ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় সাক্ষীর বর্ণনা-সাঈদী লুটপাট অগি্নসংযোগ হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করেন

জামায়াতে ইসলামী নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে লুটপাট, অগি্নসংযোগ ও ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন নবীন। গতকাল বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি করা হয়েছে।\ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চে গতকাল সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।


ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছেন, আগামী রোববার আসামিপক্ষে সাঈদীর আইনজীবীরা রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম ও দ্বিতীয় সাক্ষীকে জেরা করবেন। গত বুধবার রাষ্ট্রপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মাহবুবুল আলম হাওলাদারের জবানবন্দি গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন (৬১) গতকাল বক্তব্যের শুরুতেই সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে দেওয়া প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদারের দেওয়া জবানবন্দিকে সমর্থন করেন। সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনায় সাঈদীর দৃস্টান্তমূলক শাস্তির আবেদন করেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত এ সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণের শুরুতে রুহুল আমিন নবীন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে
সাঈদীর নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী গঠন ও পিরোজপুরে পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর আগমনের বিস্তারিত তুলে ধরেন। এরপর তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকবাহিনীর সহায়তায় সাঈদী পাড়েরহাট বাজারে দোকানে লুটপাট, অগি্নসংযোগ, মানুষ হত্যা, নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী কর্মকা ে সহায়তা করেন। যার অনেকগুলো বিষয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও ঘটনা শুনেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একটি ঘটনা উল্লেখ করে রুহুল আমিন নবীন বলেন, একাত্তরের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ (চাল, ডাল ইত্যাদি) কেনার জন্য পাড়েরহাট বাজারে যাই। ওইদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সকাল ১১টার দিকে বাজারে পরিচিত মাছুম স্টোরের কাছে অবস্থান নিই এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। এর কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পাই পাড়েরহাট বাজারের উত্তরদিক থেকে সাদা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি (কোচা দেওয়া) পরিহিত সাঈদীকে। সাঈদী ওই সময় লুটপাট করা মালপত্র ঝুড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তার বাঁ বগলের নিচে ছিল একটা ঢেউটিন ও মাথায় ঝুড়ির মধ্যে পিতলের তৈরি জগ, কলস, গ্গ্নাসসহ আরও কয়েকটি জিনিসপত্র। এ সময় আমার পাশে দাঁড়ানো মৌলভী নুরুল হককে বলি, 'ওই দেখুন সাঈদী (তৎকালীন দেলাওয়ার হোসাইন সিকদার) লুটের মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে।' নিরাপত্তার কারণে ওই সময়ে আমার কাছে থাকা ছোট পিস্তল দিয়ে লুটেরাকে গুলি করতে চাইলে নুরুল হক আমাকে বলেন, 'এই মুহূর্তে ঝামেলা করলে পাক হানাদার বাহিনী অবশিষ্ট যে কয়টা ঘরবাড়ি আছে, তা জ্বালিয়ে দেবে এবং নির্বিচারে হত্যষজ্ঞ শুরু করবে।' এ পর্যায়ে রুহুল আমিন নবীন বলেন, একটু পড়ে পাড়েরহাট বাজারের উত্তর দিকে গিয়ে মৌলভী সফিজউদ্দিনের দোকানে গিয়ে অবস্থান নিই। সেখানে জানতে পারি পাড়েরহাটের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মদন সাহার দোকান লুট হয়েছে। সাঈদীর পরামর্শেই ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বাধীন বাহিনী পাড়েরহাট বাজারের আওয়ামী লীগ সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকদের দোকান, বসতঘরে লুটপাট ও অগি্নসংযোগ চালিয়েছে। সেখানে প্রায় ৩০-৩৫টি দোকান ও বসতঘরে লুটপাট চালিয়ে সাঈদী ও তার বাহিনী ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। তবে পাড়েরহাটের ব্যবসায়ী মদন সাহার দোকানঘরের মাটির নিচ থেকে উদ্ধারকৃত ২২ ভরি স্বর্ণ-রূপা ক্যাপ্টেন এজাজের বাহিনী নিয়ে গেছে। রুহুল আমিন বলেন, সেখানে থাকার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাই সাঈদী তিন-চারজন শ্রমিক নিয়ে মদন সাহার ঘরটি ভাঙার কাজ শুরু করে এবং পরে নৌকাযোগে তার শ্বশুর ইউনুচ মুন্সীর বাড়িতে নিয়ে যায়।
পাঁচ তহবিল গঠন :রুহুল আমিন আরও বলেন, সাঈদীর নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী পাড়েরহাটের পুরাতন লঞ্চঘাটে অবস্থিত নগরবাসী সাহার একটি দোকান জোরপূর্বক দখল করে পাঁচ তহবিল নাম গঠন করে। সেখানে লুটের মালপত্র এনে জমা করা হতো। স্থান সংকুলান না হওয়ায় পরে পাশে মাওলানা নাছিমের বাবা সুলতানের দোকানঘরও জোরপূর্বক দখল করে নেয় তারা। সাঈদী, মাওলানা মোসলেহ উদ্দিনসহ ৪-৫ জন পাঁচ তহবিল পরিচালনা করত। তবে স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে ক্ষতিগ্রস্তদের অনেক মালপত্র উদ্ধার করে সংশ্লিষ্টদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় বলে সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন জানান।
ধর্ষণ : সাঈদীর নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে। সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন বলেন, সাঈদীর নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী ভানু সাহা, ছবি রায়সহ আরও অনেককে পাক হানাদার বাহিনীর মনোরঞ্জনের জন্য তুলে দেয়। এ সময় ভানু সাহাকে দীর্ঘদিন আটকে রেখে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়। তবে স্বাধীনতার পর ভানু সাহা, ছবি রায়সহ অনেকেই ভারতে চলে যান বলে তিনি জানান।
অগি্নসংযোগ : সাক্ষী রুহুল আমিন বলেন, একাত্তরের ৮ মে পাকিস্তান বাহিনী ও অন্যান্য সহযোগী বাহিনীর সদস্যরা পাড়েরহাট বাজারে পূ্র্বপাড়ে বাদুড়া ও চিথলিয়া গ্রামে তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রইস উদ্দিন পশারী, হেলাল উদ্দিন পশারী, সেইজুদ্দিন পশারী ও মানিক পশারীর ঘরসহ আরও ৭-৮টি বাড়িতে লুটপাট শেষে অগি্নসংযোগ করা হয়। এসব বাড়ি সাঈদী ও তার বাহিনী দেখিয়ে দিয়েছিল বলে ট্রাইব্যুনালকে তিনি জানান।
ধর্মান্তরিতকরণ : সাঈদীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের অভিযোগ আছে। সাক্ষী রুহুল আমিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈদী লুটপাট, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হননি। তারা স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ননী সাহা, মাখন সাহা, ডা. গণেশ চন্দ্র রায়সহ প্রায় ৫০ জনকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে মসজিদে জামায়াতে নামাজ পড়তেন সাঈদী। তবে স্বাধীনতার পরে ধর্মান্তরিত এসব মানুষ আবার স্বধর্মে ফিরে যায় বলেও তিনি জানান।
স্বাধীনতার পর সাঈদী : রুহুল আমিন নবীন বলেন, স্বাধীনতার পর সাঈদীকে অনেক খোঁজ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় ১৯৮৬ সালে সাঈদী পিরোজপুরে আসেন। একটি মাহফিলে আসার কথা বলে পিরোজপুরে রাজনীতি শুরু করেন সাঈদী।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে গত ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে ৩১টি অপরাধের অভিযোগ আনে। এর মধ্যে ২০টি অভিযোগ আমলে নিয়ে তার ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরে ৩ হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, ৯ জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগি্নসংযোগ, লুটপাট, ভাংচুর এবং একশ' থেকে দেড়শ' হিন্দুকে ধর্মান্তরে বাধ্য করার কথা উল্লেখ রয়েছে অভিযোগপত্রে।

No comments

Powered by Blogger.