আলোকের এই ঝরনাধারায় পর্ব-৫৩-এশিয়াটিকে যোগদান by আলী যাকের

সে সময় কোনো এক সূত্রে খবর পেলাম যে একটি নতুন বিজ্ঞাপন এজেন্সি তাদের শাখা অফিস খুলবে ঢাকায় এবং সে জন্য তারা অভিজ্ঞ বাঙালি নির্বাহীর সন্ধান করছে। শুনেই লাফ দিয়ে উঠলাম। এ যে সুবর্ণ সুযোগ! যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমি সেই এজেন্সির অফিসে গেলাম। আমাকে তাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে বলা হলো। তিনি আমার একটি লিখিত পরীক্ষা নিলেন। ইংরেজি বিজ্ঞাপন লেখার পরীক্ষা। ভালোই লিখেছিলাম বোধ হয়।


তিনি আমাকে ১৫ মিনিট বাইরে বসতে বলে আমার লেখা কপিটি নিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। ফিরে এসে হাসিমুখে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আমি কবে তাঁদের চাকরিতে যোগ দিতে পারি। আমি তো আহ্লাদে আটখানা। তবে আমার পুরনো কম্পানিকে নোটিশ দেওয়ার দরকার ছিল। নূ্যনপক্ষে এক মাসের। কাজেই এক মাস পরের একটি তারিখ আমি তাঁর কাছে উল্লেখ করলাম। এই এক মাস যে কিভাবে কেটে গেল, সে হিসাব এখনো আমি মেলাতে পারি না। ইতিমধ্যে এই নতুন এজেন্সি এশিয়াটিক থেকে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে গেলাম। তারপর নির্ধারিত তারিখে আমি গিয়ে সেই প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। এই কম্পানিতে যোগদানের পর ছয় মাস আমায় করাচিতে থাকতে হবে তাদের কাজের ধরন বোঝার জন্য। এই সময় আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত এক বন্ধু, মজিদ চার্টার্ড ব্যাংকের চাকরি নিয়ে করাচিতে এল। আমিও সরকারি কোয়ার্টারের মেস ছেড়ে ওর সঙ্গে একটি বাসায় উঠে এলাম। একটা সুবিধা হয়েছিল, এশিয়াটিকে আমার মাসিক অর্জন দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। অতএব স্বভাবতই খাওয়া-থাকায় অনেক উন্নতি হয়েছিল। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। আমার ক্রফোর্ডের চাকরি এবং এশিয়াটিকের চাকরির ব্যাপারে খবর দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছিল আমার সেই দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই আনোয়ারুল ইসলাম ববি। ববি আমার চেয়ে বয়সে দুই বছরের বড় ছিল, কিন্তু সম্পর্ক ছিল একেবারে বন্ধুর মতো। বছর কয়েক আগে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে সে কর্কটরোগে মারা যায়। ববি পশ্চিম পাকিস্তানে তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার এবং পূর্বদেশ পত্রিকার আঞ্চলিক প্রতিনিধি ছিল। প্রচণ্ড জীবনীশক্তি ছিল ওর মধ্যে। ওর সঙ্গে করাচি এবং সিন্ধু প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় আমি নিত্যই ঘুরে বেড়িয়েছি। মনে পড়ে, খুব ভোরে উঠে ববির গাড়িতে চড়ে সিন্ধু প্রদেশের হায়দরাবাদের কাছে বিভিন্ন হ্রদে পাখি শিকার করতে যাওয়ার কথা। বাল্যকালে এই বিদ্যায় পারদর্শী হয়েছিলাম। ববির বন্দুকে আবার হাত ঝালিয়ে নেওয়া গেল। এখন যদিও আমি বন্দুক থেকে অনেক দূরে, তখন কিন্তু বেশ ভালোই লাগত। আমরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত পাখি শিকার করেছি। একবার সন্ধ্যাবেলায় ববির সঙ্গে করাচির রাস্তায় হাঁটতে বেরোলাম। বলা নেই কওয়া নেই, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হলো। ববিকে বললাম একটা ট্যাঙ্ িনিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। ও বলল, 'বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোই তো লাগছে।' সেই রাতে ববির বাসায় ভাত খেতে খেতে ধুম জ্বর এল আমার। কোনোমতে পা টেনে নিয়ে ববির গেস্ট রুমের বিছানায় সেই যে শয্যা নিলাম, প্রায় তিন সপ্তাহ পর সেই জ্বর নামল। পরে শুনলাম যে আমার টাইফয়েড হয়েছিল। এর মধ্যে কখন যে ডাক্তার এসেছে, ইনজেকশন দিয়েছে, আমি টেরই পাইনি বলতে গেলে। যা হোক, এই সময় ববি আমার পাশে না থাকলে হয়তো বেঁচেই উঠতে পারতাম না।
করাচিতে থাকাকালীন আমার বেশ কয়েকজন অবাঙালি বন্ধু হয়েছিল। তাদের বেশির ভাগই সিন্ধি অথবা পাঠান। আমি লক্ষ করেছি যে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঠান, সিন্ধি এবং বেলুচদের মধ্যে বাঙালিদের মতোই পাকিস্তানবিরোধী একটি মনোভাব কাজ করত। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতারা কেউই আক্ষরিক অর্থে পাকিস্তানি ছিলেন না। অর্থাৎ যে পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল যেমন পূর্ব বাংলা, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সিন্ধু প্রদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। এই পাঁচটি প্রদেশের কেউ পাকিস্তানের প্রধান নেতা ছিলেন না। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন করাচি নিবাসী গুজরাটি, লিয়াকত আলী খান ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের। খাজা নাজিমুদ্দিনকে জন্মসূত্রে পূর্ব বাংলার বলা যেতে পারে বটে, তবে তিনি বাংলায় কথা বলতে জানতেন না। পাকিস্তান সৃষ্টির কালে দ্বিতীয় সারির নেতারা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ছিলেন এবং তাঁরাই পাকিস্তান সৃষ্টির পর সেখানকার প্রধান নেতা হিসেবে সব কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা নিতেন। পাঞ্জাবিদের এই প্রাধান্যের পেছনে আরো একটি কারণ ছিল এই যে জন্মের সময় থেকেই পাকিস্তানে সেনাবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ অফিসার পাঞ্জাব প্রদেশের মুসলমান ছিলেন। অতএব সিন্ধি, বেলুচ এবং পাঠানরা পাঞ্জাবিদের খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। বাঙালিদের সঙ্গে তাঁদের খুব ভালো জমত। ইতিহাসের দিকে যদি দৃষ্টি দিই, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে যুক্ত বাংলার অবিসংবাদিত নেতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু যখন ব্রিটিশ রাজদের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে গেলেন, তাঁকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়েছিলেন এক পাঠান এবং তিনি পালিয়েছিলেন পেশোয়ার হয়ে। আমি আমার পাঠান এবং সিন্ধি বন্ধুদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দুরবস্থা নিয়ে প্রায়ই আলাপ করতাম এবং তাদের আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই মনে হতো আমার কাছে।
(চলবে.....)

No comments

Powered by Blogger.