যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি আজ কবিতার by মুহাম্মদ সামাদ
১৯৮৭ সাল থেকে জাতীয় কবিতা পরিষদের আয়োজনে প্রতি বছর ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বরজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় কবিতা উৎসব।
গত ছাবি্বশ বছরে উৎসবের প্রধান স্লোগান বা মর্মবাণীর মধ্যে ছিল_ শৃঙ্খলমুক্তির জন্য কবিতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা, কবিতা রুখবেই মৌলবাদ, কবিতা উৎসব মুক্তির উৎসব প্রভৃতি। কবি ও কবিতার এই বৃহত্তম মিলনমেলা শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও এক অনন্য উৎসবে পরিণত হয়েছে।
জাতীয় কবিতা উৎসবের যাত্রা শুরু হয়েছিল এক ঘোর রাজনৈতিক সংকটকালে। সামরিক স্বৈরশাসক এইচএম এরশাদের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদদের আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, তখন 'শৃঙ্খলমুক্তির জন্য কবিতা' এই স্লোগান ধারণ করে ১৯৮৭ সালে কবিতা উৎসব স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার করে। দেশের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে উৎসব প্রাঙ্গণ পরিণত হয় অনুপ্রেরণার এক অনন্য উৎসস্থলে, এক মহামিলনমেলায়। ১৯৯১ সালে দেশ সামরিক শাসনমুক্ত হয় এবং গণতন্ত্র চর্চার পথ উন্মুক্ত হয়। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারছিলাম না। দীর্ঘদিন আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিশাপ। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় আংশিক কার্যকর করা হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একটি রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিচারহীনতার কলঙ্কমোচনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য, এই রায় ঘোষণার আগেই এই সাতাশতম জাতীয় কবিতা উৎসবের মুখে আমরা তুলে দিয়েছি এই স্লোগান_ যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি আজ কবিতার।
একাত্তরের গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার বাহাত্তর সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ-১৯৭২ জারি করে এবং ৩৭টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার শুরু করে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর দালাল আইন বাতিল করে রক্তমূল্যে অর্জিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির ওপর চরম নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি আদর্শে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চলতে থাকে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে এবং জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী করে। মহাজোট সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এ বিচার কাজ যখন আইনসম্মত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ঘাতক জামায়াত-শিবির গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা দেশে-বিদেশে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা দেশবাসীকে, বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি সেই নতুন প্রজন্মকে সতর্ক করে দিতে চাই। চার দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে কলঙ্কমুক্ত করতে চাই। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সকলের সঙ্গে আমাদের সুস্পষ্ট উপলব্ধি_ মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচার ৩০ লাখ শহীদ ও চার লাখ মা-বোনের মর্যাদা রক্ষার, মানবতাকে সমুন্নত রাখার, মহিমান্বিত করার; সর্বোপরি, এই বিচার আমাদের জাতীয় সংহতি ও মুক্তির সংগ্রামকে পূর্ণতা দানের বিচার। তাই মানবতাবিরোধী বিচারের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী ও শক্তিশালী করে এই বিচারকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে আমরা সমস্বরে উচ্চারণ করছি যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি আজ কবিতার_ দাবি আজ সকলের।
আমরা কবিরা প্রেমে-অপ্রেমে, ভালোবাসায়-অবহেলায়, রক্ত-মাংস-মজ্জা নিঃশেষ করে; জীবন-সংসার উড়িয়ে-পুড়িয়ে নীরবে-নিভৃতে কবিতা রচনা করি। তবু আমরা কবিরা যেহেতু গজদন্তমিনারবাসী নই এবং যেহেতু এই কবিতা উৎসবের যাত্রা সূচিত হয়েছিল মাতৃভূমির সংকটকালে, তাই কবিদের মূল কাজ কবিতা রচনার পাশাপাশি, রক্তমূল্যে অর্জিত বাংলাদেশকে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার শপথে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাতাশতম জাতীয় কবিতা উৎসব-২০১৩। এই উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে আমাদের কবিতায়, আমাদের গানে_ হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেব নতুন প্রজন্মের প্রাণে।
মুহাম্মদ সামাদ :আহ্বায়ক, জাতীয় কবিতা উৎসব-২০১৩
জাতীয় কবিতা উৎসবের যাত্রা শুরু হয়েছিল এক ঘোর রাজনৈতিক সংকটকালে। সামরিক স্বৈরশাসক এইচএম এরশাদের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদদের আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, তখন 'শৃঙ্খলমুক্তির জন্য কবিতা' এই স্লোগান ধারণ করে ১৯৮৭ সালে কবিতা উৎসব স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার করে। দেশের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে উৎসব প্রাঙ্গণ পরিণত হয় অনুপ্রেরণার এক অনন্য উৎসস্থলে, এক মহামিলনমেলায়। ১৯৯১ সালে দেশ সামরিক শাসনমুক্ত হয় এবং গণতন্ত্র চর্চার পথ উন্মুক্ত হয়। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারছিলাম না। দীর্ঘদিন আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিশাপ। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় আংশিক কার্যকর করা হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একটি রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিচারহীনতার কলঙ্কমোচনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য, এই রায় ঘোষণার আগেই এই সাতাশতম জাতীয় কবিতা উৎসবের মুখে আমরা তুলে দিয়েছি এই স্লোগান_ যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি আজ কবিতার।
একাত্তরের গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার বাহাত্তর সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ-১৯৭২ জারি করে এবং ৩৭টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার শুরু করে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর দালাল আইন বাতিল করে রক্তমূল্যে অর্জিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির ওপর চরম নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি আদর্শে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চলতে থাকে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে এবং জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী করে। মহাজোট সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এ বিচার কাজ যখন আইনসম্মত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ঘাতক জামায়াত-শিবির গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা দেশে-বিদেশে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা দেশবাসীকে, বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি সেই নতুন প্রজন্মকে সতর্ক করে দিতে চাই। চার দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে কলঙ্কমুক্ত করতে চাই। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সকলের সঙ্গে আমাদের সুস্পষ্ট উপলব্ধি_ মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচার ৩০ লাখ শহীদ ও চার লাখ মা-বোনের মর্যাদা রক্ষার, মানবতাকে সমুন্নত রাখার, মহিমান্বিত করার; সর্বোপরি, এই বিচার আমাদের জাতীয় সংহতি ও মুক্তির সংগ্রামকে পূর্ণতা দানের বিচার। তাই মানবতাবিরোধী বিচারের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে স্থায়ী ও শক্তিশালী করে এই বিচারকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে আমরা সমস্বরে উচ্চারণ করছি যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি আজ কবিতার_ দাবি আজ সকলের।
আমরা কবিরা প্রেমে-অপ্রেমে, ভালোবাসায়-অবহেলায়, রক্ত-মাংস-মজ্জা নিঃশেষ করে; জীবন-সংসার উড়িয়ে-পুড়িয়ে নীরবে-নিভৃতে কবিতা রচনা করি। তবু আমরা কবিরা যেহেতু গজদন্তমিনারবাসী নই এবং যেহেতু এই কবিতা উৎসবের যাত্রা সূচিত হয়েছিল মাতৃভূমির সংকটকালে, তাই কবিদের মূল কাজ কবিতা রচনার পাশাপাশি, রক্তমূল্যে অর্জিত বাংলাদেশকে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার শপথে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাতাশতম জাতীয় কবিতা উৎসব-২০১৩। এই উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে আমাদের কবিতায়, আমাদের গানে_ হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নকে ছড়িয়ে দেব নতুন প্রজন্মের প্রাণে।
মুহাম্মদ সামাদ :আহ্বায়ক, জাতীয় কবিতা উৎসব-২০১৩
No comments