ছাত্র সেনা সংঘর্ষ : তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত-ফখরুদ্দীন মইন মতিন দায়ী শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হোক by নিখিল ভদ্র

০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সেনা সংঘর্ষ ও পরবর্তী সহিংসতার জন্য বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তৎকালীন প্রশাসনের এক ডজন কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে সংসদীয় উপকমিটি। দায়ীদের মধ্যে রয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন, সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের


(ডিজিএফআই) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী দুই সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) চৌধুরী ফজলুল বারী, ডিজিএফআইয়ের কর্নেল শামসুল আলম খান (কর্নেল শামস) ও মেজর কামরুল। এসব ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
জাতীয় সংসদ ভবনে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত উপকমিটির বৈঠকে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ১১ দফা পর্যবেক্ষণ ও ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। কিছু সেনা কর্মকর্তার বাড়াবাড়ি ও শীর্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে ওই ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানোর বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেনা সদস্যদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব কমিয়ে সম্পর্কোন্নয়ন এবং ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে সেনা কর্মকর্তাদের ওপর জনপ্রতিনিধিদের স্থান দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহের বিরুদ্ধে ঘটনার সময় ছাত্রদের পক্ষে না গিয়ে সেনাদের তাঁবেদারি করার দায়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
উপকমিটির আহ্বায়ক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রতিবেদনটি আগামী ২১ ডিসেম্বর মূল কমিটির বৈঠকে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংসদীয় কমিটির ইতিহাসে এটিই এ ধরনের প্রথম প্রতিবেদন। মূল কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি অনুমোদনের পর আইনগত বিষয়গুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জাতীয় সংসদের আইন শাখায় পাঠানো হবে। এরপর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে নবম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে। স্পিকার চাইলে প্রতিবেদনটির ওপর সংসদে সাধারণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। অন্যথায় স্পিকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এ বিষয়ে রাশেদ খান মেনন কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদীয় কমিটির ইতিহাসে এবারই প্রথম শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের জেরার মুখে ফেলা হয়েছে। ওই ঘটনায় যাঁরা জড়িত তাঁদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা রাখারও সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সতর্কও করা হয়েছে।
রাশেদ খান মেনন বলেন, সুপারিশসহ স্থায়ী কমিটির অনুমোদিত প্রতিবেদন সংসদের আগামী অধিবেশনে উপস্থাপন করা হবে। তবে এ বিষয়ে ২১ ডিসেম্বরের বৈঠকের আগে কিছুই জানানো যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজের সিডিও সংযুক্ত করা হবে।
কমিটি সূত্রে জানা যায়, প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ঘটনার বিবরণ, ঘটনা-পরবর্তী সহিংসতা, বিচারপতি হাবিবুর রহমান কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন, উপকমিটির ১১টি বৈঠকে শীর্ষ ব্যক্তি, অভিযুক্ত কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নির্যাতনের শিকার ছাত্রসহ মোট ৬৮ জনের শুনানি তুলে ধরা হয়েছে। উপকমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ওই ঘটনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম এ মতিন, সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ, আইজিপি নূর মোহাম্মদসহ সংশ্লিষ্ট শীর্ষ ব্যক্তিদের চরম গাফিলতি ছিল। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। উপকমিটির সাক্ষ্যে মইন উ আহমেদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল জানালেও বাস্তব পরিস্থিতি প্রমাণ করে, তিনি তাঁর অধীন কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছেন। তা না হলে সংঘর্ষ থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ত না। শীর্ষ ব্যক্তিদের নিস্পৃহতায় দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনাটি সহিংস রূপ নেয় কিছু সেনা-কর্মকর্তার বাড়াবাড়ির জন্য। সিভিল ড্রেসে থাকা গোলাম মোস্তফা নামের যে সৈনিকটির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রটির ঝগড়া হয়েছিল, তা সহনশীলতার সঙ্গে দেখলে সংঘর্ষ এড়ানো যেত। এ ছাড়া ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করার ঘটনা সহিংসতাকে আরো উসকে দেয়। সেনা-কর্মকর্তাদের এ কাজে ছাত্রদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়।
উপকমিটির মতে, এ ধরনের ঘটনার শুধু 'প্রতিবিধান' না করে 'প্রতিষেধক' দেওয়া প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেনাদের দূরত্ব কমিয়ে আনা প্রয়োজন। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে সংশোধন আনা উচিত। জনপ্রতিনিধিদের সেনা কর্মকর্তাদের ওপরে স্থান দেওয়া উচিত। প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের মতো কেউ যেন সংসদীয় কমিটির আমন্ত্রণ উপেক্ষা না করেন সে জন্য বিধি সংশোধন করে কমিটির ক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়োজিত টিএফআই সেল ও যৌথ বাহিনীর সেল (জেআইসি) বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঘটনায় শিক্ষক ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে করা মামলার পরে প্রত্যাহার করা হলেও দণ্ড মওকুফ করা হয়নি। কমিটি দণ্ড মওকুফ করার সুপারিশ করেছে। সংসদীয় উপকমিটিতে সাক্ষ্যদাতা ছাত্র-শিক্ষকরা যাতে কখনো কোনো ধরনের সমস্যায় না পড়েন, তা নিশ্চিত করার সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাক্যাম্প স্থাপনের বিষয়েও কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো সেনাক্যাম্প স্থাপন করার প্রয়োজন হলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিয়ে করতে হবে। দক্ষ প্রক্টরিয়াল বডি গঠনের সুপারিশও করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাসংক্রান্ত ৭৩-এর অধ্যাদেশ সংশোধনেরও সুপারিশ করা হয়েছে। সংঘর্ষের ওই ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা-ব্যয় এবং নির্যাতকদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশও করা হয়। সংঘর্ষের ওই ঘটনায় রাজশাহীতে নিহত রিকশাচালক আনোয়ারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
উল্লেখ্য, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে ছাত্র ও সেনা সদস্যদের মধ্যে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সহিংসতা ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভাগীয় শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ২২ আগস্ট সন্ধ্যায় ছয় বিভাগীয় শহরে কারফিউ জারি করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৩টি মামলা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্যাপকভাবে ধরপাকড় করা হয়। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষককে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়। ওই ঘটনায় অধিকতর তদন্তের জন্য ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট সংসদীয় উপকমিটি গঠন করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে আহ্বায়ক করে গঠিত চার সদস্যের ওই উপকমিটিতে রয়েছেন শাহ আলম, মির্জা আজম ও বীরেন শিকদার।

No comments

Powered by Blogger.