বিনোদিনী-আত্মদহনে দগ্ধ দৃঢ় মূর্তি by ওয়াসীম পলাশ

যে মহেন্দ্র সংসারের সবার কাছে, এমনকি দেবতাদের কাছেও প্রশ্রয় পায়, সে মহেন্দ্র বিনোদিনীর কাছে সব হারিয়ে আবার স্ত্রীর আঁচলেই আশ্রয় খোঁজে। সহায়-সম্পত্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পারিবারিক ঐতিহ্য এমনকি পুরুষতন্ত্রও তাকে রক্ষা করতে পারল না। উচিত শিক্ষা পেল মহেন্দ্র। পরিপাশ্র্বের ঈর্ষা মহেন্দ্রর মধ্যে যে কুৎসিত রিপুর জন্ম দিয়েছিল, বিনোদিনীর দহনের তীব্রতায় না জ্বলে বরং নিভে গেল। কিন্তু বিনোদিনী কেন বারবার এ রিপুকে জাগিয়ে তুলতে


প্ররোচিত করে? এ রিপু, এ দংশন শুধু মহেন্দ্রর নয়, এটা সমাজের, কিন্তু সে সমাজে বিহারীও বাস করে।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিযজ্ঞের শেষপাদের সৃষ্টি চোখের বালি। তিনি নেমে পড়লেন মনের সংসারে জ্বলুনী হাতুড়ির পিটুনি দিয়ে তৈরি করলেন দৃঢ় মানব-মূর্তি, বের করে আনলেন মানবমনের কুৎসিত, অচর্বিত পৃষ্ঠাগুলোকে, যা সহসাই অপঠিত থাকে এই ভেবে যে তাতে কেবল সৌন্দর্যই আছে। কোন তাগিদ থেকে তিনি নেমে পড়লেন আশার 'চোখের বালি' সৃষ্টি করতে, যাকে আশা ভেবেছিল চোখের মণি। সমাজে যখন নানা রকমের মনুষ্য চরিত্র এবং এ চরিত্রের বহুমাত্রিকতা শুধু সেখানেই আলো ফেলে, যেটা সমাজ সহজভাবে মেনে নেবে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সমাজ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মনের গহিন অন্ধকারে আলো ফেললেন। মনের অন্ধকারের সঙ্গে সমাজের আলোর পরিচয় করিয়ে দিলেন। যেটা আমরা দেখতে পাই বঙ্কিমচন্দ্রের 'কৃষ্ণকান্তের উইলে'র রোহিণীর মনোজগত বিশ্লেষণে।
'চোখের বালি' উপন্যাসে নারী চরিত্রের সংখ্যা অধিক। সে নারীরা চিরায়ত বাংলার। চোখের জলে ডুবে সিক্ত হয়ে দেবতার কাছে সমর্পণ করে। কখনও এই দেবতা পুরুষ কখনও শাস্ত্রসৃষ্ট বা কল্পনাসৃষ্ট। বিনোদিনী ব্যতিক্রম। বিনোদিনীর চোখ অনেকটা শুষ্ক, হৃদয়টা উষ্ণ, পদক্ষেপ দৃঢ়, লক্ষ্যে পেঁৗছাতে অনড়। তার লক্ষ্য নির্ণয় করা কঠিন। সে বিনোদিনী সমাজ ও শাস্ত্রকে পেছনে ফেলে ছুটে চলে মহেন্দ্রর সঙ্গে, পরক্ষণে সে মহেন্দ্রকে পায়ে ঠেলে এবং শেষ পর্যন্ত বিহারীকে দেবতার সামনে বসিয়ে দেবতাজ্ঞান করে। অপদেবতাকে বধ করে দেবতাকে রক্ষা করার জন্য ছুটে চলার পথে পিষ্ট হয়ে অনেকেই বিনোদিনীকে ডাইনী বলতেও দ্বিধা করে না। সে ডাইনী আশার সংসারের নিভু নিভু আলোটাকে জ্বালিয়ে সংসারটাকে আলোকিত করল, সে সংসারের দ্বীপকে নিভিয়ে আলোকে চুরি করে সংসারকে অন্ধকারে ফেলে অজানা পথে ছুটল। আমাদের কাছে মনে হয় লক্ষ্যহীন ছোটা; কিন্তু লক্ষ্য বিনোদিনীর ছিল নির্ধারিত।
বিনোদিনী ছুটছে। সমাজ, শাস্ত্র, রীতিনীতি মেনে, মনে হয় সবার সঙ্গে আছে রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা, আশালতা, মহেন্দ্র, বিহারী_এমনকি ডাকপিয়নও। কিন্তু বড্ড একাকী, দরজা খোলা ঘরে সিঁদ কাটার জন্য ব্যতিব্যস্ত। সিঁদ কেটে বিনোদিনী কিছু চুরি করবে না, নিজের আসনে গিয়ে বসবে। কিন্তু ওই আসন কি তার? না। কিন্তু ওই বাসর, ওই সংসার, ওই উচ্চশিক্ষিত পতি, সবই তো তার হতে পারত। কেন হয়নি_সে প্রশ্ন তার নেই; কিন্তু নিজের নায্য হিস্যা পাওয়ার একটা তাগিদ কাজ করে অবিরত তার ভেতরে। ওই তাগিদ থেকে নিজের ভেতরের রিপু জেগে ওঠে। সে রিপু প্রবাহিত হয় অন্য সংসারে, অন্যজনে। সে জন হারিয়ে ফেলে তার সকল। যে সব হারাল, বিনোদিনী তার জন্য দুঃখ করে না। কিন্তু যাদের হারিয়েছে, তাদের জন্য তার হৃদয়ে অনুতাপ হয়।
বিনোদিনীর হৃদয়ে কিসের আগুন জ্বলছে?
সাধারণ দৃষ্টি দিয়ে তা দেখা যায় না। যেমন, বিনোদিনীর হৃদয়ের যে বহুমুখীনতাকে ধীরে ধীরে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ, তা সূক্ষ্মভাবে উপলব্ধি করলে বোঝা যায়_প্রতিশোধের আগুন। এ আগুন নিজেকে যেমন জ্বালায়, ভস্মীভূত করতে চায় শত্রুকে, কিন্তু মিত্ররাও হয় দগ্ধ। পরিশেষে জ্বলে মরে সবাই।
রূপ, যৌবন, গুণ, ধৈর্যশক্তি, শিক্ষা_সব থেকেও প্রথম যৌবনে মহেন্দ্রর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে যে ভাগ্যকে বরণ করেছিল, অকাল বৈধব্যকে সাথি করে বাকি জীবন কাটাতে পারত সে। কিন্তু কী অদ্ভুত নিয়তি ভাগ্যচক্রে রাজলক্ষ্মীর দয়ায় মহেন্দ্রর সংসারে প্রবেশের সুযোগ পায় বিনোদিনী। আশালতা লতার মতো বাহুতে জড়িয়ে সত্তায়-সত্তায় মিলে সদর দরজার মতো দাম্পত্য দরজার কপাট খুলে দিল। যে অনভিজ্ঞতা দিয়ে মহেন্দ্রকে ধরতে পারছিল না, মহেন্দ্রর বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো যে ভালোবাসা উপচে পড়ছিল, তাতে অবগাহন করার সুযোগ করে দিল। তৃষ্ণা মিটল না। তৃষ্ণার্তকে অল্প জল দিলে যেমন আরো বেড়ে যায়, তেমনি অতৃপ্ত বিনোদিনী নিজের দহনে আশালতাকেও নিমন্ত্রণ করল। ঈর্ষার বিষ যদি বিনোদিনীর দেহে প্রবেশ করত, তাহলে অন্য কিছু হতো। কিন্তু বিষ প্রবেশ করল বিনোদিনীর মনে। সে বিষের দংশনে নিজে যেমন নীল হলো, অন্যকে বিষাক্ত করার ইচ্ছে জাগ্রত হলো। আশার স্থানে মহেন্দ্রর ওপরে নিজের প্রভুত্ব খাটানোর ইচ্ছা জাগল। আশালতার সুখ নষ্ট করার চেয়ে মহেন্দ্রকে নিজের মায়াজালের মধ্যে জড়িয়ে রেখে প্রতিরোধের একটা স্পৃহা জন্ম দিল। বিনোদিনী এখানেই পাঠকের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়।
যে মহেন্দ্র একদা বিবাহবিমুখ ছিল, সেই মহেন্দ্রের মধ্যে যৌবনধর্ম জেগে উঠল বিহারীর বিয়ের প্রক্রিয়ায়, পরিশেষে বিবাহ। বিবাহ শেষে চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে স্ত্রীরসে ডুবে থাকা। এমন স্ত্রৈনতা স্বয়ং মাতা রাজলক্ষ্মীও মানতে পারছিলেন না। মহেন্দ্র চরিত্রে বিভিন্নমুখী বৈপরীত্য বিনোদিনীকে আরো বিষিয়ে তোলে। যে মহেন্দ্র নিজের স্বার্থ, সুখ ছাড়া কাউকেই কখনো ভাবনায় নেয়নি, তার দ্বারা বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে এমন খেলায় বিনোদিনী মেতে ওঠে যে পরিশেষে মহেন্দ্র বলতে বাধ্য হয়, নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর! এমন নিষ্ঠুরতা ছিল মহেন্দ্রর ভাবনাতীত।
বিনোদিনীর নিষ্ঠুরতা বুঝতে মহেন্দ্রর সংসার, বিধবা মা, সাধ্বী স্ত্রী, প্রাণপ্রিয় বাল্যবন্ধু বিহারী, সমাজ-সংসার সব কিছু হারাতে হয়েছিল। আশালতার চোখের বালি একদিন যে সত্যিই চোখের কালি হয়ে সংসারে আগুন ছড়িয়ে, মহেন্দ্রর মনে কামনা-বাসনার একটা নতুন রূপ জাগিয়ে, নিজের রূপ-গুণে আশালতাকে মহেন্দ্রর কাছে অস্পৃশ্য করে তুলল। সেই মহেন্দ্র আজ অসহায়, নিগৃহীত, পদদলিত। বড় অসহায়ত্ব থেকে মহেন্দ্রর মনে প্রশ্ন আসে এবং নিজের কাছে জানতে চায়, 'বিনোদিনী আমাকে এত চেষ্টায় দুর্লভ ফলের মতো এত উচ্চশাখা হইতে পাড়িয়া লইল, তাহার পক্ষে ঘ্রাণমাত্র না করিয়া ফেলিয়া দিতেছ কেন।' উত্তর মেলে না।
মহেন্দ্রকে দেবতার আসন থেকে চ্যুত করে ধুলায় গড়াগড়ি করিয়ে হীনভাবে নিজের দহনে তিলে তিলে পুড়িয়ে যে সুখলাভ করেছিল; সে সুখ ছিল বিহারীকে ভালোবাসার মধ্যে। সমাজের বহমান বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে সত্যকে বিনোদিনী ধারণ করল, তা বিহারী। বিহারী তাকে প্রকৃত শ্রদ্ধা করেছে, নারী সত্তাকে বুঝেছে। মহেন্দ্র চিনেছে রিপুতাড়িত জৈবিকতা। বিহারীর ভাবনা ছিল প্রশান্ত, ভালোবাসা ছিল দেহাতীত। সবার প্রতি তার এ ত্যাগের মহিমা, মানুষকে নিজের স্থান থেকে, সম্মান জানানোর ব্যাকুলতা ও কৃতজ্ঞতাবোধ বিনোদিনীর মনস্তত্ত্বে একটা ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল। তাই আমরা দেখতে পাই, মহেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে বিনোদিনী কি যেন খুঁজে বেড়ায়। বিনোদিনী শুধু একজনকেই খোঁজে। সে বিহারী। এত আলো, এত আয়োজন, ফুলমাল্যে বাসর, নিজেকে ফুলমাল্যে সাজানো_এগুলো কার জন্য? মহেন্দ্রর প্রশ্নে বিনোদিনীর উত্তর, 'যাহার জন্য সাজিয়াছি, সে আমার অন্তরের ভিতরে আছে।'
এ অন্তরে প্রবেশ করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, বিনোদিনীর হৃদয়ের সব দ্বার বন্ধ হওয়ার পর মহেন্দ্রর মনে এ ভাবের উদয় হলো, হৃদয়ের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য শিক্ষা, অর্থ-বিত্তের বাইরে আরো কিছু প্রয়োজন, যা মহেন্দ্রের নেই। এটা অর্জন করেছে বিহারী। হৃদয়ের স্পর্শের সকোমল উত্তাপ পাওয়ার ব্যাকুলতা বিনোদিনীর নেই, বিনোদিনী চায় শ্রদ্ধা, যা থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে। বিহারী তাকে মাধুর্যের সঙ্গে ভাববে_এই প্রত্যাশাই বিনোদিনীরও। নারীর জন্য যে নিশ্চিত-বিশ্বস্ত নিরাপদ নির্ভরতা একান্ত আবশ্যক, তা বিনোদিনীকে শুধু বিহারীই দিতে পারে_এই ভাবনার বাইরে কোনো ভাবনাকে বিনোদিনী আশ্রয় দিতে পারেনি। ওই ভাবনার মাধ্যমে মহেন্দ্র পরাজিত হয়ে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়ে আপন গৃহে চলে যাওয়া বিনোদিনীর অন্ধকারকে কিছুটা আলোকিত করে।
দুজন অকাল বিধবা জায়ের এক সন্তানকে নিয়ে যাত্রার মাধ্যমে নতুন যে তরুণের আগমন, যা নিজ সন্তান ও আগন্তুকের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে দেয়, সন্তানের বিবাহের মাধ্যমে নতুন জীবনের যে শাখা-প্রশাখার বিস্তার, তার ডালে কোকিলের সুরের সঙ্গে হুতুম পেঁচার কুলক্ষণী ডাক মাঝেমধ্যে শুনতে পাই। কখনো হাসি, লুটোপুটি; পরক্ষণেই চোখের জলের পসরা। জীবনে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিচ্ছেদ, ছন্দ ও ছন্দপতনের মধ্য দিয়ে চলমান প্রক্রিয়া। সে প্রক্রিয়ার ভরা জোসনায়, সুখের দিনে এ সুখকে আরো মাধুর্যমণ্ডিত করার জন্য বিনোদিনীর আগমন। কিন্তু সে বিনোদিনীই হয়ে গেল হন্তারক। ভরা পূর্ণিমায় কৃষ্ণপক্ষের হাতছানি। ধর্ম, সমাজ, শাস্ত্র রীতিনীতিকে পাশে ফেলে, জীবনে আনন্দ-বেদনার সমভাগী হয়ে যে কটা মানব-মানবী তাদের যাত্রাপথের শেষভাগে এসে পেঁৗছল, তাতে মনে হয়, শেষ পর্যন্ত জীবনই জয়ী হয়। বিনোদিনী থাকে জীবনেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে। বিনোদিনীর নারী মনস্তত্ত্বের যে দিকগুলো সমাজ বা পুরুষতন্ত্র ভয় পায়, সেখানেই থাকে মানবসমাজের মূল শক্তি। তাই বিনোদিনী জানে ওই সমাজের মূল শক্তি বিহারী; মহেন্দ্র নয়।
সংসারে সংকীর্ণ সুখকে নির্বিঘ্নে রাখার চেষ্টায় বিনোদিনী নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলে অনেক অপ্রত্যাশিত ঝঞ্ঝাটকে এড়িয়ে যেতে পারত। কিন্তু নিজের শিক্ষা, নিজের ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি, বোধ তাকে এমন একটা স্থানে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে নিজেকে উপস্থাপন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে, নিজের অস্তিত্বকে প্রমাণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। কখনো সমাজের তাগিদে, কখনো নিজের তাগিদে। সমাজের তাগিদকে না হয় উপেক্ষা করল, হৃদয়ের তাগিদকে উপেক্ষা করতেই ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। ব্যক্তির ও সমাজের ভেতরের সেই ক্ষতগুলোকে না লুকিয়ে, বের করে আনতে বিনোদিনী ভয় পায় না। বিনোদিনীর এ ভয়হীনতাকে আমরা ভয় পাই। সমাজের অনেক আচার-অনাচার মেনে আনন্দ-বেদনাকে নিয়ে সবার সঙ্গে মিলে এগিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা, সে চেষ্টা বিনোদিনীর মধ্যে আমরা দেখতে পাই। আমাদের দেখার ও ভাবনার বাইরেও বিনোদিনী বিরাজমান।

No comments

Powered by Blogger.