হায়! তাহাদের মা যখন ছিনাল by শোয়াইব জিবরান

তিহাসের নায়কদের খলনায়কে পরিণত করায় কমলকুমার মজুমদার (১৯১৪-১৯৭৯) ছিলেন অসামান্য কথাশিল্পী। পরনিন্দা, পরচর্চা, সমালোচনা, গিবতকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্প পর্যায়ে। মানুষের নামে অদ্ভুত সব গল্প বানিয়ে চরিত্রহনন করতেন। ঠাকুরদের মধ্যে একমাত্র ঠাকুর রামকৃষ্ণ বাদে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, বন্ধুদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়সহ কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা,


শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ পঞ্চাশের দশকের কবিরা_কেউ রক্ষা পাননি। বাস্তব জগতের মানুষদের তিনি যখন এমন করে আঁকতেন, কী করেছেন তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যের চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে? কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, সেখানে খল-চরিত্র প্রায় নেই! ছিটেফোঁটা যারা আছে তাদেরও এঁকেছেন অমন সহানুভূতির সঙ্গে যে তাদের ঠিক খল বলা যায় না। ব্যতিক্রম দুটি চরিত্র_ 'অনিলা স্মরণে' (১৯৮৪) উপন্যাসের লাবণ্যদেবী আর 'সুহাসিনীর পমেটম' (১৯৮৩) উপন্যাসের লখাইর মা। তারা দুজনেই মা এবং ব্যভিচারী।
অনিলা স্মরণে উপন্যাসে অনিলাকে যদি আমরা মুখ্য চরিত্র (Protagonist) ধরি, তাহলে লাবণ্যদেবী দ্বিপ্রধান (Deuteragonist) চরিত্র। তিনি পরকীয়ামত্ত। তার স্বামী গঙ্গাকিশোরের মৃত্যুর আট দিনের মধ্যে তিনি তার প্রেমিক রঞ্জিত চ্যাটার্জিকে বিয়ে করেছেন। এখন সমস্যা হলো কন্যা অনিলাকে নিয়ে। সে পিতা অন্তঃপ্রাণ। মৃত পিতা তার ভগবান। পিতার জন্য সন্ত জীবন বেছে নিতে চায়। সে হোস্টেলে থাকে। মায়ের এ দ্বিতীয় বিবাহের সংবাদ জানে না। এ বিবাহ সংবাদ পিতার জন্য সন্ত হওয়ার অভিলাষী কন্যার মনে কী নিদারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে, এ চিন্তা মাকে তীব্র আততিতে (Tension) ফেলেছে।
উপন্যাসটির সূচনা হয়েছে কন্যার প্রথম বাড়ি ফেরা উপলক্ষে মায়ের তীব্র আততিকে কেন্দ্র করে। এ আততি গড়ে উঠেছে লাবণ্যের একদিকে জীবনকে ভোগ, আর অন্যদিকে বাৎসল্যরসকে কেন্দ্র করে। জীবনকে ভোগের ক্ষেত্রে তার আছে বেপরোয়া বাসনা আবার অন্যদিকে কন্যা প্রেমের দিক থেকে উৎকণ্ঠা।
চরিত্রটির সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় তখনো সে উদ্ভিন্ন যৌবনা। লেখক চরিত্রটির বর্ণনা সম্পর্কে যেসব অনুষঙ্গগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন তা লক্ষণীয় :
১. তাঁহার আপনাকার শরীর মধ্যে আজও শবর রমণী মরে নাই এবং উহাই তাঁহার টারসো। (অ. স্ম. পৃ. ১১৭)
২.আপনার দেহের বৈদিক সৌন্দর্যকে স্পর্শ করত বিরাট হল ঘরে বসিয়াছিলেন, সে সৌন্দর্য অস্বচ্ছনিপট দেওয়ালেও প্রতিবিম্বিত হয়। (অ. স্প. পৃ. ১১১)
চরিত্রটির এ শারীরিক বর্ণনা তার যৌবন তৃষ্ণারই ইঙ্গিতবাহী। অবশ্য বিয়ের পেছনে অবশ্য শুধু যৌবন নয়, স্বামীশোক, জীবনের হতাশা ও অস্বাভাবিকতা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও ছিল।
কিন্তু যখনই কন্যার কাছে বিবাহ ঘোষণা করেছেন তখন জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। কন্যা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তাকে পাপী হিসেবে_গঙ্গাকিশোরের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি আক্ষরিক অর্থেই কন্যার ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। সর্বশেষ কন্যা আত্মহননের মাধ্যমে তাকে চূড়ান্ত পতনের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
একদিকে যৌবনতৃষ্ণা, অন্যদিকে বাৎসল্যে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত একটি চরিত্র লাবণ্যদেবী।
'সুহাসিনীর পমেটম' উপন্যাসের দ্বিপ্রধান (উবঁঃবৎধমড়হরংঃ) চরিত্র লখাই। তার সব কর্ম আর কল্পনা তার মায়ের সৌন্দর্য নিয়ে। তার মা দেখতে কুৎসিত। তার আয়োজন মাকে সাজানোর। একদিন সে সত্যিই যখন মাকে সাজিয়ে তোলে, মা সেই সাজ নিয়ে পরপুরুষে উপগত হয়। সে এটি দেখতে পায়। এতে তার সব স্বপ্ন-বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কমলকুমারের এ উপন্যাসটি সৌন্দর্যতত্ত্বের। এ ঘটনার মধ্যে ঔপন্যাসিকের গভীর তত্ত্বকথা রয়েছে। তথাপি এ ঘটনার ভেতর দিয়ে চরিত্রটি খল হয়ে যায়।
লাবণ্য দেবী বা লখাইর মা খল এ জন্য নয় যে তারা ব্যভিচারী। বরং তারা খল এ জন্য যে তারা আপনজনদের সঙ্গে কপটতা করেছে, প্রতারণা করেছে, তাদের বিশ্বাস, স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে এবং সে বিশ্বাসগুলো ছিল মায়ের প্রতি সন্তানের।
কিন্তু আমরা লক্ষ করি কমলকুমার মা চরিত্রগুলোর আচরণের প্রেক্ষিত রচনা করেন। অত্যন্ত স্নেহ-সহানুভূতি দিয়ে তাদের সংকট আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন। ফলে চরিত্রগুলো আমাদের করুণা লাভ করে।
বাস্তব জীবনের ইতিহাসের নায়কদের কমলকুমার যখন চরিত্রহনন করতেন তাঁর মনোযোগী পাঠকরা জানেন তিনি অন্তরে এ চরিত্রগুলোর প্রতি কী পরিমাণ ভক্তি, ভালোবাসা রাখতেন। রবীন্দ্রনাথের গান সারাক্ষণ মুখে রাখা, রচনার মঞ্চায়ন, চলচ্চিায়ণ এর প্রমাণ। বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে মর্মস্পর্শী লেখা 'রেখো মা দাসেরে মনে' পাঠক ভুলতে পারবেন না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন কিন্তু শক্তি-সুনীল-সুব্রতকে তাঁর চেয়ে কে আর বেশি ভালোবাসত? কমলকুমারের অন্তরে মানুষের প্রতি ভক্তি, ভালোবাসা ছিল অফুরান। সাহিত্যের খল চরিত্রগুলোও তা থেকে বঞ্চিত হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.