মমতাকে দেখে শিখছে সিপিএম

তাদের তৈরি জনগোষ্ঠীর আন্দোলন এভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে 'হাইজ্যাক' হয়ে যেতে এবার টনক নড়েছে বামপন্থিদের। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সিপিএমের। শুধু ১৯৭১ সালকে মাপকাঠি না ধরে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য ২০০৩ সালের কেন্দ্রীয় আইন সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের ৬টি সংগঠনের যৌথ অ্যাকশন কমিটি। আর মমতার মোকাবেলায় সিপিএম এবার মাঠে


নামিয়েছে বঙ্গললনা বৃন্দা কারাটকে। দলের পলিটব্যুরোর সদস্য বৃন্দা দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের স্ত্রীও বটে।সিপিএমের মতো 'দূরদর্শী দল'কে পেছন থেকে শুরু করতে হলো কেন, এটাই এখন দলের মধ্যে অন্যতম বড় বিতর্ক। কারণ ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে লড়াই করার জন্য সিপিএমই গণসংগঠন হিসেবে গড়ে তুলেছিল ইউনাইটেড কাউন্সিল অব রিফিউজি কলোনি (ইউসিআরসি)। বাংলায় সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ। প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী এবং সমর মুখোপাধ্যায় ছিলেন যার প্রবাদপ্রতিম নেতা। সমর বাবু এখন অসুস্থ, দলের কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যানও। পরবর্তীকালে উঠে এসেছেন প্রশান্ত শূর. কান্তি বিশ্বাসের মতো নেতারা। অনিল সিংহের বইয়ে পাঁচ-ছয় দশকের সেই উত্তাল আন্দোলন এবং উদ্বাস্তুদের জীবন-জীবিকার লড়াইয়ের বর্ণনাও রয়েছে।
কিন্তু তার প্রায় ৪০ বছর পর বামপন্থিদের নিজেদের হাতে গড়া আন্দোলন যেভাবে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পেঁৗছে গেছে, তা সাম্প্রতিক রাজ্য রাজনীতিতে বিরলতম ঘটনা। আসলে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে এপারে চলে এসেছেন বাঁচার স্বার্থে। তাদের একটা বড় অংশ নমশূদ্র বা মতুয়া। যাদের বেশিরভাগেরই পদবি বিশ্বাস। উত্তর ২৪ পরগনা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদে ছড়িয়ে পড়া এই মানুষগুলোর বেশিরভাগ এখন 'আইডেনটিটির ক্রাইসিসে' ভুগছেন। অনেকের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নেই। নেই পাসপোর্ট, ভোটার আইডেনটিটি কার্ডও। তাদেরই সংগঠনের প্রধান, বড়মা বীণাপাণি দেবী বা মঞ্জুল কৃষ্ণ ঠাকুর। এই অংশের প্রতিনিধি সাবেক আইপিএস উপেন বিশ্বাস, যিনি রাজ্যের মন্ত্রী। বামপন্থিদের তরফে সাবেক মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাসও এই অংশের মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু কান্তি বাবুর ব্যর্থতা এখন মানতে হচ্ছে সিপিএমকে।
আসলে নিউ লিবারাইজেশন বা নয়া উদারনীতির সমস্যা যে জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে, তা বুঝতে পারেননি সিপিএমের নেতারা। একদম বুঝতে পারেননি, তাও ঠিক নয়। সিপিএমের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসী-তফসিলিদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তিনিই প্রথম দলের মধ্যে সোশ্যাল রিফর্ম মুভমেন্টের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তখন রাজ্যে ক্ষমতায় বামপন্থিরা। এ রকম আন্দোলন এবং দাবি-দাওয়ার সমাধান করতে গেলে নিজেদের রাজ্য সরকার বিব্রত হতে পারে, এই আশঙ্কায় বিমান বাবুর হাতে প্রায় 'গাজর' ধরিয়ে দিয়েছিলেন আজকের এই প্রকাশ কারাট-সীতারাম ইয়েচুরিরা। যারা আজ বৃন্দা কারাটকে দিয়ে 'ড্যামেজ কন্ট্রোল' করতে চাইছেন। ২০০২-এর পার্টি কংগ্রেসে জনগোষ্ঠী নিয়ে দলিল প্রকাশ করেই দায়িত্বে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন প্রকাশ কারাটরা।
এতে যে সমস্যার সমাধান হবে না, উল্টো ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে, বুঝতে পেরেছিলেন সম্ভবত প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। সিপিএম বা বামপন্থিরা যেহেতু জাত বা জনগোষ্ঠীর আন্দোলনে তেমনভাবে শামিল হয় না ধর্মনিরপেক্ষ বলে। তাই অনিল বিশ্বাস স্লোগান তুলেছিলেন, গরিব মানুষের ঐক্যকে আরও সংগঠিত করতে হবে। কিন্তু গরিব মানুষের সেই ঐক্যে যে ফাটল ধরেছে তা অনিলের মৃত্যুর পর ধরতে পারেননি তার দলের নেতারাই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত উদ্বাস্তুদের আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা সিপিএমকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে নমঃশূদ্রসহ অন্যান্য পশ্চাৎপদ অংশের মানুষকে তপসিলি উপজাতিভুক্ত করার দাবি নতুন করে তুলতে হচ্ছে সিপিএমকে।
সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, 'এ ধরনের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বেশকিছু অবদান রেখেছে। সেগুলো ঠিকভাবে ভেবে বা খতিয়ে দেখা হয়নি। এখন আমাদের মানতে হচ্ছে, বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।' তাহলে কি ভুল শুধরে নিচ্ছে সিপিএম? উত্তর আসছে, 'ন্যায্য দাবি নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কোথায় কোথায় হচ্ছে তা আমাদের মাথায় রাখা উচিত, খোঁজখবর রাখা উচিত। কমিউনিস্ট পার্টি তো গরিব মানুষের জন্য লড়াই করে। মুসলিম বা উদ্বাস্তু কিংবা মতুয়া জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি যাই হোক, শোষণের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে তারা যাতে লেভেল প্লেইং গ্রাউন্ড পান সেদিকে নজর দিতে হবে আমাদের।'
বিষয়টি নিয়ে সিপিএমের মধ্যে মতভেদও রয়েছে। একটি অংশের বক্তব্য, এভাবে আন্দোলন করতে গিয়ে উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের মতো জনজাতিভিত্তিক দলের হাল হতে পারে সিপিএমের। আদিবাসীদের নিয়ে শুধু আন্দোলন করলে হবে না। কিন্তু তা মানছেন না পশ্চিমবঙ্গের নেতারাই। ভোট রাজনীতির বালাই যে বড় বালাই, তা সাড়ে তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পর বিরোধী আসনে বসতে বাধ্য হওয়া বঙ্গজ কমিউনিস্টদের চেয়ে বেশি কে বুঝবে!

No comments

Powered by Blogger.