বিশেষ রচনা-হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ by ইমদাদুল হক মিলন
১১. 'পদ্মা গোমতী' বেশ নামকরা সংগঠন।\বাংলাদেশ এবং আগরতলা মিলিয়ে কার্যক্রম চলে সংগঠনের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে 'পদ্মা গোমতী'র সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান আর আগরতলার হচ্ছেন অনিল ভট্টাচার্য। এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত 'ত্রিপুরা দর্পণ' পত্রিকার সম্পাদক সমীরণ দত্ত, কবি রাতুল দেববর্মণ প্রমুখ। রাতুল দেববর্মণ বিখ্যাত দেববর্মণ পরিবারের লোক। শচীন দেববর্মণ ও রাহুল দেববর্মণ আলোকিত করেছেন যে পরিবার।
শচীনকর্তার স্ত্রী মীরা দেববর্মণও কম বিখ্যাত নন। কী অসাধারণ সব গান লিখেছেন! আর শচীনকর্তার গানের কথা না-ই বা বললাম। বাংলা গানে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছেন তিনি। সুরের মায়ায় এবং কণ্ঠের জাদুতে শচীন কর্তা বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছেন। বাঙাল মুলুক ছাড়িয়ে বোম্বেতে (আজকের মুম্বাই) পাড়ি জমালেন। হিন্দি গানের জগতেও হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। এমন সব বিখ্যাত ও হিট ছবির সুর করলেন, উপমহাদেশ মাতিয়ে দিলেন। লতা মুঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, কিশোরকুমার_আরো কত কত গায়ক তাঁর সুর করা গান গেয়ে জগৎ জয় করলেন! শচীন দেববর্মণের সুর করা বহু হিন্দি ছবি থেকে দুটোর কথা বলি। একটি ছবির নাম 'অমর প্রেম'। অভিনয় করলেন রাজেশ খান্না ও শর্মীলা ঠাকুর। কিশোরকুমার তাঁর অসাধারণ কণ্ঠে গাইলেন হৃদয় তোলপাড় করা গান। মূল গল্প বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কী অসাধারণ প্রেমের গল্প, কী অসাধারণ প্রেমের ছবি! আরেকটি ছবির নাম 'গাইড'। ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখক আর কে নারায়ণের গল্প, অভিনয় করলেন দেব আনন্দ ও ওয়াহিদা রেহমান। গানগুলোর কোনো তুলনা হয় না। দুটো ছবিতেই শচীনকর্তা নিজের কণ্ঠ সামান্য একটু ব্যবহার করলেন। 'অমর প্রেম'-এর গানটির একটি লাইন আমার মনে পড়ছে, 'ও মাইয়ারে...'। 'গাইড'-এ দু-তিন লাইনে তিনি গেয়েছিলেন গ্রামবাংলার বিখ্যাত সেই গান_
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তুই
শচীন দেববর্মণ হিন্দিতে করলেন_
মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তু রামা মেঘ দে
এখনো কানে লেগে আছে সেই সুর।
তাঁর একটি বিখ্যাত গান (আসলে বিখ্যাত বিখ্যাত বারবার বলা ঠিক হচ্ছে না। শচীনকর্তার সব গানই বিখ্যাত)_
বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে
বাজে ভাঙা ঢোল
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানের লাইন বদলে তিনি গাইলেন_
বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলামায়ের কোল।
আমার বহুদিনের শখ ছিল একবার আগরতলায় যাব, শচীনকর্তার বাড়িটা দেখে আসব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেকখানি সংগঠিত হয়েছিল আগরতলায়। শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বাঙালি ১৯৭১-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন আগরতলায়। আগরতলাটা একবার দেখতেই হবে।
২০০৪ সালে সেই সুযোগ হলো।
'পদ্মা গোমতী' সংগঠন আমন্ত্রণ জানাল হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক শফি আহমেদ, প্রকাশক আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম এবং আমাকে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। তাঁর প্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিমকে নিলেন সপরিবারে, অন্যপ্রকাশের কমল আর তাঁর স্ত্রী, মাজহারও সস্ত্রীক। তখন তাঁর বড় ছেলে অমিয় খুব ছোট। শাওন তখনো মা হননি। বেশ বড় রকমের একটা বহর আমরা রওনা দিলাম। কমলাপুর থেকে বাসে করে লাকসাম। বর্ডারের বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তারা খুবই খাতির করে চা-নাশতা খাওয়ালেন আমাদের। তারপর বর্ডার ক্রস করলাম। ওপারে দেখি রাতুল দেববর্মণের সঙ্গে অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত আর আমাদের শফি ভাই। তিনি দুদিন আগেই আগরতলায় পেঁৗছে গেছেন। আমাদের এগিয়ে নিতে আসছেন বর্ডারে।
শফি আহমেদের আমি বিশেষ ভক্ত। বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর লেখা পড়েছি। বেশির ভাগই প্রবন্ধ। মুগ্ধ হলাম যে বই পড়ে, সেই বইয়ের নাম 'মুক্তো'। জন স্টাইনবেকের 'পার্ল'-এর অনুবাদ। এত স্বচ্ছ সুন্দর প্রাঞ্জল অনুবাদ আমি কমই পড়েছি। আর শফি ভাই এত ভালো মানুষ, এত হাসিমুখের মানুষ, কী বলব। হুমায়ূন ভাইও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। নিজের পছন্দের মানুষদের নানাভাবে খুঁচিয়ে আনন্দ পান তিনি, অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডেকে আনন্দ পান। শফি ভাই ভগবান কৃষ্ণের রংটি পেয়েছেন। হুমায়ূন ভাই তাঁকে ডাকেন 'কালো বুদ্ধিজীবী'।
আমি সাহিত্য নিয়ে কঠিন কঠিন চিন্তাভাবনা করি, হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিককার কথা। তখন মুগ্ধ হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি। সাহিত্যের আলোচনা উঠলেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে কথা বলি। হুমায়ূন ভাই বইমেলায় আমাকে তাঁর 'ফেরা' উপন্যাসটি উপহার দিলেন। অটোগ্রাফের জায়গায় লিখলেন 'আমাদের মানিকবাবুকে'।
আগরতলা কুমিল্লার মতো শহর। একেবারেই সাদামাটা, মফস্বল। শান্ত স্নিগ্ধ সরল টাইপের জীবন মানুষের। কোথাও কোনো হুড়োহুড়ি নেই, সন্ত্রাস মাস্তানি খুনখারাবি নেই। শান্তিময় পরিবেশ চারদিকে। অন্যদের কী হলো জানি না, আগরতলায় ঢুকেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। এই সেই আগরতলা, এখানকার জমিদার রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন। এই সেই আগরতলা, এখানে বসবাস করতেন শচীন দেববর্মণ। এই সেই আগরতলা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রামে যে আগরতলার অবদান ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে থাকবে।
আগরতলায় তখন একটা বইমেলা চলছে। বিকেলবেলা সদলবলে বইমেলায় গেলাম আমরা। বিশাল এলাকাজুড়ে বইমেলা। আমাদের বাংলা একাডেমী বইমেলার মতো ভিড় ধাক্কাধাক্কি নেই। লোকজন কম। ঘুরে ঘুরে বইপত্র দেখছে, কিনছে।
একদিন বইমেলার স্টেজে উঠলাম আমরা। বাংলাদেশি লেখক প্রকাশক। হুমায়ূন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ মজার ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন। আমাদের দিনগুলো কাটছিল এদিক-ওদিক ঘুরে। বড় একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হয়েছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। গাইড আছে সঙ্গে। আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি। দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখছি।
প্রথম দিন বেড়িয়ে ফেরার পর মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে এক শ রুপি অফার করলেন হুমায়ূন ভাই। লোকটি অবাক। কিসের টাকা, দাদা?
আপনি চা-টা খাবেন।
না না, টাকা আমি নেব না।
কেন?
এই ডিউটি করার জন্য সরকার আমাকে মাইনে দিচ্ছে। আমি আপনার টাকা নেব কেন?
আমরা হতভম্ব!
আগরতলার 'নীর মহল' খুব বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র। চারদিকে পানি, মাঝখানে জমিদারবাড়ি। সেটাই এখন পর্যটনকেন্দ্র। স্পিডবোটে করে যেতে হয়। একটা রাত ওখানে কাটালাম আমরা।
আগরতলায় আমার সঙ্গে অদ্ভুত এক মজা করলেন হুমায়ূন ভাই। এমন লজ্জার মধ্যে ফেললেন আমাকে, আমি একেবারে চুপসে গেলাম।
ঘটনা হলো কি, 'পদ্মা গোমতী' থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে একটি হলে। সন্ধ্যার পর বেশ ভালো আয়োজন করা হয়েছে। রাতুল দেববর্মণ, অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত বক্তব্য দিলেন। একে একে আমাদের উত্তরীয় পরানো হলো। আগরতলার কিছু সুধীজন আর আমাদের পুরো দল। মাজহারের ছেলে অমিয় তখন আড়াই-তিন বছরের। ওই বয়সী শিশু যেমন হয় তেমনই। চঞ্চল, ছটফটে। এই এদিকে ছুটছে, এই ওদিকে ছুটছে। মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা চমৎকার মেয়ে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছেলেকে সামলাতে। দুরন্ত শিশুটির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শিশুটি তো আর সাহিত্য কিংবা হুমায়ূন আহমেদ বোঝে না, আগরতলা কিংবা 'পদ্মা গোমতী' বোঝে না। সে তার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু ভাবছেও না, মনেও করছে না। হুমায়ূন ভাই খেয়াল করছিলেন অমিয়র দুরন্তপনা। আমি তাঁর পাশে বসে আছি। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, একটা কাজ করব নাকি?
কী?
অমিয়কে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেব নাকি? (একেবারেই মজা করা অর্থে। কোনো শিশুর গায়ে হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলবেন, ভাবাই যায় না)
আমি থতমত খেয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। কী বলছেন, হুমায়ূন ভাই!
তার মানে তুমি থাপ্পড় মারতে না করছ?
আরে!
ওই পর্যন্তই। অনুষ্ঠান শেষ হলো। খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। আমরা আড্ডা দিতে বসছি, হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় মাজহারকে ডাকলেন। শোনো মাজহার। একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না।
মাজহার তটস্থ। কী কথা স্যার?
গোপন কথা। বলা উচিত না। তবু বলছি। এইটুকু একটা শিশু, তার ব্যাপারে... মানে আমি অমিয়র কথা বলছি।
কী হয়েছে স্যার?
মিলন তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চেয়েছে।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। হায় হায়, বলে কী! নিজে ওরকম একটা প্ল্যান করে এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন সব!
আমার মুখে আর কথা জোটে না। কী বলবো? দলের সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্বর্ণা একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করেছে। মাজহার স্বাভাবিক কারণেই গম্ভীর। আমি কীভাবে তাদেরকে বোঝাবো ঘটনা পুরো উল্টো। একটা সময়ে অবশ্য সবাই বুঝে গেল এটা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা। তবে তারপর যে কদিন আমরা আগরতলায় ছিলাম সে কদিন তো বটেই, ঢাকায় ফিরেও হুমায়ূন ভাই মাঝে মাঝে বলতেন, তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চাইলো মিলন, আর তুমি তাকে কিছুই বললে না মাজহার!
অমিয় এখন বড় হয়েছে। মাজহার স্বর্ণার সংসার উজ্জ্বল করে আরেকজন অমিয় এসেছে। এখনও অমিয়র দিকে তাকালে আগরতলার সেই ঘটনা আমার মনে পড়ে। যতদিন বেঁচে থাকবো, অমিয়কে দেখলেই ঘটনাটা আমার মনে পড়বে।
সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে খালি গলায় চমৎকার দু তিনটা গান গেয়েছিল শাওন। আমরা তো আগে থেকেই শাওনের গানে মুগ্ধ, আগরতলার সুধীজনরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন।
আগরতলায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি আমরা দেখেছিলাম, বইমেলা যেখানে হচ্ছিল সেই সড়কটির নাম 'শচীন দেববর্মণ সড়ক'। এক নির্জন দুপুরে সেই সড়কের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ছিল, 'তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো পথে।'
আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তুই
শচীন দেববর্মণ হিন্দিতে করলেন_
মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তু রামা মেঘ দে
এখনো কানে লেগে আছে সেই সুর।
তাঁর একটি বিখ্যাত গান (আসলে বিখ্যাত বিখ্যাত বারবার বলা ঠিক হচ্ছে না। শচীনকর্তার সব গানই বিখ্যাত)_
বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে
বাজে ভাঙা ঢোল
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানের লাইন বদলে তিনি গাইলেন_
বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলামায়ের কোল।
আমার বহুদিনের শখ ছিল একবার আগরতলায় যাব, শচীনকর্তার বাড়িটা দেখে আসব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেকখানি সংগঠিত হয়েছিল আগরতলায়। শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বাঙালি ১৯৭১-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন আগরতলায়। আগরতলাটা একবার দেখতেই হবে।
২০০৪ সালে সেই সুযোগ হলো।
'পদ্মা গোমতী' সংগঠন আমন্ত্রণ জানাল হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক শফি আহমেদ, প্রকাশক আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম এবং আমাকে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। তাঁর প্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিমকে নিলেন সপরিবারে, অন্যপ্রকাশের কমল আর তাঁর স্ত্রী, মাজহারও সস্ত্রীক। তখন তাঁর বড় ছেলে অমিয় খুব ছোট। শাওন তখনো মা হননি। বেশ বড় রকমের একটা বহর আমরা রওনা দিলাম। কমলাপুর থেকে বাসে করে লাকসাম। বর্ডারের বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তারা খুবই খাতির করে চা-নাশতা খাওয়ালেন আমাদের। তারপর বর্ডার ক্রস করলাম। ওপারে দেখি রাতুল দেববর্মণের সঙ্গে অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত আর আমাদের শফি ভাই। তিনি দুদিন আগেই আগরতলায় পেঁৗছে গেছেন। আমাদের এগিয়ে নিতে আসছেন বর্ডারে।
শফি আহমেদের আমি বিশেষ ভক্ত। বিচ্ছিন্নভাবে তাঁর লেখা পড়েছি। বেশির ভাগই প্রবন্ধ। মুগ্ধ হলাম যে বই পড়ে, সেই বইয়ের নাম 'মুক্তো'। জন স্টাইনবেকের 'পার্ল'-এর অনুবাদ। এত স্বচ্ছ সুন্দর প্রাঞ্জল অনুবাদ আমি কমই পড়েছি। আর শফি ভাই এত ভালো মানুষ, এত হাসিমুখের মানুষ, কী বলব। হুমায়ূন ভাইও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। নিজের পছন্দের মানুষদের নানাভাবে খুঁচিয়ে আনন্দ পান তিনি, অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডেকে আনন্দ পান। শফি ভাই ভগবান কৃষ্ণের রংটি পেয়েছেন। হুমায়ূন ভাই তাঁকে ডাকেন 'কালো বুদ্ধিজীবী'।
আমি সাহিত্য নিয়ে কঠিন কঠিন চিন্তাভাবনা করি, হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিককার কথা। তখন মুগ্ধ হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি। সাহিত্যের আলোচনা উঠলেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে কথা বলি। হুমায়ূন ভাই বইমেলায় আমাকে তাঁর 'ফেরা' উপন্যাসটি উপহার দিলেন। অটোগ্রাফের জায়গায় লিখলেন 'আমাদের মানিকবাবুকে'।
আগরতলা কুমিল্লার মতো শহর। একেবারেই সাদামাটা, মফস্বল। শান্ত স্নিগ্ধ সরল টাইপের জীবন মানুষের। কোথাও কোনো হুড়োহুড়ি নেই, সন্ত্রাস মাস্তানি খুনখারাবি নেই। শান্তিময় পরিবেশ চারদিকে। অন্যদের কী হলো জানি না, আগরতলায় ঢুকেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। এই সেই আগরতলা, এখানকার জমিদার রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন। এই সেই আগরতলা, এখানে বসবাস করতেন শচীন দেববর্মণ। এই সেই আগরতলা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রামে যে আগরতলার অবদান ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে থাকবে।
আগরতলায় তখন একটা বইমেলা চলছে। বিকেলবেলা সদলবলে বইমেলায় গেলাম আমরা। বিশাল এলাকাজুড়ে বইমেলা। আমাদের বাংলা একাডেমী বইমেলার মতো ভিড় ধাক্কাধাক্কি নেই। লোকজন কম। ঘুরে ঘুরে বইপত্র দেখছে, কিনছে।
একদিন বইমেলার স্টেজে উঠলাম আমরা। বাংলাদেশি লেখক প্রকাশক। হুমায়ূন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ মজার ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন। আমাদের দিনগুলো কাটছিল এদিক-ওদিক ঘুরে। বড় একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হয়েছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। গাইড আছে সঙ্গে। আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি। দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখছি।
প্রথম দিন বেড়িয়ে ফেরার পর মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে এক শ রুপি অফার করলেন হুমায়ূন ভাই। লোকটি অবাক। কিসের টাকা, দাদা?
আপনি চা-টা খাবেন।
না না, টাকা আমি নেব না।
কেন?
এই ডিউটি করার জন্য সরকার আমাকে মাইনে দিচ্ছে। আমি আপনার টাকা নেব কেন?
আমরা হতভম্ব!
আগরতলার 'নীর মহল' খুব বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র। চারদিকে পানি, মাঝখানে জমিদারবাড়ি। সেটাই এখন পর্যটনকেন্দ্র। স্পিডবোটে করে যেতে হয়। একটা রাত ওখানে কাটালাম আমরা।
আগরতলায় আমার সঙ্গে অদ্ভুত এক মজা করলেন হুমায়ূন ভাই। এমন লজ্জার মধ্যে ফেললেন আমাকে, আমি একেবারে চুপসে গেলাম।
ঘটনা হলো কি, 'পদ্মা গোমতী' থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে একটি হলে। সন্ধ্যার পর বেশ ভালো আয়োজন করা হয়েছে। রাতুল দেববর্মণ, অনিল ভট্টাচার্য, সমীরণ দত্ত বক্তব্য দিলেন। একে একে আমাদের উত্তরীয় পরানো হলো। আগরতলার কিছু সুধীজন আর আমাদের পুরো দল। মাজহারের ছেলে অমিয় তখন আড়াই-তিন বছরের। ওই বয়সী শিশু যেমন হয় তেমনই। চঞ্চল, ছটফটে। এই এদিকে ছুটছে, এই ওদিকে ছুটছে। মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা চমৎকার মেয়ে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছেলেকে সামলাতে। দুরন্ত শিশুটির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শিশুটি তো আর সাহিত্য কিংবা হুমায়ূন আহমেদ বোঝে না, আগরতলা কিংবা 'পদ্মা গোমতী' বোঝে না। সে তার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু ভাবছেও না, মনেও করছে না। হুমায়ূন ভাই খেয়াল করছিলেন অমিয়র দুরন্তপনা। আমি তাঁর পাশে বসে আছি। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, একটা কাজ করব নাকি?
কী?
অমিয়কে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেব নাকি? (একেবারেই মজা করা অর্থে। কোনো শিশুর গায়ে হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলবেন, ভাবাই যায় না)
আমি থতমত খেয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। কী বলছেন, হুমায়ূন ভাই!
তার মানে তুমি থাপ্পড় মারতে না করছ?
আরে!
ওই পর্যন্তই। অনুষ্ঠান শেষ হলো। খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। আমরা আড্ডা দিতে বসছি, হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় মাজহারকে ডাকলেন। শোনো মাজহার। একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না।
মাজহার তটস্থ। কী কথা স্যার?
গোপন কথা। বলা উচিত না। তবু বলছি। এইটুকু একটা শিশু, তার ব্যাপারে... মানে আমি অমিয়র কথা বলছি।
কী হয়েছে স্যার?
মিলন তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চেয়েছে।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। হায় হায়, বলে কী! নিজে ওরকম একটা প্ল্যান করে এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন সব!
আমার মুখে আর কথা জোটে না। কী বলবো? দলের সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্বর্ণা একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করেছে। মাজহার স্বাভাবিক কারণেই গম্ভীর। আমি কীভাবে তাদেরকে বোঝাবো ঘটনা পুরো উল্টো। একটা সময়ে অবশ্য সবাই বুঝে গেল এটা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা। তবে তারপর যে কদিন আমরা আগরতলায় ছিলাম সে কদিন তো বটেই, ঢাকায় ফিরেও হুমায়ূন ভাই মাঝে মাঝে বলতেন, তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চাইলো মিলন, আর তুমি তাকে কিছুই বললে না মাজহার!
অমিয় এখন বড় হয়েছে। মাজহার স্বর্ণার সংসার উজ্জ্বল করে আরেকজন অমিয় এসেছে। এখনও অমিয়র দিকে তাকালে আগরতলার সেই ঘটনা আমার মনে পড়ে। যতদিন বেঁচে থাকবো, অমিয়কে দেখলেই ঘটনাটা আমার মনে পড়বে।
সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে খালি গলায় চমৎকার দু তিনটা গান গেয়েছিল শাওন। আমরা তো আগে থেকেই শাওনের গানে মুগ্ধ, আগরতলার সুধীজনরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন।
আগরতলায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি আমরা দেখেছিলাম, বইমেলা যেখানে হচ্ছিল সেই সড়কটির নাম 'শচীন দেববর্মণ সড়ক'। এক নির্জন দুপুরে সেই সড়কের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ছিল, 'তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো পথে।'
No comments