ধর নির্ভয় গান-১-এর পেছনে ৯ by আলী যাকের

মরা, তরুণরা, পাড়ায় পাড়ায় সারারাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করি। কিন্তু ওই দুর্ভাগ্যজনক দাঙ্গায় সর্বপ্রথম শহীদ হন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ভুক্ত এক বাঙালি মুসলমান সাংবাদিক, যার নাম আমীর হোসেন চৌধুরি। তিনি দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে একাই রুখে দাঁড়ান। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি, আমীর হোসেন চৌধুরি ছিলেন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বোনের ছেলে


মুম্বাই শহর আমার প্রিয় শহরগুলোর মধ্যে একটি নয়। এই কথাটি বলেই হঠাৎ খটকা লাগল, সত্য বললাম কি? আসল সত্যটা হলো, মুম্বাই যেমন আমার পছন্দের শহরগুলোর মধ্যে একটি নয়, আবার নানাবিধ কারণে মুম্বাইকে আমি ভালোও বাসি। এই যে প্রথম বাক্যটি উচ্চারণ করলাম, মুম্বাই আমার প্রিয় নয় বলে, সেটি সাম্প্রতিক বোধ থেকে। কিন্তু এই শহরই আমার নিতান্ত প্রিয় ছিল যখন তরুণতর ছিলাম। মুম্বাই ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহর_ এই কথাটি নিদ্বর্িধায় বলা যায়। এবং সেই কারণে এই পরিণত বয়সে এসে বাণিজ্য থেকে মনটাকে সরিয়ে নিয়ে একটি শহরের গুণ বিচারে অন্য আরও অনেক বিষয়ে সম্যক পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছা হয়। মুম্বাইয়ের যা আমার ভালো লাগে না, সেটি হলো সেই কাকভোর থেকে শহরটির ব্যস্ততা। সব মানুষ ছুটছে। সবাই তাদের নিজস্ব ভাষায় 'ধান্দায় ব্যস্ত'। ধান্দা শব্দটি কদর্থে গ্রহণ করার কোনো কারণ নেই। এই শব্দটি মুম্বাইয়ের প্রেক্ষাপটে পেশার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আবার মুম্বাইকে ভালো লাগে এই কারণে যে সেখানে পৃথি্ব থিয়েটারের মতো একটি অসাধারণ নাট্যকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ভারতবর্ষের সব ভালো নাটক অভিনীত হয়ে থাকে। মুম্বাইয়ে ভারতীয় শুদ্ধ সঙ্গীতের সবচেয়ে বড় আসর বসে। ওই শহরে অত্যন্ত উচ্চমার্গের মারাঠি থিয়েটারও রয়েছে। বিশ্বের যেখানে যত শিল্পী আছেন, যারা প্রায়োগিক শিল্পকলার চর্চা করে থাকেন, তাদের একটি আশ্রয়স্থল হচ্ছে মুম্বাই। এখানকার মানুষদের যেমন পয়সা আছে, তেমনি রুচিবোধও আছে। অতএব এহেন শহরে গেলে আমার এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। এ বুঝি বয়সের দোষ। এখন স্বভাবতই মন চায় অর্থের অনর্থ থেকে বেরিয়ে জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে।
আজকাল অবশ্য মুম্বাই যাওয়া কমে গেছে আমার। আমাদের তরুণ সহকর্মীরাই বিভিন্ন কাজে সাধারণত সেখানে গিয়ে থাকেন। শেষবার যখন গিয়েছিলাম তখন আমার এক অতি প্রিয় জায়গায় যাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারিনি। স্থানটির নাম প্রিয়দর্শিনী পার্ক। এই পার্কটি একেবারে আরব সাগর তীরে। এখানে আছে অজস্র ফুলের গাছ, ঝোপঝাড়, বসার জন্য বেঞ্চ। কাকভোর থেকে অনেক মানুষের সমাগম হয়_ নারী, পুরুষ এবং শিশু। তারা কেউ হাঁটেন, কেউ দৌড়ান অথবা নানাবিধ ব্যায়াম করেন। আমি মুম্বাইয়ে গেলে চেষ্টা করি প্রতি সকালে প্রিয়দর্শিনী পার্কে যেতে। এই পার্কটি আমার যতটা পছন্দ তার চেয়ে বোধকরি অধিক পছন্দ এর নাম। এই নামটি আমার একজন অতি প্রিয় ব্যক্তিত্ব ইন্দিরা গান্ধীর মধ্য নাম। ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী। এই কথাটি কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন যে, ইন্দিরা গান্ধী আসলেই প্রিয়দর্শিনী ছিলেন?
যা হোক, একদিন সকালে, তখন ৭টা হবে, আমি সকালের হাঁটা সেরে সমুদ্রের কূল ঘেঁষে একটি বেঞ্চে বসেছিলাম। সামনেই আরব সাগর। এই উদ্যানটি বিভাজিত যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, সেটি ছিল আমার দক্ষিণ পাশে। হঠাৎ কর্কশ স্বরে কতগুলো কাকের চিৎকারে আমি ডানে চেয়ে দেখি কাঁটাতারের বেড়ার ওপরে চুপচাপ বসে থাকা একটি গাঙচিলকে ঘিরে কাকের এই তাণ্ডব। তারা গাঙচিলটিকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। চারদিক থেকে সমস্বরে চিৎকার করছে এবং ঠোকর দেওয়ার চেষ্টা করছে। গুনে দেখলাম কাকের সংখ্যা ৯। অর্থাৎ ১-এর বিরুদ্ধে ৯। যখন এই অত্যাচার সহ্যাতীত হয়ে গেল তখন গাঙচিলটি হঠাৎ করেই সমুদ্রের দিকে পাড়ি জমাল। আমরা সবাই জানি, সমুদ্রই হচ্ছে গাঙচিলের ঠিকানা। ওই ৯ অত্যাচারী বায়স কিছুদূর পর্যন্ত গাঙচিলটিকে অনুসরণ করল, তারপর আর লাভ নেই জেনে দক্ষিণে গোত্তা মেরে আবার পূর্ব দিকে নিজেদের পূতিগন্ধময় ডাস্টবিনের উদ্দেশে ফিরে গেল। গাঙচিলটি, দেখতে পেলাম, ক্রমশ ছোট হতে হতে একটি বিন্দুতে পরিণত হয়ে আকাশের নীলিমায় মিলিয়ে গেল।
শরতের সেই নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, আরব সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে নানা কথা আমার মনে ভিড় করে এলো। আমি ভাবলাম, ওই নির্দয় কাকগুলোর আর দোষ কী? আমরা, মানুষেরা কি তার চেয়ে কম যাই কোনো অংশে? আমরা, সমগোত্রীয়রা, যখনই দুর্বল কোনো প্রতিপক্ষকে দেখতে পাই তখন তার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার মানসে অথবা এমনকি, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই তার ওপর লাফিয়ে পড়ি। এটা তো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সর্বদাই সংখ্যালঘুদের ওপরে চড়াও হবে যে কোনো অজুহাতে। ওই সকালে প্রিয়দর্শিনী পার্কে বসে, সেই নিঃসঙ্গ গাঙচিলটির কথা ভেবে ভেবে আমার মন ফিরে আসে স্বদেশে। আমি ভাবি, এইভাবে যূথবদ্ধ হয়ে কত দুষ্কৃতকারী স্বাধীনচেতা মানুষের ক্ষতিসাধন করছে সর্বদাই আমাদের এই দেশে। মনে পড়ে ১৯৬৪ সালের কথা। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কাশ্মীরে কোনো এক মসজিদে সংঘটিত এক দুষ্কর্মের গুজবে পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের ওপরে খৰহস্ত হয়। এক প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হয় সেই সময়। আমরা, তরুণরা, পাড়ায় পাড়ায় সারারাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করি। কিন্তু ওই দুর্ভাগ্যজনক দাঙ্গায় সর্বপ্রথম শহীদ হন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ভুক্ত এক বাঙালি মুসলমান সাংবাদিক, যার নাম আমীর হোসেন চৌধুরি। তিনি দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে একাই রুখে দাঁড়ান। এই ক্ষণজন্মা মানুষটি, আমীর হোসেন চৌধুরি ছিলেন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বোনের ছেলে। ২০১১ সালে অর্থাৎ এ বছর তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে কলকাতায়, যদিও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অধিবাসী। অথচ আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে সত্যবিচ্যুত আমরা অনেকেই জানিও না এই মহৎপ্রাণের কথা।
এই যে একের বিরুদ্ধে ৯-এর সংঘাত, সময়ের অগ্রযাত্রায়, তা ক্রমশই বড্ড বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এই কলামটি লিখতে লিখতেই মনে এলো রাস্তাঘাটে আমাদের তরুণীদের নিগৃহীত হওয়ার কথা, যাকে অনেকেই ইভ টিজিং বলে বর্ণনা দিয়ে থাকে। আমি একে বলি যৌন হয়রানি। ইভ টিজিং শব্দটির মধ্যেই কেমন যেন নারীর প্রতি অসংবেদনশীল মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সাধারণত আমরা দেখতে পাই আমাদের কন্যাটি একা যখন পথ চলে তখন সে এ ধরনের হয়রানির শিকার হয় একজন, তিনজন, ছয়জন কিংবা নয়জন তরুণ বঙ্গবীরের (!) দ্বারা। বেচারার ক্ষমতাও থাকে না প্রতিবাদ করার। মাঝে মধ্যে দেখা যায় একজন মানুষ, হয়তোবা মেয়েটির পিতা এই অত্যন্ত ঘৃণ্য আচরণের প্রতিবাদ করেন এবং প্রায়শই ওই দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং আত্মাহুতি দেন। এমনও অনেক সময় ঘটে যে তরুণীটি এমন অপমানের শিকার হয় সে নিজের লজ্জা ঢাকতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আমি প্রিয়দর্শিনীতে বসে আমার দেশের এই সংখ্যালঘুদের কথা ভাবি, ওই তরুণীদের কথা ভাবি আর প্রচণ্ড গ্গ্নানিবোধ হয় আমার। ভাবি, ওই যে নিঃসঙ্গ গাঙচিলটি, তার তো অন্ততপক্ষে ছিল একটি উন্মুক্ত সমুদ্র, এক অসীম আকাশ, যেদিকে সে উড়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু আমাদের অসহায় মানুষেরা কী করবে? আহা, আমরা যদি আমীর হোসেন চৌধুরির মতো সাহসী হতে পারতাম! যদি রুখে দাঁড়াতে পারতাম এই দুষ্কৃতির বিরুদ্ধে? যদি সকলে একতাবদ্ধ হয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারতাম এ ধরনের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে তাহলে হয়তো এই সমাজটি বেঁচে যেত।
আমি এসব ভাবতে থাকি। মনটা ভারি হয়ে আসে। অলস পায়ে হেঁটে চলি আমার হোটেলের দিকে। পারবে কি আমাদের সন্তানেরা এমন একটি সমাজ গড়তে, যেখানে একের বিরুদ্ধে নয়জনকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে?

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.