শেকড়ের ডাক-হরতালের সমর্থনে বুদ্ধিজীবীরা by ফরহাদ মাহমুদ

জিরবিহীনভাবে সংসদে আনা একটি বিলের মাধ্যমে মাত্র পাঁচ মিনিটে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি) দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। অথচ এর আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধ, আলোচনা, জনমত জরিপ ও প্রকাশিত মতামতে দেখা যায় যে অধিকাংশ মানুষই এই বিভক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সরকার কোনো কিছুকেই আমলে নেয়নি। ডিসিসির বিদায়ী মেয়র ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা এ ব্যাপারে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন


দাখিল করেছেন। আদালত সেটি আমলে নিয়ে এই বিভক্তকরণকে কেন সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না সে ব্যাপারে সরকারের প্রতি রুলনিশি জারি করেছেন। একই সঙ্গে অবিলম্বে ডিসিসি নির্বাচন দিতে নির্বাচন কমিশনকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তারও কারণ দর্শাতে বলেছেন সরকারকে। তা ছাড়া সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংগঠন নানা রকম কর্মসূচি নেয়। মানববন্ধন, গোলটেবিল ও সভা-সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সুধীসমাজ থেকে শুরু করে প্রায় সব মহলেই সরকারের এ সিদ্ধান্তটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এর প্রতিবাদে সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত রবিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতালও আহ্বান করেছিল। এ দেশে হরতালের ভয়াবহ রূপ দেখে অতীতে যে বুদ্ধিজীবীরা হরতালের ব্যাপক বিরোধিতা করেছেন, তাঁদেরই কয়েকজন একটি সংবাদপত্রে যৌথভাবে হরতালকে সমর্থন করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন।
বিষয়টি আমাদের কিছুটা হলেও অবাক করেছে। নিকট অতীতে, বিশেষ করে বিগত দুই দশকে হরতালের যে রূপ আমরা দেখেছি, তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করা যায় না। হরতাল সফল করার জন্য হরতালের আগের রাতে বাসে অগি্নসংযোগ, মানুষ পুড়িয়ে মারাসহ যেসব কার্যক্রম চালানো হয়, তা শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, অমানবিকও। হরতালের দিন নিতান্ত দায়ে পড়া বহু মানুষকে ঘর থেকে বের হতে হয়, তারাও নানা ধরনের লাঞ্ছনার শিকার হয়। গাড়ি ভাঙচুর, যাত্রীদের ধরে পেটানো, উলঙ্গ করে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ করাসহ অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাই আমাদের রয়েছে। গত রবিবারের হরতালের আগের দিনও দুটি বাসে অগি্নসংযোগ করাসহ বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। হরতালের দিনেও কিছু যাত্রীর ওপর হামলা, গাড়ি ও মোটরসাইকেলে অগি্নসংযোগের দৃশ্য আমরা টিভি চ্যানেলগুলোর খবরে দেখতে পেয়েছি। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, দৈনিক ভিত্তিতে শ্রম বিক্রি করা দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ প্রসঙ্গে কিছু না-ইবা বললাম। সাতজন স্বনামখ্যাত বুদ্ধিজীবী কী করে এ হেন একটি হরতালকে সমর্থন দিলেন? হরতাল ছাড়া কি বিএনপির সামনে আন্দোলন-প্রতিবাদ করার আর কোনো পথই খোলা ছিল না? হরতালকে বলা হয় আন্দোলনের শেষ অস্ত্র। সেই শেষ অস্ত্রটি যেভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটিও যে অধিকাংশ মানুষ পছন্দ করেনি_পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষের তেমন প্রতিক্রিয়াই বেশি পাওয়া গেছে। সংসদে যখন বিলটি উত্থাপিত হয়েছিল, যখন সেটি পাস হতে যাচ্ছিল, তখন যদি বিএনপির সদস্যরা সংসদে উপস্থিত থেকে সমস্বরে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতেন, তাহলে কি জনমত আদায়ের ক্ষেত্রে বিএনপি হরতালের চেয়ে বেশি লাভবান হতো না?
আমাদের দেশে বিগত দুই দশকে জাতীয় সংসদকে ঘিরে একটি অদ্ভুত রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। সেটি হচ্ছে, সংসদকে অবজ্ঞা করা, অশ্রদ্ধা করা এবং নিয়মিত সংসদ বর্জন করা। কি বিএনপি, কি আওয়ামী লীগ_যখনই যারা বিরোধী দলে থাকে, তারাই এই রেওয়াজটি পালন করে যায়। ফলে দিন দিন আমাদের জাতীয় সংসদ তার মর্যাদা ও গুরুত্ব হারাচ্ছে। এটি যেমন দেশের জন্য, তেমনি গণতন্ত্রের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর হচ্ছে। সংসদ ক্রমেই স্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। অবশ্য বিএনপি ও সমমনা দলের সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে না গেলেও সংসদ থেকে প্রাপ্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই নিয়ে থাকেন। এবারও বিরোধী দলের বেশ কিছু সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় কয়েক কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির সুযোগ নিয়েছেন। কেউ কেউ অনৈতিকভাবে একাধিক গাড়িও আমদানি করেছেন। এটিকে তাঁরা 'অধিকার' হিসেবে উল্লেখ করেন। দায়িত্ব পালন না করে অধিকার ভোগ করা যায় কি? সংসদ থেকে সব ধরনের সুবিধা নেবেন অথচ সংসদে যাবেন না, আন্দোলনের নামে যখন-তখন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবেন, একের পর এক হরতাল দেবেন_এগুলোকে গণতন্ত্রচর্চা বলা যাবে কি?
বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, বহু আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার হটিয়ে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। এরপর থেকে বলা যায়, নিরবচ্ছিন্নভাবেই জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ তথা সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একের পর এক 'গণতান্ত্রিক সরকার' এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা এগিয়েছে কি? যখনই যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা নির্বাচিত সরকারকে 'গণতান্ত্রিক' না বলে 'স্বৈরাচারী' সরকার হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু কেন? সম্ভবত এ কারণে যে যখনই যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন বা থেকেছেন, তাঁরা বিরোধী দলের প্রতি গণতান্ত্রিক আচরণ করেননি। অথবা একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত সরকারের যেভাবে দেশ পরিচালনা করা উচিত, বাংলাদেশে তা হয় না। বর্তমান মহাজোট সরকার যেভাবে দেশ পরিচালনা করছে, তাতেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাব বড় বেশি প্রকট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণার পরও দেশের সর্বোচ্চ আদালত আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যেতে পারে বলে মতামত দিয়েছিলেন। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর খাটিয়ে মহাজোট সরকার বিরোধী দলের প্রবল আপত্তি এবং সর্বোচ্চ আদালতের মতকেও উপেক্ষা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। ডিসিসির বিভক্তকরণ প্রসঙ্গেও সরকার শুধু বিরোধী দল নয়, জনমতকে উপেক্ষা করে চূড়ান্ত একগুঁয়েমির পরিচয় দিয়েছে। বিরোধী দলের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত 'এলার্জি' থাকায় তারা বিরোধী দলের সঙ্গে মতবিনিময়কে বর্জন করেছে। কিন্তু নাগরিকসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তো তারা আলোচনায় বসতে পারত। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞ আইনজীবীদের মতামত নিতে পারত। গণমাধ্যমে জনমতের যেসব প্রতিফলন দেখা গেছে, সেগুলো আমলে নিতে পারত। কিন্তু তারা এসবের কিছুই করেনি। জনমতকে উপেক্ষার ফল অতীতেও কখনো ভালো হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। বর্তমান সরকারও তার প্রতিফল দেখতে পাবে এবং সম্ভবত, সেই দিন তো খুব বেশি দূরে নয়।
আর সরকারের এ ধরনের অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল ক্রমাগত সংসদ বর্জন করার এবং একের পর এক হরতাল দেওয়ার যে পথ বেছে নিয়েছে, তাকেও সঠিক পথ বলা যাবে না, গণতন্ত্রচর্চাও বলা যাবে না। বরং বিরোধী দলের অসহিষ্ণু ও অগণতান্ত্রিক আচরণ তাদের উদ্দেশ্য নিয়েই নানা ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার চলছে, তাকে বানচাল করার জন্যই বিরোধী দল এ রকম মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিগত জোট সরকারের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দুই ছেলের বিরুদ্ধে হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, বিগত নির্বাচনে তাদের ভরাডুবিরও এটিও ছিল একটি অন্যতম কারণ। ইতিমধ্যে বিদেশের আদালতে তাদের একাধিক অপরাধ প্রমাণিতও হয়েছে। দেশের আদালতেও অনেক মামলা রয়েছে। সরকারি দল থেকে বলা হচ্ছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজের দুই ছেলের অপরাধ ঢাকার জন্যই বর্তমান সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করছেন।
আমরা দেশে অগণতান্ত্রিক আচরণের আর কোনো বাড়াবাড়ি দেখতে চাই না। বরং আমরা চাই, কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল_অতীতের একগুঁয়েমি ছেড়ে প্রকৃত গণতন্ত্রচর্চায় এগিয়ে আসুক। কারণ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি_সব কিছুই নির্ভর করে সুশাসন ও গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার ওপর। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সরকারি ও বিরোধী দলের সবাই ব্যক্তির কল্যাণে নয়, দেশের কল্যাণেই রাজনীতি করছেন। আর দেশের গণমাধ্যম ও সচেতন নাগরিকসমাজকে এখানে অনেকাংশেই রেফারির ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করা সেই ভূমিকাটিকে কেবল প্রশ্নবিদ্ধই করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.