জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা-খালেদা জিয়া হাইকোর্টে গিয়ে জামিন নিলেন

বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আট সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই প্রথম সাবেক কোনো সরকারপ্রধান আগাম জামিনের জন্য সশরীরে হাইকোর্টে হাজির হলেন।\খালেদা জিয়া গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে হাইকোর্টে সশরীরে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানান। বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ আবেদন মঞ্জুর
\করেন। অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেছিল।আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি_বাংলাদেশের এই তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান তিন নেতার মধ্যেও কোনো নেতার হাইকোর্টে সরাসরি হাজির হয়ে জামিন নেওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এর আগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও সেসব মামলায় তিনি কোনো দিন হাইকোর্টে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেননি।
আদালত খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন মঞ্জুর করে বলেন, 'অন্যান্য সাধারণ মামলার মতোই এ মামলা দেখতে চাই। আইন সবার জন্যই সমান।'
গতকাল বিকেল পৌনে ৩টায় খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানিতে খালেদা জিয়ার পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও অ্যাডভোকেট আহসানুল করীম এবং রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির অংশ নেন।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আদালতে বলেন, 'অভিযোগ, আমি কাজ না করে জমি কিনেছি। এটা একটা প্রাইভেট ট্রাস্ট। দুদকের এখানে স্বার্থ কোথায়?' আদালত বলেন, 'আপনি তো আগাম জামিনের জন্য এসেছেন।' ব্যারিস্টার রফিক হ্যাঁ-সূচক জবাব দেওয়ার পর আদালত বলেন, 'এখন সরকারের বক্তব্য শুনি।'
সরকারের পক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির আদালতে বলেন, 'সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে বলতে চাই, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী তা দেখতে হবে।' আদালত বলেন, 'তিনি তো আগাম জামিনের জন্য এসেছেন।' এ সময় মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, জামিনের জন্য যে আবেদন দিয়েছেন তাতে বলেছেন, নিম্ন আদালতের প্রতি তাঁর আস্থা নেই। এখন তো বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়েছে। তিনি নিম্ন আদালতে গেলে তো জামিন পেতে পারেন।
এ পর্যায়ে মমতাজ উদ্দিন ফকির মামলার এজাহার থেকে কিছু অংশ পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ঘটনা ২০০৫ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। তারেক রহমান, বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়াসহ বিএনপির বিভিন্ন নেতার হিসাব থেকে প্রায় ছয় কোটি ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ টাকা তুলে সোনালী ব্যাংকে ট্রাস্টের হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) জমা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত চারবার চিঠি দেওয়া হলেও খালেদা জিয়া কোনো জবাব দেননি।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, খালেদা জিয়া ট্রাস্টের হিসাবে চেকের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি ও ২৭ লাখ টাকা জমা করেন। পরে ওই তহবিল থেকে ছয় কোটি ৫২ লাখ সাত হাজার টাকা দিয়ে কাকরাইলে ৪২ কাঠা জমি কেনেন। জমির মূল্য হিসেবে সুরাইয়া খানমের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হিসাবে ওই টাকা জমা করা হয়। ওই জমি এখনো ট্রাস্টের নামে মিউটেশন (নামজারি) করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, ছয় কোটি ৫২ লাখ সাত হাজার টাকা দিয়ে জমি কেনা হয়েছে। এই টাকা ছাড়াও অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা সুরাইয়া খানমের কাছে পে-অর্ডারের মাধ্যমে পাঠানো হয়। কিন্তু কেন তাঁকে এই অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হয়েছে এবং এ টাকার উৎস কী_এর কোনো ব্যাখ্যা দুদকের তদন্ত কমিটির কাছে দিতে পারেননি সুরাইয়া খানম।
মমতাজ উদ্দিন ফকির খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, 'তিনি তো একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁর হিসাবে স্বচ্ছতা থাকা দরকার।' জবাবে আদালত বলেন, প্রত্যেকেরই স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন।
এই পর্যায়ে আদালত মমতাজ উদ্দিন ফকিরকে উদ্দেশ করে বলেন, 'মিউটেশন না করার কথা বলছেন, এ বক্তব্য তো আপনার বিপক্ষে যাচ্ছে। তবে নিম্ন আদালতের প্রতি আস্থাহীনতা নিয়ে আপনার বক্তব্য ঠিক আছে। আবেদনে নিম্ন আদালতের প্রতি অনাস্থা জানানোর কথা ঠিক হয়নি।' আদালত রফিক-উল হককে আবেদনের এ অংশটুকু সংশোধন করতে বলেন। তাৎক্ষণিক রফিক-উল হক আবেদনের ওই অংশটুকু কেটে দেন।
এরপর আদালত বলেন, আগাম জামিনের জন্য যেসব যুক্তি থাকে, এর সব এ মামলায় রয়েছে। আদালত আরো বলেন, আমরা ছয় সপ্তাহের জামিন দিচ্ছি। তখন রফিক-উল হক বলেন, 'অভিযোগ গঠনের আগ পর্যন্ত জামিন দিন। একই সঙ্গে রুল জারি করুন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করুন।'
জবাবে আদালত বলেন, 'এ মামলায় এখনো চার্জশিট হয়নি। আগাম জামিন নিয়ে আপিল বিভাগের রায় আছে। ওই রায়ের পর রুল দেওয়া যায় না। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এটা একটা সাধারণ মামলা। অন্যান্য সাধারণ মামলা যেভাবে দেখি, এ মামলাকেও সেভাবে দেখতে চাই। আমরা ব্যতিক্রম করতে চাই না। আইন সবার জন্য সমান।'
এই পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী আহসানুল করীম ছয় মাসের জামিন দেয়ার আবেদন করেন। এ বক্তব্য সমর্থন করে রফিক-উল হক বলেন, 'আমাদের সবার আবেদন, জামিন ছয় মাস পর্যন্ত করে দিন।' তখন আদালত বলেন, 'আমরা আরেকটু বাড়িয়ে আট সপ্তাহ করে দিচ্ছি।' এরপর আদালত আট সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
এ আদেশের কয়েক মিনিট পর খালেদা জিয়া বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে আদালতকক্ষ ত্যাগ করেন। খালেদা জিয়া আদালতকক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় আদালত ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে উদ্দেশে করে বলেন, আদালতকক্ষে যেন কেউ স্লোগান না দেয়। এরপর রফিক-উল হক স্লোগান না দেওয়ার অনুরোধ জানান।
এর আগে সকালে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুস কাজল, কায়সার কামালসহ আইনজীবীরা জামিনের আবেদন দাখিলের জন্য আদালতের অনুমতি চান। একই সঙ্গে আবেদনটি কার্যতালিকাভুক্তির আবেদন জানান। এ আবেদনে আদালত সম্পূরক দৈনন্দিন কার্যতালিকা তৈরির নির্দেশ দেন। এ আদেশে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন সংবলিত সম্পূরক কার্যতালিকা তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে আদালত দুপুর ২টায় এ আবেদনের শুনানির সময় নির্ধারণ করেন।
দুপুর ২টার আগে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা আদালতকক্ষে জড়ো হতে থাকেন। টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবদিন, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, আহসানুল করীম, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীমসহ শতাধিক আইনজীবী আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, আবদুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকতউল্লাহ বুলু, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আবদুস সালাম, খায়রুল কবীর খোকন, ইলিয়াস আলী, হাবিব-উন-নবী সোহেল, খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সোহেল প্রমুখ আদালতকক্ষে উপস্থিত হন।
দুপুর ২টা ৮ মিনিটে সংশ্লিষ্ট আদালতের দুই বিচারপতি এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। এ সময় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আদালতকে বলেন, জামিনের আবেদনকারী খালেদা জিয়া মৎস্য ভবন পর্যন্ত এসেছেন। তাই একটু সময় দেওয়া হোক।
এ সময় আদালত কার্যতালিকার অন্যান্য মামলার শুনানি শুরু করেন। তবে বেশির ভাগ মামলার আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা আদালতকক্ষে ঢুকতে পারেননি। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সেলিম আদালতকে বলেন, আদালতে জায়গা নেই। সাধারণ মানুষ ঢুকতে পারছে না। এর ফলে আদালতকে চুপচাপ বসে থাকতে হয়।
আইনজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের উপস্থিতিতে আদালতকক্ষে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না।
একপর্যায়ে আদালতে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। আদালতে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেক জুনিয়র আইনজীবী হৈচৈ করতে থাকায় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সবাইকে চুপ করতে বলেন। তিনি ধমকের সুরে বলেন, 'এটা মাছের বাজার নয়। দয়া করে কোর্টকে কাজ করতে দিন।' ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও আইনজীবীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন।
দুপুর ২টা ৩৪ মিনিটে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভাপতি শিরীন সুলতানা এমপি খালেদা জিয়াকে নিয়ে আদালতকক্ষের সামনে হাজির হন। আদালতকক্ষে ঢোকার মতো পরিবেশ না থাকায় খালেদা জিয়া আদালতকক্ষে ঢুকতে পারছিলেন না। এ কারণে সিনিয়র আইনজীবীরা জুনিয়র আইনজীবীদের জায়গা ছেড়ে খালেদা জিয়ার ঢোকার রাস্তা করে দেওয়ার অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু জুনিয়র আইনজীবীরা সিনিয়রদের কথা না শুনে যাঁর যাঁর জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীরা আইনজীবীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে খালেদা জিয়াকে আদালতকক্ষে ঢোকার সুযোগ করে দেন। আদালতকক্ষের দরজা থেকে বিচারকদের সামনে যেতে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় সেকেন্ড সময় লাগে, সেখানে ভিড়ের কারণে খালেদা জিয়ার সময় লেগেছে ৯ মিনিট।
খালেদা জিয়া আদালতকক্ষে ঢোকার সময় হৈচৈ শুরু হলে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আদালতের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চান। এ সময় তিনি টেবিল চাপড়িয়ে আইনজীবীদের চুপ থাকার জন্য ধমক দেন। পাশাপাশি আদালতও বলেন, যাঁরা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা বেরিয়ে যান। এটা প্রেক্ষাগৃহ নয়। এ পরিস্থিতিতে আইনজীবীরা চুপ হয়ে যান।
খালেদা জিয়া আদালতের সামনে হাজির হয়ে বিচারকদের সালাম দেন। বিচারকরা সালামের জবাব দিয়ে খালেদা জিয়াকে বসতে বলেন। আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর ঘিয়ে রঙের শাড়ি পরা খালেদা জিয়া আইনজীবীদের জন্য বসার সামনের সারিতে টি এইচ খানের পাশে বসেন। এ সময় তাঁর গায়ে একই রঙের একটি চাদর জড়ানো ছিল।
খালেদা জিয়াকে একনজর দেখার জন্য দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার মানুষ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে হাজির হয়। হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিরপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। আদালতকক্ষের বাইরে ও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে ঢোকার আগে প্রধান ফটকগুলোতে আগতদের তল্লাশি করা হয়। খালেদা জিয়া আদালত ভবন থেকে বের হওয়ার সময় তাঁর পেছনে থাকা সমর্থকদের ধাক্কায় সুপ্রিম কোর্টের একটি কাচের দরজার কাচ ভেঙে যায়।
চলতি বছরের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) মামলা করে। মামলার অন্য তিন আসামি হলেন হারিছ চৌধুরী, রাজনৈতিক সচিবের একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম (বর্তমানে বিআইডাবি্লউটিএর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক) এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। মামলাটির তদন্ত চলছে।

No comments

Powered by Blogger.