রামিয়া-'ঢোঁড়াইরা ঢোঁড়া সাপের জাত', রামিয়ারা গোখরা by মেহেদী উল্লাহ
রামিয়া আর ফেরে না। অথচ ঢোঁড়াই রাত কাটিয়ে দেয় সে ফিরবে ভেবে। তবে কি পশ্চিমা এই মেয়েটাকে চেনার ভুল! বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মাফ চাইবে তার কাছে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে রামিয়া বসবে উনুনে আগুন দিতে, ঢোঁড়াইয়ের জন্য ভাত রাঁধতে। না না, আজ আবার ভাত রান্না কী? স্নান করে রামিয়া বসবে গম ধুতে ছটপরবের 'ঠেকুয়ার' জন্য। ঢোঁড়াই ধাঙড়টুলি থেকে আনবে বাতাবিলেবু, আখ, সাওজীর দোকান থেকে আনবে গুড় আর ঠেকুয়া
ভাজার তেল।\উঠানে বসে রামিয়াকে নিয়ে আকাশপাতাল ভাবে ঢোঁড়াই। রামিয়ার কাজ এগিয়ে রাখার জন্য সে নিজেই উঠোন নিকাতে বসে গোবরমাটি দিয়ে। রামিয়া বাড়ি ফিরে অবাক হয়ে যাবে। আর যেখানটায় সামুয়র বসে রামিয়ার সঙ্গে ঢলাঢলি করেছিল, সেখানে একটু বেশি করে গোবর দিয়ে দেয়। আর ভাবে, ওই শালাই তো যত নষ্টের গোড়া। তার কথা সে ভুলতে চায়। অথচ শেষমেশ দেখা গেল, সামুয়রকে ঢোঁড়াই ভুলতে পারল না! উল্টো যাকে ঢোঁড়াই মনে রাখতে চেয়েছিল, সেই রামিয়াই তাকে ভুলে গেল।
আসলে রামিয়াকে বুঝতে গেলে ঢোঁড়াইকে চেনা দরকার আগে। ঢোঁড়াই যে পথ ধরে গেছে, উপন্যাসের গন্তব্যও সেদিকে। ঢোঁড়াই একটু একটু এগোয় আর আঁধি ওঠে জীবনে। সেই আঁধিগুলোর স্পন্দন টের পেলেই ধরা যায় সতীনাথ ভাদুড়ীর 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'। ঢোঁড়াই চরিত মানস রচিত হয়েছে তুলসী দাসের 'রামচরিতমানস'-এর আদলে। রামায়ণে যেমন কাণ্ড চিহ্নিত বিভাগ বিভাজন আছে, তেমনি এতেও বাল্যকাণ্ড, পঞ্চায়েতকাণ্ড, রামিয়াকাণ্ড প্রভৃতি। ঢোঁড়াইকে সতীনাথ এ যুগের শ্রীরামচন্দ্র হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।
সেই বিকল্প রামের জীবনে রামিয়া বিচ্ছেদই আমাদের কথা। ঢোঁড়াইকে ছেড়ে রামিয়ার সামুয়রের সঙ্গে যাওয়াটাকে যদি গুরুত্বপূর্ণ ধরি, তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন চলে গেল? চলে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গেলে রামিয়ার ছলনা হয়তো ধরা পড়বে, তাকে নীচও বলা যাবে। আর এই রামিয়াকে তখন অবলীলায় খল-চরিত্র বিবেচনা করা হয়তো সম্ভব। যদি বলি ঢোঁড়াই চরিত্রের শিকড় ভারতের গ্রাম্য জীবনের গভীরে প্রোথিত, তাহলে সেই গ্রাম্য উপন্যাসে তাৎমাটুলী। এখানেই ঢোঁড়াইয়ের জীবনের উদ্ভব, বুনন, যাতে চিড় ধরায় রামিয়া।
দেড় বছর বয়সে ঢোঁড়াইয়ের বাপ মারা যায়। তার মা বুধনী আবার বিয়ে করে বাবুলাল চাপরাসিকে। ঢোঁড়াই মানুষ হতে থাকে গ্রামের দেবস্থানের পূজারি বৌকাবাওয়ার কাছে। তাৎমাটুলীর মেয়েরা অঘ্রানে পশ্চিমে ধান কাটতে যায়। রামিয়া-কাণ্ডের এখানেই শুরু_তাৎমানীদের ধানকাটনীর রাজ্যে যাত্রা। এই পশ্চিম, মুঙ্গের জেলা, গঙ্গা কিনার, কাঢ়াগোলার চেয়েও পশ্চিমে। সেখানেই রামিয়ার দর্শন লাভ করে রবিয়ার বউ। রামিয়ার মা মারা যায় হঠাৎ। রবিয়ার বউ সঙ্গে নিয়ে আসে রামিয়াকে টুলীতে। পশ্চিমবালী রামিয়ার হাস্য-লাস্য ও লচক ভরা জওয়ানিতে মুগ্ধ হয়ে ঢোঁড়াই বিয়ে করে তাকে। ঢোঁড়াইয়ের আশ্রয়দাতা বৌকাবাওয়া এই বিয়ের পর নিরুদ্দেশ হয়। কয়েক মাস পর সামুয়র কিরিস্তান গাঁয়ের পঞ্চকে টাকা খাইয়ে হাত করে রামিয়ার সঙ্গে ঢোঁড়াইয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়। রামিয়াও তাতে সম্মতি দেয়। জানায়, সে সামুয়রকে সাঙ্গা করবে। ঢোঁড়াই সেই রাতে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। সারারাত পাক্কী দিয়ে চলতে চলতে যখন গোঁসাই মাথার ওপর উঠে আসে, তখন সে পেঁৗছে নতুন গ্রাম বিসকান্ধায়। আমরা আর সামনে না এগোই। এরপর যা ঘটেছিল, তা ঢোঁড়াইয়ের আরেক জীবন, ছাগিয়ার সঙ্গে প্রেমঘনিষ্ঠ জীবন, গান্ধীর কংগ্রেস-রাজনীতি ঘেঁষা বৈপ্লবিক জীবন, পালিয়ে বেড়ানোর জীবন। আর মিছে মরীচিকা, অ্যান্টনিকে রামিয়ার ছেলে ভেবে ভুল ভরসায় আশান্বিত অথচ পড়ন্ত বিকেলের জীবন। যে পর্যায়ে এসে ঢোঁড়াইয়ের জীবনের সার দাঁড়াল, 'ঢোঁড়াইরা ঢোঁড়া সাপের জাত। যতই খাবলাক, ছোবল মারুক, তড়পাক, এক মরলে যদি ওদের বিষদাঁত গজায়।'
সতীনাথ ভাদুড়ী রামিয়াকে নিয়ে এমন কোনো মন্তব্য করলেন না। ঢোঁড়াই যে স্টেজে দাঁড়িয়ে সতীনাথের এমন কার্পণ্যের শিকার, সেখানে এমন পরিণতির জন্য দায়ী বলব কাকে? আমরা দাঁড় করিয়ে দিতে পারি আসামির কাঠগড়ায় রামিয়াকে। তার বিচ্ছেদই ঢোঁড়াইকে ঠেলে দিয়েছে উচ্ছেদে। ছলনাময়ী, খল, নীচ কিংবা এটাই প্রকৃতি প্রদত্ত স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা। এই রামিয়াকে আমরা বলতে পারি গোখরা। কারণ, তার ছোবলে, দংশনের বিষে নীল হয়েছে ঢোঁড়াইয়ের জীবন। এ জন্যই ঢোঁড়াই ঢোঁড়া সাপের জাত।
সতীনাথ এমন এক জীবনকে হাজির করেছেন, যে জীবনে শুধুই আঘাত আর বিচ্ছেদ। বারবার ঢোঁড়াই জীবনে আশ্রয় খোঁজে। পায় না। সব আঘাতের মধ্যে একেবারেই মেনে নেওয়ার মতো ছিল না রামিয়া-বিচ্ছেদ। তাই তো সে ঘর ছাড়ে।
তাৎমাটুলীর নিজের মতো করে সংস্কৃতি আছে, রীতি-রেওয়াজ আছে, আচার আছে, জাতিত্ব আছে। সেই সংস্কৃতির বলয়ে রামিয়া অপর। তাৎমাটুলীর মেয়েদের লোটা নিয়ে টয়লেটে যাওয়ার নিয়ম নেই। এটাকে তারা পুরুষের সামনে লজ্জা হিসেবে জানে। অথচ রামিয়া সেই রীতি ভঙ্গ করে প্রথম ছোবলটা মারল। সে মহতোগিন্নীর শাসন না মেনে লোটা নিয়েই ময়দানে যাওয়ার জন্য বিবাদ বাধায় তার সঙ্গে। কারণ, তাদের পশ্চিমে জল নিয়েই ময়দানে ঢোকে মেয়েরা। এটাই হচ্ছে এক সংস্কৃতি দ্বারা অন্য সংস্কৃতিকে আঘাত। এই আঘাতটাই বড় হয়ে দেখা দিল ঢোঁড়াই, অর্থাৎ 'এ যুগের' রামচন্দ্রের জীবনে। এ অঞ্চলের মানুষ রামচন্দ্রের জীবন আর রামায়ণের আদর্শ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত।
রামিয়ায় বিশদ মনস্তাত্তি্বক কোনো যুক্তি নেই, যা রোহিনীতে আছে, বিনোদিনীতে আছে, কিরণময়ী কিংবা কুসুমে আছে। আর মনস্তাত্তি্বক জটিলতা দিয়ে সতীনাথ রামিয়াকে বুঝতেও চান না। রামিয়াকে পছন্দ করেই ঘরে তুলেছিল ঢোঁড়াই। অথচ এক বছর পার না হতেই পরপুরুষের প্রেমে মশগুল, যেখানে রামিয়ার পেটে ঢোঁড়াইয়েরই আগত সন্তান। ঢোঁড়াইয়ের একটি মাত্র দুর্বল জায়গা_সামুয়রের মতো গল্প করতে পারে না। এ কথা ঠিক, নারী বা পুরুষ কিসের গুণে কোন পুরুষের প্রেমে পড়ে, বলা কঠিন। ঢোঁড়াইয়ের পছন্দ ছিল না রামিয়া সামুয়রের সঙ্গে মিশুক, কথা বলুক, হাসুক। অথচ একদিন রাতের আঁধারে গিয়ে দেখল, রামিয়া আর সামুয়র দাওয়ায় বসে গল্প করছে, ঢলাঢলিও কী? সেখান থেকেই ঢোঁড়াইয়ের সন্দেহ। সে রামিয়াকে বলে, আর যদি কোনোদিন সামুয়রের সঙ্গে কথা বলতে দেখি, তবে ছাল ছিঁড়ে নেব। রামিয়া ভয় তো পায়ই না, উল্টো প্রশ্ন ছোড়ে_কেন? জবাবে রামিয়ার মুখে, মাথায় চড়চাপড় মারে ঢোঁড়াই। রামিয়া রাগে, নয়তো অভিমানে, চলে যায় রবিয়ার বউয়ের বাড়ি! অথচ চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান। রামিয়ার জন্য সারা রাত অপেক্ষা করে ঢোঁড়াই। সে আর ফেরে না। উল্টো পঞ্চায়েত ডাকে ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য। সামুয়র পঞ্চায়েতকে হাত করে নেয় টাকা খাইয়ে, আর রবিয়ার বউ জানিয়ে দেয়, রামিয়া ঢোঁড়াইকে ছাড়তে রাজি। অন্য দৃষ্টিতে দেখলে এতে করে রামিয়ার স্বাধীনচেতা মানসিকতারও জয় ঘটে। সমাজ যাকে স্বাভাবিক বলে স্বীকার করে না তা ব্যক্তির অন্তর্গত মুক্তিরও দিক বটে।
ঢোঁড়াই তাৎমাটুলী ছাড়ে। পা বাড়ায় অনিশ্চিত জীবনে। রামিয়াকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা কি এক চড়থাপড়ের কারণেই ভেঙে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ঢোঁড়াইয়ের কাছেও ছিল জটিল। ছিল না প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রকাশ করার মতো ভাষা। তবু খানিকটা প্রকাশ, 'থেঁতলে, কুটে, পিষে, চটকে, ছেঁচে ফেলতে ইচ্ছে করে (রামিয়াকে) হারামজাদীর দেহটাকে; পা দিয়ে নড়ালেও নড়ে না...।'
ঢোঁড়াই চলে যাওয়ার পর রামিয়া তার জন্য অপেক্ষা করেনি, এমনকি আক্ষেপও না। সেই দৃশ্য অবশ্য সতীনাথ ছেঁটে দিয়েছেন। বরং পাওয়া গেল, রামিয়া সামুয়রকে ঠিকই বিয়ে করেছিল। আর, একটা মরা ছেলে জন্ম দিয়ে মারাও গেল শেষে।
ঢোঁড়াই জানত না, রামিয়া মারা গেছে। ফের স্বপ্ন দেখেছিল ইস্কুলিয়া অ্যান্টনিকে নিজের এবং রামিয়ার ছেলে ভেবে। ১৫ বছর পর অ্যান্টনির হাত ধরে রামিয়ার আশায় তাৎমাটুলীতে এসেছিল ঢোঁড়াই। এসে দেখে, অ্যান্টনির মা রামিয়া নয়। আর তাই অ্যান্টনি তার ছেলে নয়। এ মর্লি সাহেবের বাড়ির সেই ডাকসাইটে আয়াটা।
ততক্ষণে আমাদের বুঝতে বাকি নেই, রামিয়ারা বিষধর গোখরা সাপ। অ্যান্টনির মায়ের কথায় তা প্রমাণিত হয়। সে ঢোঁড়াইকে বলে, 'সেই মেয়েটার (রামিয়া) দোষ ছিল কি না-ছিল, ভগবান জানেন।' ঠিকই তো বলেছে অ্যান্টনির মা_গোখরা কাউকে ছোবল দেবে, আর সেই ব্যক্তি যদি টেরই পেল, তো বিষদাঁত বসবে কিভাবে?
আসলে রামিয়াকে বুঝতে গেলে ঢোঁড়াইকে চেনা দরকার আগে। ঢোঁড়াই যে পথ ধরে গেছে, উপন্যাসের গন্তব্যও সেদিকে। ঢোঁড়াই একটু একটু এগোয় আর আঁধি ওঠে জীবনে। সেই আঁধিগুলোর স্পন্দন টের পেলেই ধরা যায় সতীনাথ ভাদুড়ীর 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'। ঢোঁড়াই চরিত মানস রচিত হয়েছে তুলসী দাসের 'রামচরিতমানস'-এর আদলে। রামায়ণে যেমন কাণ্ড চিহ্নিত বিভাগ বিভাজন আছে, তেমনি এতেও বাল্যকাণ্ড, পঞ্চায়েতকাণ্ড, রামিয়াকাণ্ড প্রভৃতি। ঢোঁড়াইকে সতীনাথ এ যুগের শ্রীরামচন্দ্র হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।
সেই বিকল্প রামের জীবনে রামিয়া বিচ্ছেদই আমাদের কথা। ঢোঁড়াইকে ছেড়ে রামিয়ার সামুয়রের সঙ্গে যাওয়াটাকে যদি গুরুত্বপূর্ণ ধরি, তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন চলে গেল? চলে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গেলে রামিয়ার ছলনা হয়তো ধরা পড়বে, তাকে নীচও বলা যাবে। আর এই রামিয়াকে তখন অবলীলায় খল-চরিত্র বিবেচনা করা হয়তো সম্ভব। যদি বলি ঢোঁড়াই চরিত্রের শিকড় ভারতের গ্রাম্য জীবনের গভীরে প্রোথিত, তাহলে সেই গ্রাম্য উপন্যাসে তাৎমাটুলী। এখানেই ঢোঁড়াইয়ের জীবনের উদ্ভব, বুনন, যাতে চিড় ধরায় রামিয়া।
দেড় বছর বয়সে ঢোঁড়াইয়ের বাপ মারা যায়। তার মা বুধনী আবার বিয়ে করে বাবুলাল চাপরাসিকে। ঢোঁড়াই মানুষ হতে থাকে গ্রামের দেবস্থানের পূজারি বৌকাবাওয়ার কাছে। তাৎমাটুলীর মেয়েরা অঘ্রানে পশ্চিমে ধান কাটতে যায়। রামিয়া-কাণ্ডের এখানেই শুরু_তাৎমানীদের ধানকাটনীর রাজ্যে যাত্রা। এই পশ্চিম, মুঙ্গের জেলা, গঙ্গা কিনার, কাঢ়াগোলার চেয়েও পশ্চিমে। সেখানেই রামিয়ার দর্শন লাভ করে রবিয়ার বউ। রামিয়ার মা মারা যায় হঠাৎ। রবিয়ার বউ সঙ্গে নিয়ে আসে রামিয়াকে টুলীতে। পশ্চিমবালী রামিয়ার হাস্য-লাস্য ও লচক ভরা জওয়ানিতে মুগ্ধ হয়ে ঢোঁড়াই বিয়ে করে তাকে। ঢোঁড়াইয়ের আশ্রয়দাতা বৌকাবাওয়া এই বিয়ের পর নিরুদ্দেশ হয়। কয়েক মাস পর সামুয়র কিরিস্তান গাঁয়ের পঞ্চকে টাকা খাইয়ে হাত করে রামিয়ার সঙ্গে ঢোঁড়াইয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়। রামিয়াও তাতে সম্মতি দেয়। জানায়, সে সামুয়রকে সাঙ্গা করবে। ঢোঁড়াই সেই রাতে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। সারারাত পাক্কী দিয়ে চলতে চলতে যখন গোঁসাই মাথার ওপর উঠে আসে, তখন সে পেঁৗছে নতুন গ্রাম বিসকান্ধায়। আমরা আর সামনে না এগোই। এরপর যা ঘটেছিল, তা ঢোঁড়াইয়ের আরেক জীবন, ছাগিয়ার সঙ্গে প্রেমঘনিষ্ঠ জীবন, গান্ধীর কংগ্রেস-রাজনীতি ঘেঁষা বৈপ্লবিক জীবন, পালিয়ে বেড়ানোর জীবন। আর মিছে মরীচিকা, অ্যান্টনিকে রামিয়ার ছেলে ভেবে ভুল ভরসায় আশান্বিত অথচ পড়ন্ত বিকেলের জীবন। যে পর্যায়ে এসে ঢোঁড়াইয়ের জীবনের সার দাঁড়াল, 'ঢোঁড়াইরা ঢোঁড়া সাপের জাত। যতই খাবলাক, ছোবল মারুক, তড়পাক, এক মরলে যদি ওদের বিষদাঁত গজায়।'
সতীনাথ ভাদুড়ী রামিয়াকে নিয়ে এমন কোনো মন্তব্য করলেন না। ঢোঁড়াই যে স্টেজে দাঁড়িয়ে সতীনাথের এমন কার্পণ্যের শিকার, সেখানে এমন পরিণতির জন্য দায়ী বলব কাকে? আমরা দাঁড় করিয়ে দিতে পারি আসামির কাঠগড়ায় রামিয়াকে। তার বিচ্ছেদই ঢোঁড়াইকে ঠেলে দিয়েছে উচ্ছেদে। ছলনাময়ী, খল, নীচ কিংবা এটাই প্রকৃতি প্রদত্ত স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা। এই রামিয়াকে আমরা বলতে পারি গোখরা। কারণ, তার ছোবলে, দংশনের বিষে নীল হয়েছে ঢোঁড়াইয়ের জীবন। এ জন্যই ঢোঁড়াই ঢোঁড়া সাপের জাত।
সতীনাথ এমন এক জীবনকে হাজির করেছেন, যে জীবনে শুধুই আঘাত আর বিচ্ছেদ। বারবার ঢোঁড়াই জীবনে আশ্রয় খোঁজে। পায় না। সব আঘাতের মধ্যে একেবারেই মেনে নেওয়ার মতো ছিল না রামিয়া-বিচ্ছেদ। তাই তো সে ঘর ছাড়ে।
তাৎমাটুলীর নিজের মতো করে সংস্কৃতি আছে, রীতি-রেওয়াজ আছে, আচার আছে, জাতিত্ব আছে। সেই সংস্কৃতির বলয়ে রামিয়া অপর। তাৎমাটুলীর মেয়েদের লোটা নিয়ে টয়লেটে যাওয়ার নিয়ম নেই। এটাকে তারা পুরুষের সামনে লজ্জা হিসেবে জানে। অথচ রামিয়া সেই রীতি ভঙ্গ করে প্রথম ছোবলটা মারল। সে মহতোগিন্নীর শাসন না মেনে লোটা নিয়েই ময়দানে যাওয়ার জন্য বিবাদ বাধায় তার সঙ্গে। কারণ, তাদের পশ্চিমে জল নিয়েই ময়দানে ঢোকে মেয়েরা। এটাই হচ্ছে এক সংস্কৃতি দ্বারা অন্য সংস্কৃতিকে আঘাত। এই আঘাতটাই বড় হয়ে দেখা দিল ঢোঁড়াই, অর্থাৎ 'এ যুগের' রামচন্দ্রের জীবনে। এ অঞ্চলের মানুষ রামচন্দ্রের জীবন আর রামায়ণের আদর্শ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত।
রামিয়ায় বিশদ মনস্তাত্তি্বক কোনো যুক্তি নেই, যা রোহিনীতে আছে, বিনোদিনীতে আছে, কিরণময়ী কিংবা কুসুমে আছে। আর মনস্তাত্তি্বক জটিলতা দিয়ে সতীনাথ রামিয়াকে বুঝতেও চান না। রামিয়াকে পছন্দ করেই ঘরে তুলেছিল ঢোঁড়াই। অথচ এক বছর পার না হতেই পরপুরুষের প্রেমে মশগুল, যেখানে রামিয়ার পেটে ঢোঁড়াইয়েরই আগত সন্তান। ঢোঁড়াইয়ের একটি মাত্র দুর্বল জায়গা_সামুয়রের মতো গল্প করতে পারে না। এ কথা ঠিক, নারী বা পুরুষ কিসের গুণে কোন পুরুষের প্রেমে পড়ে, বলা কঠিন। ঢোঁড়াইয়ের পছন্দ ছিল না রামিয়া সামুয়রের সঙ্গে মিশুক, কথা বলুক, হাসুক। অথচ একদিন রাতের আঁধারে গিয়ে দেখল, রামিয়া আর সামুয়র দাওয়ায় বসে গল্প করছে, ঢলাঢলিও কী? সেখান থেকেই ঢোঁড়াইয়ের সন্দেহ। সে রামিয়াকে বলে, আর যদি কোনোদিন সামুয়রের সঙ্গে কথা বলতে দেখি, তবে ছাল ছিঁড়ে নেব। রামিয়া ভয় তো পায়ই না, উল্টো প্রশ্ন ছোড়ে_কেন? জবাবে রামিয়ার মুখে, মাথায় চড়চাপড় মারে ঢোঁড়াই। রামিয়া রাগে, নয়তো অভিমানে, চলে যায় রবিয়ার বউয়ের বাড়ি! অথচ চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান। রামিয়ার জন্য সারা রাত অপেক্ষা করে ঢোঁড়াই। সে আর ফেরে না। উল্টো পঞ্চায়েত ডাকে ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য। সামুয়র পঞ্চায়েতকে হাত করে নেয় টাকা খাইয়ে, আর রবিয়ার বউ জানিয়ে দেয়, রামিয়া ঢোঁড়াইকে ছাড়তে রাজি। অন্য দৃষ্টিতে দেখলে এতে করে রামিয়ার স্বাধীনচেতা মানসিকতারও জয় ঘটে। সমাজ যাকে স্বাভাবিক বলে স্বীকার করে না তা ব্যক্তির অন্তর্গত মুক্তিরও দিক বটে।
ঢোঁড়াই তাৎমাটুলী ছাড়ে। পা বাড়ায় অনিশ্চিত জীবনে। রামিয়াকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা কি এক চড়থাপড়ের কারণেই ভেঙে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ঢোঁড়াইয়ের কাছেও ছিল জটিল। ছিল না প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রকাশ করার মতো ভাষা। তবু খানিকটা প্রকাশ, 'থেঁতলে, কুটে, পিষে, চটকে, ছেঁচে ফেলতে ইচ্ছে করে (রামিয়াকে) হারামজাদীর দেহটাকে; পা দিয়ে নড়ালেও নড়ে না...।'
ঢোঁড়াই চলে যাওয়ার পর রামিয়া তার জন্য অপেক্ষা করেনি, এমনকি আক্ষেপও না। সেই দৃশ্য অবশ্য সতীনাথ ছেঁটে দিয়েছেন। বরং পাওয়া গেল, রামিয়া সামুয়রকে ঠিকই বিয়ে করেছিল। আর, একটা মরা ছেলে জন্ম দিয়ে মারাও গেল শেষে।
ঢোঁড়াই জানত না, রামিয়া মারা গেছে। ফের স্বপ্ন দেখেছিল ইস্কুলিয়া অ্যান্টনিকে নিজের এবং রামিয়ার ছেলে ভেবে। ১৫ বছর পর অ্যান্টনির হাত ধরে রামিয়ার আশায় তাৎমাটুলীতে এসেছিল ঢোঁড়াই। এসে দেখে, অ্যান্টনির মা রামিয়া নয়। আর তাই অ্যান্টনি তার ছেলে নয়। এ মর্লি সাহেবের বাড়ির সেই ডাকসাইটে আয়াটা।
ততক্ষণে আমাদের বুঝতে বাকি নেই, রামিয়ারা বিষধর গোখরা সাপ। অ্যান্টনির মায়ের কথায় তা প্রমাণিত হয়। সে ঢোঁড়াইকে বলে, 'সেই মেয়েটার (রামিয়া) দোষ ছিল কি না-ছিল, ভগবান জানেন।' ঠিকই তো বলেছে অ্যান্টনির মা_গোখরা কাউকে ছোবল দেবে, আর সেই ব্যক্তি যদি টেরই পেল, তো বিষদাঁত বসবে কিভাবে?
No comments