মতবিনিময় সভায় কম্পানি করদাতারা-আইনের অস্পষ্টতায় বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত সরকার

প্রচলিত করদান প্রক্রিয়াকে অনেক বেশি জটিল মনে করছেন কম্পানি করদাতারা। এতে একদিকে যেমন করদাতাদের ভোগান্তি বাড়ছে, অন্যদিকে প্রকৃত রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া আইনের অস্পষ্টতা ও সংস্কারের অভাবে বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। গতকাল রাজস্ব বোর্ডের এক মতবিনিময় সভায় এ অভিমত ব্যক্ত করেন কম্পানি করদাতারা। ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে নানাবিধ কার্যক্রম পালন
\করে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু কম্পানি করদাতাদের কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে ছিল না তেমন কোনো উদ্যোগ। এবারই প্রথম কম্পানি করদাতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসল রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি, কম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও আয়কর আইনজীবীরা এই মতবিনিময় সভায় অংশ নেন।
সভায় প্রাতিষ্ঠানিক করদাতারা কর দেওয়া সম্পর্কে তাঁদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। তাঁরা বলেন, প্রতিষ্ঠানের আয়কর বিবরণী (রিটার্ন) জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবছরই নানা ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন করদাতারা। তাঁরা এ ধরনের জটিলতা দূর করার জন্য রাজস্ব বোর্ডের হস্তক্ষেপ কামনা করে বক্তব্য দেন।
সভায় করদাতারা কর-সংক্রান্ত অধিকাংশ আইনের বিধি-বিধানকে দুর্বোধ্য বলে উল্লেখ করেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মোট মুনাফার বিষয়ে রাজস্ব বোর্ডের প্রচলিত বিধানের কড়া সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে প্রতিসংহার করের (উইথহেল্ডিং ট্যাঙ্) বিধানকে আরো সহজ করার প্রস্তাব দেন। তা ছাড়া ব্যাংকের মন্দ ঋণ-সংক্রান্ত সংরক্ষিত অর্থের ব্যাপারে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের সমন্বয় সাধনের প্রস্তাব করেন কম্পানি করদাতারা।
সভায় এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল আমীন বলেন, 'প্রতিবার কর দিতে গিয়ে মনে হয় এবারই শেষ কর দিচ্ছি। এত বেশি জটিলতার মধ্যে কর প্রদান করাটা বেশ কঠিন কাজ বলে মনে হয়। মনে হয় এটাই ব্যবসায়ীদের একমাত্র কাজ।'
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ওবায়দুর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা কর দিতে চান; কিন্তু কর দেওয়ার পরিবেশটা সৃষ্টি করতে হবে। কর দিতে নানা রকম ভীতি কাজ করে কম্পানিগুলোর মধ্যে। করদাতা এবং রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে যে দূরত্ব বিরাজ করছে, সেটি কমালে রাজস্ব আদায় আরো বাড়বে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে কর্মসংস্থান ব্যাংকের চেয়ারম্যান এম মনিরুজ্জামান খন্দকার অভিযোগ করেন, রাজস্ব বোর্ড ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এই প্রতিষ্ঠানের ভীতি রয়েছে; কিন্তু অন্যদের হয়রানি করে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আইনের কোনো বিষয়ে সমস্যা রয়েছে, তা খুঁজে বের করে পরিবর্তন করতে হবে।
করদাতাদের বক্তব্য আমলে নিয়েছেন রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা। বোর্ডের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'প্রথমবারের মতো রাজস্ব বোর্ড এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করপ্রদান প্রক্রিয়াকে সহজতর করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
সভায় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য (করনীতি) আমিনুর রহমান 'করপোরেট কমপ্লায়েন্স' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। উপস্থাপিত প্রবন্ধে সাবেক এই সদস্য বলেন, দেশের আয়কর রাজস্বে কম্পানি করদাতাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। দেশের মোট আয়করদাতাদের মধ্যে কম্পানি করদাতা ১.৮৪ শতাংশ এবং মোট আয়কর আহরণে এ খাতের অবদান ৫৬ শতাংশ। এ ছাড়া কর আদায়ে কর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন দুর্বল দিক চিহ্নিত করে এর সমাধানের বিষয় নিয়েও তিনি আলোচনা করেন। সভায় 'কম্পানি'স টাঙ্ কমপ্লায়েন্স' শীর্ষক অন্য একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সহসভাপতি মো. শাহাদাত হোসেন।
রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কর প্রশাসন ও পরিচলনা) এম এ কাদের সরকারের সঞ্চালনায় সভায় ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া, এয়ারটেল প্রতিনিধি এস কে মুখোপাধ্যায়, আইসিএবির সভাপতি পারভীন মাহমুদ, ব্র্যাক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহাবুবুর রহমান, ঢাকা ট্যাকসেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমিজ উদ্দিন আহমেদ, এফবিসিসিএর প্রতিনিধি হুমায়ন কবিরসহ বিভিন্ন কম্পানির প্রতিনিধি ও রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.