হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
ইমদাদুল হক মিলন : এ রকম হতেই পারে। কিন্তু আপনি বলছেন যে আপনি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখে, যেমন_'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে বলতে চেয়েছেন, আপনি দেশমাতৃকার ঋণ কিছুটা শোধ করলেন। দেশমাতৃকার ঋণ শোধ করার জন্য দেশমাতৃকার শত্রুদের মহৎভাবে দেখার অর্থ কী?হুমায়ূন আহমেদ : তাদের মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা তো আমি করিনি। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছি।
তাদের সত্যিকারের অংশটি_এই যে রাজাকারদের অত্যাচার, আলবদরদের অত্যাচার_এসব অংশ পুরোপুরিভাবে আছে। কিন্তু যেভাবে থাকলে তোমার ভালো লাগত সেভাবে হয়তো নেই।ইমদাদুল হক মিলন : 'জোছনা ও জননীর গল্প' নিয়ে একটু কথা বলে আমরা এ প্রসঙ্গটা শেষ করি। আপনি বহুদিন পরিকল্পনা করে লেখাটা লিখেছেন। আপনি যে মাপের লেখক_আপনি খুব সহজে তৃপ্ত হন না। আপনি কি এ উপন্যাসটা লিখে খুশি হয়েছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, আমি খুশি।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মনে হয়েছে, আপনি যেভাবে লিখতে চেয়েছেন সেভাবে লিখতে পেরেছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : এক শ ভাগ। আসলে প্রত্যেককে নিজের প্রতিভা দেওয়া হয়েছে। প্রতিভার বাইরে কেউ কাজ করবে না। যে প্রতিভা দিয়ে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন, আমি কাজ করব তার ভেতরেই। আমি যদি মনে করি, এটা দিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখব, সেটা হবে 'ওয়ার অ্যান্ড পিস', তা তো ঠিক হবে না। আমাকে যদি আল্লাহপাক 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' লেখার ক্ষমতা দিয়ে দেন, সেটা হবে ওয়ার অ্যান্ড পিসের মতো লেখা। আমাকে যেটুকু প্রতিভা আল্লাহ দিয়েছেন, সেই প্রতিভার পুরোটা আমি কাজে লাগিয়েছি। অনেক উপন্যাসে আমার ঘাটতি আছে, এ উপন্যাসে আমার কেনো ঘাটতি নেই।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি এ উপন্যাসে নানা ধরনের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের এ উপন্যাসে আপনি কখনো কখনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে দিয়েছেন, কখনো বা বেশ অভিনব পদ্ধতিতে লেখক ইনভলভড হয়েছেন লেখাটিতে। আপনি সব সময় বলেন আপনি স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। এই উপন্যাসে আপনার লেখা কি ওভাবেই এসেছে? নাকি আপনি আগে থেকেই আঙ্গিক ঠিক করেছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি আঙ্গিক আগে থেকেই ভেবেছিলাম। আমি দেখলাম জাতিসংঘে কী হলো, সাধারণ সভায় কী হলো_সেটা আমি সঠিক একটা লাইন দিয়ে দিতে চাইলাম। ভাবলাম মূল লেখার ভঙ্গি এসব একত্রে মিলিয়ে দেখি না, জিনিসটা কেমন হয়।
ইমদাদুল হক মিলন : তার মানে, এ উপন্যাসটির সব কিছু আপনার পরিকল্পিত।
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ পরিকল্পিত। এ উপন্যাস লেখার কাজটি আমি অনেকবার শুরু করেছি, আবার বন্ধ করে দিয়েছি।
ইমদাদুল হক মিলন : একেবারে প্রথম দিকেই কি আপনি এ আঙ্গিকটা মাথায় রেখে শুরু করেছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না, যখন মূল লেখাটায় আসি, তখন মাথায় ছিল আমাকে এভাবে যেতে হবে, এই হবে আঙ্গিক, নয়তো এটা আমি পারব না। মিলন, মাফ করো। আজ আর না।
[পরের দিন আবার]
ইমদাদুল হক মিলন : ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আপনি কি বড় লেখক মনে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ : অবশ্যই।
ইমদাদুল হক মিলন : কী কী কারণে মনে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ : প্রথমত উনি একজন বড় কবি। একজন কবি যখন গদ্য লেখেন, তখন কবিতাক্রান্ত গদ্য লেখেন। তাঁর ক্ষেত্রে প্রথম দেখলাম একজন বড় কবি গদ্য লিখছেন, কবিতাক্রান্ত গদ্য না। সহজ সরল। তারপর দেখলাম, তাঁর কাহিনী তৈরি করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। শুধু কাহিনী তৈরি করা না, কাহিনীর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা_দুইটা-তিনটা-চারটা লাইন দিয়ে কাহিনীর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা বড় লেখক না হলে সম্ভব না।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো এবং আপনি সব সময় তাঁর ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের বড় পণ্ডিতরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সে অর্থে বড় লেখক মনে করেন না_এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
হুমায়ূন আহমেদ : বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের পণ্ডিতরা বিভিন্ন সময়ে অনেককেই বড় লেখক মনে করেননি। রবীন্দ্রনাথকেও অনেকে বড় লেখক মনে করেননি। একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এমএ পরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথের গদ্য তুলে দিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল শুদ্ধ বাংলায় লেখো। মানে তাঁদের ধারণা ছিল, রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলো অশুদ্ধ।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার বিবেচনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব বড় লেখক। তাঁর কোন কোন দিক আপনার খুব বড় লেখকের মতো মনে হয়? এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলি, আপনি একদিন আমাদের বলছিলেন_সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদি পৃথিবীর বড় ভাষাগুলোর দেশে জন্মাতেন, ফরাসি বা স্পেন বা ইংরেজি ভাষার কোনো দেশে, তাহলে নোবেল প্রাইজ পেতে পারতেন। আপনার এটা মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার মনে হয়। আসলে মিলন, আমাদের বাংলা ভাষায় কিন্তু অতি উচ্চমানের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষায় যেসব লেখক রয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কথা। অবশ্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্করের পাওয়া উচিত ছিল।
ইমদাদুল হক মিলন : এবং এঁদের পাশাপাশি সুনীলকেও মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, আমার মনে হয়।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি আরেকজন লেখকের ব্যাপারে খুব বলতেন_সতীনাথ ভাদুড়ী। এই লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রিয় একজন লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সব সময় তাঁর প্রিয় লেখকদের তালিকায় তাঁর নাম রাখেন। এবং তাঁর প্রিয় উপন্যাসের নাম বলেন_'ঢোড়াই চরিত মানস'। আপনি একমত তাঁর সঙ্গে?
হুমায়ূন আহমেদ : এই উপন্যাস আমাকে খুব একটা আকর্ষণ করেনি। এই উপন্যাসে তিনি এমন একটি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করেছেন, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত না। আমার মনে হয় সতীনাথ ভাদুড়ী 'ঢোড়াই চরিত মানস' উপন্যাসে টেকনিক্যাল দিকটাতে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন উপন্যাস লেখার সময়। কিন্তু উনি সহজ যেসব লেখা লিখেছেন, যেমন_অচিন রাগিণী, জাগরী খুবই শক্তিশালী লেখা। উনি খুবই বড়মাপের একজন লেখক, বিশেষ করে ছোটগল্পে।
ইমদাদুল হক মিলন : যে এক শ্রেণীর লোকের মুখের ভাষা বইতে থাকে, ধরেন আমি যদি 'লীলাবতী' বইটার প্রসঙ্গে আবার আসি_আপনি এই বইটায় ওই এলাকার লোকজনের মুখের ভাষা এনেছেন এবং বর্ণনার সময় অবলীলাক্রমে ব্যবহার করে গেছেন। এটা কেন করলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তা করেছি একটা সহজিয়া ভঙ্গিতে, যাতে যে পড়ে সে-ই বুঝতে পারে। যেমন_এখানে হয়তো তুমি একটা-দুটো শব্দ বুঝবে না, কিন্তু আবার অর্থটা সম্পূর্ণ বুঝবে। আমি কথ্য ভাষাটারই একটা আধুনিক ধরন দাঁড় করার চেষ্টা করেছি, যাতে পড়ে সবাই বুঝতে পারে। যেমন_তুমি যদি সিলেটি বা চিটাগাংয়ের ভাষায় বই লেখো তাহলে আমরা বাংলাভাষীরাও কিন্তু পড়ে কিছু বুঝব না। কাজেই সাহিত্য রচনার জন্য তো আমাদের একটা স্ট্যান্ডার্ড ভাষা দরকার।
ইমদাদুল হক মিলন : মানে, যা সব পাঠক বুঝবে? কমিউনিকেট করবে সবাইকে?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ। যেমন_সিলেটে দেখেছি, সিলেটি ভাষায় নাটক হচ্ছে। চট্টগ্রামের ভাষায়ও নাটক দেখেছি। কিন্তু ওই সব ভাষা শুনে আমার খটকা লাগে। কিছুই বুঝতে পারিনি। সিলেট বা চট্টগ্রামের লোকরা অবশ্য বুঝেছে। এখন একটা হুবহু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে আমার সাহিত্যকে ছোট করে ফেলব কেন? ছড়িয়ে দেব।
ইমদাদুল হক মিলন : বাংলা ভাষায় আপনার প্রিয় লেখক কারা, যাঁদের লেখা আপনি প্রায় সবই পড়েছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : একদম শুরু থেকে বলি_বঙ্কিমচন্দ্র। কেননা তাঁর গল্প তৈরির ক্ষমতা অসাধারণ। তারপর আমাদের শরৎচন্দ্র।
[আরেকদিন]
ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে কথা বললাম অনেক বিষয়ে। আজকে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই সেটি হলো মৃত্যুচিন্তা। আমি জানি যে আপনি মৃত্যু নিয়ে ভাবেন। জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃত্যু-পরবর্তী জগৎ নিয়েও আপনি ভাবেন। আপনার মৃত্যুচিন্তাটা কী রকম?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে। বর্ষা আসবে, জোছনা হবে; কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না, জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না। এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না। আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতই ওই দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই আর পারছি না।
ইমদাদুল হক মিলন : মানে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি আপনার এই বোধটা তীব্র হচ্ছে যে আপনি আর নিতে পারছেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, আমি তো মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি। আমরা সবাই আছি। আমি কিন্তু মৃত্যুকে দেখেছি। আমার মতো অনেকেই দেখেছেন। মৃত্যুকে দেখা ভয়াবহ ব্যাপার, নিজের মৃত্যুকে দেখা। ১৯৭১ সালে মিলিটারির হাতে যখন ধরা পড়েছিলাম, পাকিস্তানি মিলিটারি আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। আমি ফিরে আসি সেখান থেকে। তখন আমি মৃত্যুকে দেখেছি একদম চোখের সামনে। বয়সও ছিল কম। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। তারপর কয়েকবার আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। একবার তো খুবই ভয়াবহ অবস্থা ছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে মারা যাচ্ছি। আমার আশপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা জোরে জোরে কালেমা পাঠ করছিলেন। কালেমার শব্দ শোনাতে শোনাতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। ডাক্তাররা বললেন, অবস্থা খুবই খারাপ। আত্মীয়স্বজনকে খবর দেন। তখন আমার মা-ভাই-বোন সবাইকে খবর দেওয়া হলো। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। তারপর হলো আমার বাইপাস অপারেশন। বাইপাস অপারেশনের সময় যখন অ্যানেসথেশিয়ার কাজ শুরু হলো, যখন আমি তলিয়ে যাচ্ছি, সেই সময় হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, এই যে তলিয়ে যাচ্ছি, হয়তো বা আমি আর এখান থেকে উঠে আসতে পারব না। তখন আরেকবার খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখলাম। বারবার মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুচিন্তাটি মাথায় আসে। আমার মধ্যে যেটা হয়, আমি নেই অথচ সব কিছু আগের মতোই আছে_এই বোধটা আমাকে খুব কঠিনভাবে আক্রমণ করে। বেশির ভাগ মানুষকেই আমি দেখেছি, তাঁরা খুব সহজভাবে মৃত্যুকে নেন এবং বলেন, আমি নেই তো কী হয়েছে, আমার ছেলেমেয়েরা আছে, আত্মীয়স্বজন আছে, পরবর্তী প্রজন্ম আছে। আমি থাকব না, তারা তো থাকবে। এভাবেই অনেকে বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেন। আমি কেন জানি নিতে পারি না। আমার কাছে আমি থাকাটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইমদাদুল হক মিলন : বড় লেখকদের ক্ষেত্রে কালজয়ী শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে। যাঁরা সময়কে জয় করে নেন নিজের লেখার মধ্য দিয়ে। আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন_এই ফিলিংসটা আপনার কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ : এই বিষয়টা একেবারেই আমার মাথায় আসে না। আমিই নেই আর আমার লেখা লোকজন পাঠ করছে, এতে আমার কী যায়-আসে?
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু এ রকম কি কখনো মনে হয় না, আমার যে লেখাগুলো আমি রেখে যাচ্ছি, তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, লোকজন আমাকে স্মরণ করবে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, সে রকম মনে হয় না। মিলন, আমি তোমাকে সিরিয়াসলি বলছি, আই অ্যাম টেলিং ইউ ফ্রম মাই হার্ট...এই চিন্তাটা কখনো আমার হয় না যে ৫০ বছর পর লোকে আমার লেখা পড়বে, আমি কত ভাগ্যবান! আমি সারা জীবন লেখালেখি করেছি নিজের আনন্দের জন্য। [চলবে]
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, আমি খুশি।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মনে হয়েছে, আপনি যেভাবে লিখতে চেয়েছেন সেভাবে লিখতে পেরেছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : এক শ ভাগ। আসলে প্রত্যেককে নিজের প্রতিভা দেওয়া হয়েছে। প্রতিভার বাইরে কেউ কাজ করবে না। যে প্রতিভা দিয়ে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন, আমি কাজ করব তার ভেতরেই। আমি যদি মনে করি, এটা দিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখব, সেটা হবে 'ওয়ার অ্যান্ড পিস', তা তো ঠিক হবে না। আমাকে যদি আল্লাহপাক 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' লেখার ক্ষমতা দিয়ে দেন, সেটা হবে ওয়ার অ্যান্ড পিসের মতো লেখা। আমাকে যেটুকু প্রতিভা আল্লাহ দিয়েছেন, সেই প্রতিভার পুরোটা আমি কাজে লাগিয়েছি। অনেক উপন্যাসে আমার ঘাটতি আছে, এ উপন্যাসে আমার কেনো ঘাটতি নেই।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি এ উপন্যাসে নানা ধরনের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের এ উপন্যাসে আপনি কখনো কখনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে দিয়েছেন, কখনো বা বেশ অভিনব পদ্ধতিতে লেখক ইনভলভড হয়েছেন লেখাটিতে। আপনি সব সময় বলেন আপনি স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। এই উপন্যাসে আপনার লেখা কি ওভাবেই এসেছে? নাকি আপনি আগে থেকেই আঙ্গিক ঠিক করেছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি আঙ্গিক আগে থেকেই ভেবেছিলাম। আমি দেখলাম জাতিসংঘে কী হলো, সাধারণ সভায় কী হলো_সেটা আমি সঠিক একটা লাইন দিয়ে দিতে চাইলাম। ভাবলাম মূল লেখার ভঙ্গি এসব একত্রে মিলিয়ে দেখি না, জিনিসটা কেমন হয়।
ইমদাদুল হক মিলন : তার মানে, এ উপন্যাসটির সব কিছু আপনার পরিকল্পিত।
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ পরিকল্পিত। এ উপন্যাস লেখার কাজটি আমি অনেকবার শুরু করেছি, আবার বন্ধ করে দিয়েছি।
ইমদাদুল হক মিলন : একেবারে প্রথম দিকেই কি আপনি এ আঙ্গিকটা মাথায় রেখে শুরু করেছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : না, যখন মূল লেখাটায় আসি, তখন মাথায় ছিল আমাকে এভাবে যেতে হবে, এই হবে আঙ্গিক, নয়তো এটা আমি পারব না। মিলন, মাফ করো। আজ আর না।
[পরের দিন আবার]
ইমদাদুল হক মিলন : ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আপনি কি বড় লেখক মনে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ : অবশ্যই।
ইমদাদুল হক মিলন : কী কী কারণে মনে করেন?
হুমায়ূন আহমেদ : প্রথমত উনি একজন বড় কবি। একজন কবি যখন গদ্য লেখেন, তখন কবিতাক্রান্ত গদ্য লেখেন। তাঁর ক্ষেত্রে প্রথম দেখলাম একজন বড় কবি গদ্য লিখছেন, কবিতাক্রান্ত গদ্য না। সহজ সরল। তারপর দেখলাম, তাঁর কাহিনী তৈরি করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। শুধু কাহিনী তৈরি করা না, কাহিনীর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা_দুইটা-তিনটা-চারটা লাইন দিয়ে কাহিনীর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা বড় লেখক না হলে সম্ভব না।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো এবং আপনি সব সময় তাঁর ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের বড় পণ্ডিতরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সে অর্থে বড় লেখক মনে করেন না_এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
হুমায়ূন আহমেদ : বাংলা ভাষার বা সাহিত্যের পণ্ডিতরা বিভিন্ন সময়ে অনেককেই বড় লেখক মনে করেননি। রবীন্দ্রনাথকেও অনেকে বড় লেখক মনে করেননি। একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এমএ পরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথের গদ্য তুলে দিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল শুদ্ধ বাংলায় লেখো। মানে তাঁদের ধারণা ছিল, রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলো অশুদ্ধ।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার বিবেচনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব বড় লেখক। তাঁর কোন কোন দিক আপনার খুব বড় লেখকের মতো মনে হয়? এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলি, আপনি একদিন আমাদের বলছিলেন_সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদি পৃথিবীর বড় ভাষাগুলোর দেশে জন্মাতেন, ফরাসি বা স্পেন বা ইংরেজি ভাষার কোনো দেশে, তাহলে নোবেল প্রাইজ পেতে পারতেন। আপনার এটা মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার মনে হয়। আসলে মিলন, আমাদের বাংলা ভাষায় কিন্তু অতি উচ্চমানের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষায় যেসব লেখক রয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কথা। অবশ্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্করের পাওয়া উচিত ছিল।
ইমদাদুল হক মিলন : এবং এঁদের পাশাপাশি সুনীলকেও মনে হয়?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, আমার মনে হয়।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি আরেকজন লেখকের ব্যাপারে খুব বলতেন_সতীনাথ ভাদুড়ী। এই লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রিয় একজন লেখক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সব সময় তাঁর প্রিয় লেখকদের তালিকায় তাঁর নাম রাখেন। এবং তাঁর প্রিয় উপন্যাসের নাম বলেন_'ঢোড়াই চরিত মানস'। আপনি একমত তাঁর সঙ্গে?
হুমায়ূন আহমেদ : এই উপন্যাস আমাকে খুব একটা আকর্ষণ করেনি। এই উপন্যাসে তিনি এমন একটি ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করেছেন, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত না। আমার মনে হয় সতীনাথ ভাদুড়ী 'ঢোড়াই চরিত মানস' উপন্যাসে টেকনিক্যাল দিকটাতে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন উপন্যাস লেখার সময়। কিন্তু উনি সহজ যেসব লেখা লিখেছেন, যেমন_অচিন রাগিণী, জাগরী খুবই শক্তিশালী লেখা। উনি খুবই বড়মাপের একজন লেখক, বিশেষ করে ছোটগল্পে।
ইমদাদুল হক মিলন : যে এক শ্রেণীর লোকের মুখের ভাষা বইতে থাকে, ধরেন আমি যদি 'লীলাবতী' বইটার প্রসঙ্গে আবার আসি_আপনি এই বইটায় ওই এলাকার লোকজনের মুখের ভাষা এনেছেন এবং বর্ণনার সময় অবলীলাক্রমে ব্যবহার করে গেছেন। এটা কেন করলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি তা করেছি একটা সহজিয়া ভঙ্গিতে, যাতে যে পড়ে সে-ই বুঝতে পারে। যেমন_এখানে হয়তো তুমি একটা-দুটো শব্দ বুঝবে না, কিন্তু আবার অর্থটা সম্পূর্ণ বুঝবে। আমি কথ্য ভাষাটারই একটা আধুনিক ধরন দাঁড় করার চেষ্টা করেছি, যাতে পড়ে সবাই বুঝতে পারে। যেমন_তুমি যদি সিলেটি বা চিটাগাংয়ের ভাষায় বই লেখো তাহলে আমরা বাংলাভাষীরাও কিন্তু পড়ে কিছু বুঝব না। কাজেই সাহিত্য রচনার জন্য তো আমাদের একটা স্ট্যান্ডার্ড ভাষা দরকার।
ইমদাদুল হক মিলন : মানে, যা সব পাঠক বুঝবে? কমিউনিকেট করবে সবাইকে?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ। যেমন_সিলেটে দেখেছি, সিলেটি ভাষায় নাটক হচ্ছে। চট্টগ্রামের ভাষায়ও নাটক দেখেছি। কিন্তু ওই সব ভাষা শুনে আমার খটকা লাগে। কিছুই বুঝতে পারিনি। সিলেট বা চট্টগ্রামের লোকরা অবশ্য বুঝেছে। এখন একটা হুবহু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে আমার সাহিত্যকে ছোট করে ফেলব কেন? ছড়িয়ে দেব।
ইমদাদুল হক মিলন : বাংলা ভাষায় আপনার প্রিয় লেখক কারা, যাঁদের লেখা আপনি প্রায় সবই পড়েছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : একদম শুরু থেকে বলি_বঙ্কিমচন্দ্র। কেননা তাঁর গল্প তৈরির ক্ষমতা অসাধারণ। তারপর আমাদের শরৎচন্দ্র।
[আরেকদিন]
ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে কথা বললাম অনেক বিষয়ে। আজকে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই সেটি হলো মৃত্যুচিন্তা। আমি জানি যে আপনি মৃত্যু নিয়ে ভাবেন। জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃত্যু-পরবর্তী জগৎ নিয়েও আপনি ভাবেন। আপনার মৃত্যুচিন্তাটা কী রকম?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে। বর্ষা আসবে, জোছনা হবে; কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না, জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না। এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না। আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতই ওই দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই আর পারছি না।
ইমদাদুল হক মিলন : মানে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি আপনার এই বোধটা তীব্র হচ্ছে যে আপনি আর নিতে পারছেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, আমি তো মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি। আমরা সবাই আছি। আমি কিন্তু মৃত্যুকে দেখেছি। আমার মতো অনেকেই দেখেছেন। মৃত্যুকে দেখা ভয়াবহ ব্যাপার, নিজের মৃত্যুকে দেখা। ১৯৭১ সালে মিলিটারির হাতে যখন ধরা পড়েছিলাম, পাকিস্তানি মিলিটারি আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। আমি ফিরে আসি সেখান থেকে। তখন আমি মৃত্যুকে দেখেছি একদম চোখের সামনে। বয়সও ছিল কম। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। তারপর কয়েকবার আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। একবার তো খুবই ভয়াবহ অবস্থা ছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে মারা যাচ্ছি। আমার আশপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা জোরে জোরে কালেমা পাঠ করছিলেন। কালেমার শব্দ শোনাতে শোনাতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। ডাক্তাররা বললেন, অবস্থা খুবই খারাপ। আত্মীয়স্বজনকে খবর দেন। তখন আমার মা-ভাই-বোন সবাইকে খবর দেওয়া হলো। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। তারপর হলো আমার বাইপাস অপারেশন। বাইপাস অপারেশনের সময় যখন অ্যানেসথেশিয়ার কাজ শুরু হলো, যখন আমি তলিয়ে যাচ্ছি, সেই সময় হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, এই যে তলিয়ে যাচ্ছি, হয়তো বা আমি আর এখান থেকে উঠে আসতে পারব না। তখন আরেকবার খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখলাম। বারবার মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুচিন্তাটি মাথায় আসে। আমার মধ্যে যেটা হয়, আমি নেই অথচ সব কিছু আগের মতোই আছে_এই বোধটা আমাকে খুব কঠিনভাবে আক্রমণ করে। বেশির ভাগ মানুষকেই আমি দেখেছি, তাঁরা খুব সহজভাবে মৃত্যুকে নেন এবং বলেন, আমি নেই তো কী হয়েছে, আমার ছেলেমেয়েরা আছে, আত্মীয়স্বজন আছে, পরবর্তী প্রজন্ম আছে। আমি থাকব না, তারা তো থাকবে। এভাবেই অনেকে বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেন। আমি কেন জানি নিতে পারি না। আমার কাছে আমি থাকাটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইমদাদুল হক মিলন : বড় লেখকদের ক্ষেত্রে কালজয়ী শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে। যাঁরা সময়কে জয় করে নেন নিজের লেখার মধ্য দিয়ে। আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন_এই ফিলিংসটা আপনার কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ : এই বিষয়টা একেবারেই আমার মাথায় আসে না। আমিই নেই আর আমার লেখা লোকজন পাঠ করছে, এতে আমার কী যায়-আসে?
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু এ রকম কি কখনো মনে হয় না, আমার যে লেখাগুলো আমি রেখে যাচ্ছি, তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, লোকজন আমাকে স্মরণ করবে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, সে রকম মনে হয় না। মিলন, আমি তোমাকে সিরিয়াসলি বলছি, আই অ্যাম টেলিং ইউ ফ্রম মাই হার্ট...এই চিন্তাটা কখনো আমার হয় না যে ৫০ বছর পর লোকে আমার লেখা পড়বে, আমি কত ভাগ্যবান! আমি সারা জীবন লেখালেখি করেছি নিজের আনন্দের জন্য। [চলবে]
No comments