আনন্দ-বেদনার বইমেলা by আনিসুল হক
বইমেলার ভেতরেই অনেক চায়ের স্টল ছিল তখন—আশির দশকের শেষের দিকে, হয়তো
নব্বইয়ের প্রথম ভাগে। আমি একনিষ্ঠ কর্মী জাতীয় কবিতা উৎসবের। কবি মহাদেব
সাহা, নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে ভালো রকমের পরিচয় হয়ে গেছে। গুণদার পলাশীর
বিখ্যাত মেসবাড়ির সিঙ্গেল রুমটায় যাই।
মহাদেবদার বাড়ি গেলে নীলা বৌদি মাগুর
মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ান। বুয়েটের হলের ডাইনিংয়ের খাবার খেয়ে চরা পড়ে
যাওয়া পেটে সেই ঝোল অমৃত বলে মনে হয়। একদিন, বইমেলায়, কড়ইতলার চায়ের স্টলে
কবি মহাদেব সাহার পাশে বসে আছি। একটু পরে এলেন কবি শামসুর রাহমান। তার
কিছুক্ষণ পরে হুমায়ূন আহমেদ। এই মহামানবদের সঙ্গে বসে আছে প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয়ের থার্ড ইয়ারের এক ছাত্র, যার ওজন ৫০ কেজি, চোখের নিচে কালি,
মাথার চুল উষ্কখুষ্ক, যার বয়স ২৩। কবি ফেরদৌস নাহার এলেন। বললেন, ‘আনিস,
তুমি যে একেবারে বড়দের দলে ভিড়ে গেছ।’ লজ্জা পেয়ে উঠে এলাম। সেই হুমায়ূন
আহমেদকে আমার প্রথম কাছ থেকে দেখা।
১৯৮৯ সালে আমি পড়ি ফোর্থ ইয়ারে। আমার প্রথম কবিতার বই খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে বেরিয়ে গেল। বইমেলার ভেতরেই মাদুর বিছিয়ে তখন লিটল ম্যাগাজিন বা নতুন লেখকদের বই বিক্রি করা যেত। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। বুয়েটের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে এসে আমার বই কিনতে লাগল। ৪০০ কপি বই বিক্রি করে বড়লোক হয়ে গেলাম প্রায়। ওই সময় স্থাপত্য বিভাগের বড় ভাই মাহফুজুর রহমান আমাকে বললেন, ‘দাঁড়াও, তোমার বই স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করছি। আমার একজন বন্ধুর একটা স্টল আছে।’ গেলাম তাঁর সেই বন্ধুর কাছে। তাঁর নাম আহসান হাবীব। তাঁর দুটো স্টল, উন্মাদ আর দিনরাত্রি প্রকাশনী। আহসান হাবীব ভাই আমার ২০টা বই রাখলেন। বইমেলা শেষে ২০টা বইয়ের দাম বুঝিয়ে দিলেন। সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
তিন ভাইয়ের দুই ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো বইমেলায়।
এবার তৃতীয় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের গল্পটা বলতে হয়। মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ততদিনে আমার দু-চারটা বই বেরিয়ে গেছে। সেগুলো বিক্রি হয়। একদিন বইমেলায় আহসান হাবীব ভাই আমাকে বললেন, ‘আপনি একটু দাঁড়ান। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আপনাকে দেখতে চেয়েছেন।’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন সায়েন্স ফিকশন লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমি তাঁর সায়েন্স ফিকশন এরই মধ্যে পড়ে ফেলেছি। তিনি যে খুবই ভালো লেখেন, সেটা আমাদের সবার জানা। ভেতরে ভেতরে আমি উত্তেজিত। বাংলা একাডেমীর পুকুরপাড়ের কোনায় আহসান হাবীব ভাইয়ের দিনরাত্রির স্টলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এলেন। বললেন, ‘আপনার একটা বই নিয়ে গিয়ে আমি পড়েছি। শাহিনের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম।’
আশ্চর্য যে, বাংলাদেশের বিখ্যাত তিন লেখক ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বইমেলায়!
একদিন হুমায়ূন আহমেদ এলেন মেলায়। ভীষণ ভিড়। তখনো মেলায় তাঁকে ঘিরে ভিড়টা সহনীয় পর্যায়েরই ছিল। আমি তাঁর কাছে গেলাম। মন্তব্য নিলাম। বললাম, ‘আমার মেয়ের জন্য একটা অটোগ্রাফ দেন।’ তিনি লিখলেন, ‘পদ্য, তুমি কেমন আছ?’
এই এক লাইনের অটোগ্রাফটার কথা আমি মাঝেমধ্যে ভাবি। আমি হলে লিখতাম, পদ্যকে আদর। এই রকম করে সম্পূর্ণ নতুন কথা এই ভিড়ের মধ্যে যে লেখা যেতে পারে, তা কেবল হুমায়ূন আহমেদই পারেন।
এবারের বইমেলায় আমরা যাব। জাফর স্যার যাবেন, হাবিব ভাই যাবেন। শুধু হুমায়ূন আহমেদ আর যাবেন না।
এবারের বইমেলা হুমায়ূন আহমেদকে উৎসর্গ করা হচ্ছে। কাজেই তিনি থাকবেন এই বইমেলায়। বিপুলভাবে থাকবেন, থাকবে তাঁর বইগুলো। আর তিনি থাকবেন তাঁর লাখো ভক্তের হূদয়ে হূদয়ে।
আমি প্রথম বইমেলায় যাই ১৯৮৪ কি ’৮৫ সালে। ২০১৩ পর্যন্ত হিসাব করলে ২৮-২৯ বছর। এরই মধ্যে কত লেখককে আমরা হারালাম।
মৃত্যুর দিন কয়েক আগে আবদুশ শাকুর আমাকে ফোন করলেন, তিনি কলকাতা থেকে ফিরেছেন—‘আনিসুল হক, দেবেশ রায় তোমাকে খুঁজছেন। ফোন করো। ফোন নম্বর নাও।’ ফোন নম্বর দিলেন। কণ্ঠস্বর তাঁর ফ্যাসফেসে—সে তো বরাবরই ছিল। কলকাতা গিয়েছিলেন নতুন একটা বইয়ের জন্য গবেষণা করতে। আমার সঙ্গে কথা বলার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি বিদায় নিলেন।
রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই বইমেলায় আসতেন সপারিষদ। আমি তাঁকে আমার নতুন উপন্যাস দিতে গেলাম দৌড়ে। বললাম, ‘দাদাভাই, আমার বই ভালো বিক্রি হয়।’ দাদাভাই বললেন, ‘দেখো, ভালো বিক্রি হওয়া কিন্তু সব সময় ভালো কথা নয়।’ শামসুর রাহমান বইমেলায় এলে আমি তাঁর পেছনে ফেউয়ের মতো ঘুরতাম। তাঁর নতুন বই কিনে অটোগ্রাফ নিতাম। তিনি তাঁর সেই ভুবনভোলানো হাসিটা দিতেন।
হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে বইমেলার স্মৃতি অনেক। তিনি ছিলেন আমাদের বইমেলার সবচেয়ে নিয়মিত চরিত্র। রোজ বেলা তিনটায় এসে আগামীর স্টলে বসতেন। তিনি মারাও গেলেন ওই বইমেলা থেকে বেরোনোর পথে আক্রান্ত হওয়ার জের ধরে। তিনি আমাদের বইমেলার শহীদ।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে একবার যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম কবিতা পড়তে, সেও তো ফেব্রুয়ারি মাসে, আর বইমেলা থেকেই। দুই বছরের মধ্যেই তিনি অপ্রকাশিত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ হয়ে বইমেলায় এলেন। হয়ে গেলেন বার্ষিক রুদ্রমেলা।
কতজনকেই তো মিস করছে আমাদের একুশে বইমেলা—বাংলা একাডেমী চত্বরের বটগাছের পাতা, পুকুরপাড়, বর্ধমান হাউসের খিলানে বাসা বানানো চড়ুই পাখির দল। সিকদার আমিনুল হক, সেই সতত ডানার মানুষটি, মুখে মৃদু হাসি, চোখে কালো চশমা। আবদুল মান্নান সৈয়দ, শিল্পতরুর স্টলে দেখা যেত যাঁকে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যিনি বালক-সাংবাদিকের সাক্ষাৎকারের অনুরোধ হেসেই এড়িয়ে যেতেন। শহীদুল জহির কিংবা মাহমুদুল হককে আমি বইমেলায় দেখিনি, কিন্তু তাঁরা আর লিখবেন না কোনো দিনও, এই ভার কীভাবে সহ্য করবে আমাদের প্রকাশনা জগৎ? বইমেলার এক প্রাণন্ত চরিত্র ছিলেন সমুদ্র গুপ্ত। ঝাঁকড়া সাদা বাবরি চুল নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন মাঠময়। তারও চেয়ে তরুণ ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। মুখে মৃদু হাসি, লম্বা পাতলা সাদা চুল পাটের আঁশের মতো উড়ছে, কী ঋজু তাঁর চলার ভঙ্গি।
এমনি কত লেখককে হারাল বইমেলা। আনওয়ার আহমেদ আসবেন না রূপম নিয়ে, আসবেন না খন্দকার মাজহারুল করিম তাঁর পেপারব্যাকে লেখা রোমান্টিক সিরিজের বই নিয়ে। ত্রিদিব দস্তিদার চিৎকার করে বলবেন না, ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব।
কিন্তু আসবেন তো সৈয়দ শামসুল হক, আসবে তাঁর বই; আসবেন হাসান আজিজুল হক, আসবে তাঁর গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী কিংবা প্রবন্ধের বই; আসবেন আনিসুজ্জামান, প্রধানত মোড়ক উন্মোচনের অনুরোধ ফেলতে না পেরে (এ ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তো বাংলা একাডেমীর চেয়ারম্যানকে থাকতেই হবে)। আসবেন মুনতাসীর মামুন, সঙ্গে হয়তো শিল্পী হাশেম খান কিংবা শাহরিয়ার কবির, সময় প্রকাশনীতে একবার ঢুঁ মারবেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত আসবেন বৈকালিক ভ্রমণের জুতা পরে, দুই হাতে বই কিনবেন। ইমদাদুল হক মিলন আসবেন, বসবেন অনন্যার স্টলে। নাসরীন জাহান আসবেন, ঘুরবেন, ফিরবেন, হয়তো পারভেজ হোসেন থাকবেন তাঁর পাশে। লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, আহমদ মাযহারকে দেখা যাবে হয়তো চ্যানেল আইয়ের মঞ্চের আশপাশে। মুহম্মদ হাবিবুর রহমান আসবেন এক-আধবার, নির্মলেন্দু গুণ আসবেন রাত আটটায়, এক-আধবার আসবেন মহাদেব সাহা। আসাদ চৌধুরী প্রায়ই আসবেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রবিউল হুসাইন, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী কখনো-সখনো। আসাদুজ্জামান নূর ব্যাগভর্তি করে বই কিনবেন। রামেন্দু মজুমদারকে দেখা যাবে কাউকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। দলবেঁধে হাঁটবেন মুহাম্মদ সামাদ কিংবা মোহন রায়হান। মশিউল আলম আড্ডা দেবেন আহমাদ মোস্তফা কামাল কিংবা অদিতি ফাল্গুনীর সঙ্গে। ওয়াসি আহমেদের সামনে তাঁর বই বাড়িয়ে ধরে অটোগ্রাফ চাইলে তিনি লজ্জায় করমচা হয়ে উঠবেন।
আর আসবেন প্রবাসী লেখকেরা।
শামীম আজাদ কিংবা ইকবাল হাসান। সারা দেশ থেকে আসবেন বইপ্রেমী পাঠকেরা। তরুণ লেখকেরা। লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরা। হাতে সদ্য ছাপা বই। একটা নতুন পৃথিবীর জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করবেন তাঁর উদাসীন প্রেমিকা। আজকের বিকালটায় ছেলেটি হয়তো একটু বেশি মনোযোগ লাভের যোগ্য হয়ে উঠেছেন। বটগাছের সবুজ পাতার আড়ালে ডেকে উঠবে কালো কোকিল—হয়তো কালের কোকিল।
১৯৮৯ সালে আমি পড়ি ফোর্থ ইয়ারে। আমার প্রথম কবিতার বই খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে বেরিয়ে গেল। বইমেলার ভেতরেই মাদুর বিছিয়ে তখন লিটল ম্যাগাজিন বা নতুন লেখকদের বই বিক্রি করা যেত। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। বুয়েটের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে এসে আমার বই কিনতে লাগল। ৪০০ কপি বই বিক্রি করে বড়লোক হয়ে গেলাম প্রায়। ওই সময় স্থাপত্য বিভাগের বড় ভাই মাহফুজুর রহমান আমাকে বললেন, ‘দাঁড়াও, তোমার বই স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করছি। আমার একজন বন্ধুর একটা স্টল আছে।’ গেলাম তাঁর সেই বন্ধুর কাছে। তাঁর নাম আহসান হাবীব। তাঁর দুটো স্টল, উন্মাদ আর দিনরাত্রি প্রকাশনী। আহসান হাবীব ভাই আমার ২০টা বই রাখলেন। বইমেলা শেষে ২০টা বইয়ের দাম বুঝিয়ে দিলেন। সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
তিন ভাইয়ের দুই ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো বইমেলায়।
এবার তৃতীয় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের গল্পটা বলতে হয়। মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ততদিনে আমার দু-চারটা বই বেরিয়ে গেছে। সেগুলো বিক্রি হয়। একদিন বইমেলায় আহসান হাবীব ভাই আমাকে বললেন, ‘আপনি একটু দাঁড়ান। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আপনাকে দেখতে চেয়েছেন।’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন সায়েন্স ফিকশন লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমি তাঁর সায়েন্স ফিকশন এরই মধ্যে পড়ে ফেলেছি। তিনি যে খুবই ভালো লেখেন, সেটা আমাদের সবার জানা। ভেতরে ভেতরে আমি উত্তেজিত। বাংলা একাডেমীর পুকুরপাড়ের কোনায় আহসান হাবীব ভাইয়ের দিনরাত্রির স্টলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এলেন। বললেন, ‘আপনার একটা বই নিয়ে গিয়ে আমি পড়েছি। শাহিনের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম।’
আশ্চর্য যে, বাংলাদেশের বিখ্যাত তিন লেখক ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বইমেলায়!
একদিন হুমায়ূন আহমেদ এলেন মেলায়। ভীষণ ভিড়। তখনো মেলায় তাঁকে ঘিরে ভিড়টা সহনীয় পর্যায়েরই ছিল। আমি তাঁর কাছে গেলাম। মন্তব্য নিলাম। বললাম, ‘আমার মেয়ের জন্য একটা অটোগ্রাফ দেন।’ তিনি লিখলেন, ‘পদ্য, তুমি কেমন আছ?’
এই এক লাইনের অটোগ্রাফটার কথা আমি মাঝেমধ্যে ভাবি। আমি হলে লিখতাম, পদ্যকে আদর। এই রকম করে সম্পূর্ণ নতুন কথা এই ভিড়ের মধ্যে যে লেখা যেতে পারে, তা কেবল হুমায়ূন আহমেদই পারেন।
এবারের বইমেলায় আমরা যাব। জাফর স্যার যাবেন, হাবিব ভাই যাবেন। শুধু হুমায়ূন আহমেদ আর যাবেন না।
এবারের বইমেলা হুমায়ূন আহমেদকে উৎসর্গ করা হচ্ছে। কাজেই তিনি থাকবেন এই বইমেলায়। বিপুলভাবে থাকবেন, থাকবে তাঁর বইগুলো। আর তিনি থাকবেন তাঁর লাখো ভক্তের হূদয়ে হূদয়ে।
আমি প্রথম বইমেলায় যাই ১৯৮৪ কি ’৮৫ সালে। ২০১৩ পর্যন্ত হিসাব করলে ২৮-২৯ বছর। এরই মধ্যে কত লেখককে আমরা হারালাম।
মৃত্যুর দিন কয়েক আগে আবদুশ শাকুর আমাকে ফোন করলেন, তিনি কলকাতা থেকে ফিরেছেন—‘আনিসুল হক, দেবেশ রায় তোমাকে খুঁজছেন। ফোন করো। ফোন নম্বর নাও।’ ফোন নম্বর দিলেন। কণ্ঠস্বর তাঁর ফ্যাসফেসে—সে তো বরাবরই ছিল। কলকাতা গিয়েছিলেন নতুন একটা বইয়ের জন্য গবেষণা করতে। আমার সঙ্গে কথা বলার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি বিদায় নিলেন।
রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই বইমেলায় আসতেন সপারিষদ। আমি তাঁকে আমার নতুন উপন্যাস দিতে গেলাম দৌড়ে। বললাম, ‘দাদাভাই, আমার বই ভালো বিক্রি হয়।’ দাদাভাই বললেন, ‘দেখো, ভালো বিক্রি হওয়া কিন্তু সব সময় ভালো কথা নয়।’ শামসুর রাহমান বইমেলায় এলে আমি তাঁর পেছনে ফেউয়ের মতো ঘুরতাম। তাঁর নতুন বই কিনে অটোগ্রাফ নিতাম। তিনি তাঁর সেই ভুবনভোলানো হাসিটা দিতেন।
হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে বইমেলার স্মৃতি অনেক। তিনি ছিলেন আমাদের বইমেলার সবচেয়ে নিয়মিত চরিত্র। রোজ বেলা তিনটায় এসে আগামীর স্টলে বসতেন। তিনি মারাও গেলেন ওই বইমেলা থেকে বেরোনোর পথে আক্রান্ত হওয়ার জের ধরে। তিনি আমাদের বইমেলার শহীদ।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে একবার যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম কবিতা পড়তে, সেও তো ফেব্রুয়ারি মাসে, আর বইমেলা থেকেই। দুই বছরের মধ্যেই তিনি অপ্রকাশিত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ হয়ে বইমেলায় এলেন। হয়ে গেলেন বার্ষিক রুদ্রমেলা।
কতজনকেই তো মিস করছে আমাদের একুশে বইমেলা—বাংলা একাডেমী চত্বরের বটগাছের পাতা, পুকুরপাড়, বর্ধমান হাউসের খিলানে বাসা বানানো চড়ুই পাখির দল। সিকদার আমিনুল হক, সেই সতত ডানার মানুষটি, মুখে মৃদু হাসি, চোখে কালো চশমা। আবদুল মান্নান সৈয়দ, শিল্পতরুর স্টলে দেখা যেত যাঁকে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যিনি বালক-সাংবাদিকের সাক্ষাৎকারের অনুরোধ হেসেই এড়িয়ে যেতেন। শহীদুল জহির কিংবা মাহমুদুল হককে আমি বইমেলায় দেখিনি, কিন্তু তাঁরা আর লিখবেন না কোনো দিনও, এই ভার কীভাবে সহ্য করবে আমাদের প্রকাশনা জগৎ? বইমেলার এক প্রাণন্ত চরিত্র ছিলেন সমুদ্র গুপ্ত। ঝাঁকড়া সাদা বাবরি চুল নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন মাঠময়। তারও চেয়ে তরুণ ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। মুখে মৃদু হাসি, লম্বা পাতলা সাদা চুল পাটের আঁশের মতো উড়ছে, কী ঋজু তাঁর চলার ভঙ্গি।
এমনি কত লেখককে হারাল বইমেলা। আনওয়ার আহমেদ আসবেন না রূপম নিয়ে, আসবেন না খন্দকার মাজহারুল করিম তাঁর পেপারব্যাকে লেখা রোমান্টিক সিরিজের বই নিয়ে। ত্রিদিব দস্তিদার চিৎকার করে বলবেন না, ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব।
কিন্তু আসবেন তো সৈয়দ শামসুল হক, আসবে তাঁর বই; আসবেন হাসান আজিজুল হক, আসবে তাঁর গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী কিংবা প্রবন্ধের বই; আসবেন আনিসুজ্জামান, প্রধানত মোড়ক উন্মোচনের অনুরোধ ফেলতে না পেরে (এ ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তো বাংলা একাডেমীর চেয়ারম্যানকে থাকতেই হবে)। আসবেন মুনতাসীর মামুন, সঙ্গে হয়তো শিল্পী হাশেম খান কিংবা শাহরিয়ার কবির, সময় প্রকাশনীতে একবার ঢুঁ মারবেন। আবুল মাল আবদুল মুহিত আসবেন বৈকালিক ভ্রমণের জুতা পরে, দুই হাতে বই কিনবেন। ইমদাদুল হক মিলন আসবেন, বসবেন অনন্যার স্টলে। নাসরীন জাহান আসবেন, ঘুরবেন, ফিরবেন, হয়তো পারভেজ হোসেন থাকবেন তাঁর পাশে। লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, আহমদ মাযহারকে দেখা যাবে হয়তো চ্যানেল আইয়ের মঞ্চের আশপাশে। মুহম্মদ হাবিবুর রহমান আসবেন এক-আধবার, নির্মলেন্দু গুণ আসবেন রাত আটটায়, এক-আধবার আসবেন মহাদেব সাহা। আসাদ চৌধুরী প্রায়ই আসবেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রবিউল হুসাইন, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী কখনো-সখনো। আসাদুজ্জামান নূর ব্যাগভর্তি করে বই কিনবেন। রামেন্দু মজুমদারকে দেখা যাবে কাউকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। দলবেঁধে হাঁটবেন মুহাম্মদ সামাদ কিংবা মোহন রায়হান। মশিউল আলম আড্ডা দেবেন আহমাদ মোস্তফা কামাল কিংবা অদিতি ফাল্গুনীর সঙ্গে। ওয়াসি আহমেদের সামনে তাঁর বই বাড়িয়ে ধরে অটোগ্রাফ চাইলে তিনি লজ্জায় করমচা হয়ে উঠবেন।
আর আসবেন প্রবাসী লেখকেরা।
শামীম আজাদ কিংবা ইকবাল হাসান। সারা দেশ থেকে আসবেন বইপ্রেমী পাঠকেরা। তরুণ লেখকেরা। লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীরা। হাতে সদ্য ছাপা বই। একটা নতুন পৃথিবীর জন্মমুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করবেন তাঁর উদাসীন প্রেমিকা। আজকের বিকালটায় ছেলেটি হয়তো একটু বেশি মনোযোগ লাভের যোগ্য হয়ে উঠেছেন। বটগাছের সবুজ পাতার আড়ালে ডেকে উঠবে কালো কোকিল—হয়তো কালের কোকিল।
No comments