্কৃত হলে অনেকেই তার কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে যায়। কিন্তু অসফল কূপ খনন করা হলে সব দায় বাপেক্সের কাঁধেই চাপে। বিশেষজ্ঞরা তখন বাপেক্সকে লক্ষ্য করে সমালোচনার তির ছুড়তে থাকেন। সুতরাং ভবিষ্যৎ কূপ খনন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাসের লক্ষ্যে বাপেক্সের উচিত হবে প্রয়োজনে আরও নিবিড় অনুসন্ধান কার্যক্রম গ্রহণ করে অর্থ অপচয়ের সম্ভাবনা হ্রাস করা। সুনেত্র ভূগঠনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। হাল ছেড়ে দিয়ে এ ভূগঠন ত্যাগ করা বাপেক্সের কোনোমতেই সমীচীন হবে না। প্রাপ্ত খনন-উপাত্ত পার্শ্ববর্তী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উপাত্তের সঙ্গে সমন্বয় করে, প্রয়োজনে আরও ভূকম্পন জরিপ চালিয়ে এখানে এক বা একাধিক কূপ খনন করা উচিত হবে। একের পর এক অসফল কূপ খনন বাপেক্সের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
মুহাম্মদ জামালুদ্দীন: সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাপেক্স।
No comments