বেহাল নগর by কাজী আবুল মনসুর

গরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি। প্রতিনিয়ত দখল হচ্ছে সড়ক থেকে শুরু করে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ খাল ও নালা। নগর উন্নয়নে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) কাছে আন্তর্জাতিক মানের প্ল্যান থাকলেও কাজ হচ্ছে না ওই প্ল্যান অনুযায়ী। এসব কারণে নগর এখন বেহাল। এদিকে নগরীর বেহাল অবস্থার জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। চসিক বলছে, চউকের বরাদ্দ বেশি, তাই নগর


উন্নয়নের দায়িত্বও তাদের বেশি। অপরদিকে চউকের সোজা কথা, সড়ক নির্মাণের পর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চসিকের, কিন্তু তারা সেটি সঠিকভাবে পালন করছে না।বর্তমান সরকার চউককে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। অপরদিকে চসিককে গত ২০১০-২০১১ অর্থবছরে বরাদ্দ দিয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এর পরও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না চট্টগ্রাম মহানগরে। সচেতন মহলের মতে, চউক ও চসিকের মধ্যে সমন্বয় না থাকার মাসুল দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য ইউএনডিপির সহায়তায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রণীত হয় মাস্টার প্ল্যান। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯৯৪ সালে এ মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেন। ১৯৯৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্ল্যানটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। দু'বছর পর এর অনুমোদন মেলে। এ মাস্টার প্ল্যানটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব চউক, সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, ওয়াসা, সড়ক ও জনপথসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় এক যুগ ধরে মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী কোনো কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, চউকের প্ল্যান পাস হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো চউক কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে যত্রতত্র ভবন নির্মাণ করছে। এতে কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে মাস্টার প্ল্যান।
১৯৬১ সালে চউক অর্ডিন্যান্স প্রভিশনের ভিত্তিতে সংস্থার নিয়ন্ত্রিত ২১২ বর্গমাইল এলাকার ওপর রিজিওনাল ও এর অন্তর্ভুক্ত একশ' বর্গমাইল এলাকার ওপর প্রথম মাস্টার পল্গ্যান প্রণীত হয়। তখনও প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হয়নি। পরে ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত চট্টগ্রামকে পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যে নতুন প্ল্যানের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। পরের বছর শুরু হয় কাজ। ১৯৯৭ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও '৯৫ সালেই তা শেষ হয়ে যায়। এতে ব্যয় দেখানো হয় ১২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় 'স্ট্রাকচার প্ল্যান, মাস্টার প্ল্যান ও ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান ফর চিটাগাং সিটি' নামের এ প্রকল্পে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়; যাতে রয়েছে স্ট্রাকচার প্ল্যান ও আরবান ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান। এ দুই প্ল্যানের সমর্থনে একটি ট্রান্সপোর্টেশন ও একটি ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানও করা হয়। স্ট্রাকচার প্ল্যানটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা, যার মেয়াদ ২০ বছর (১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সাল)। পরিকল্পনাটির ভৌগোলিক বিস্তৃতি ৪৪৬ বর্গমাইল, যা চউকের নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমান এলাকার দ্বিগুণেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউএনডিপির কনসালটেন্ট বেদ প্রকাশ '৯৮ সালে চট্টগ্রাম আসেন মাস্টার পল্গ্যানটির রিভিউ করতে। কিন্তু যখন তিনি জানেন প্ল্যানটি অনুমোদনই পায়নি তখন তিনি চরম হতাশা ব্যক্ত করে ফিরে যান। শেষ পর্যন্ত '৯৯ সালে প্ল্যানটি অনুমোদন পায়। অনুমোদনের পর চট্টগ্রামবাসী আশা করেছিল, এবার প্ল্যান অনুযায়ীই সব কাজ হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, প্ল্যানটি সীমাবদ্ধ রয়েছে কেবল কাগজ-কলমে।
নগরে পাকা ভবন নির্মাণ করতে হলে চউকের অনুমোদন প্রয়োজন। বাড়ির নকশা ঠিক আছে কি-না, বাড়ির পাশে খোলা জায়গা কতটুকু আছে তা যাচাই-বাছাই করেই চউকের প্ল্যান পাস করার নিয়ম। তবে নিয়ম থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। টাকা দিলেই মেলে চউকের অনুমোদন। টাকা পেলে কোথায়, কীভাবে ঘরবাড়ি নির্মিত হচ্ছে তা দেখার প্রয়োজন মনে করে না চউকের দুর্নীতিবাজরা। এমনকি ওই দুর্নীতিবাজদের ঘুষ দিলে চউকের অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা যায় দালান। এ কারণে নগরীর ৬০ শতাংশ দালানের কোনো অনুমোদন নেই!
মাস্টার প্ল্যানে নিষিদ্ধ এমন জায়গায়ও গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। মাস্টার প্ল্যানে বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ ও টাইগারপাসের পাহাড় কেন্দ্র করে বিশেষ নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
এদিকে মাস্টার প্ল্যানে চট্টগ্রামের জলবদ্ধতাকে প্রধান সমস্যা দেখিয়ে দখল হয়ে যাওয়া নগরীর ২২টি প্রাকৃতিক খাল পুনরুদ্ধার ও ৩৩টি নতুন খাল খননের কথা উল্লেখ রয়েছে। নগরীর চাক্তাই খাল, মির্জা খাল, সদরঘাট খাল, হিজরা খাল, ত্রিপুরছড়া খাল, শীতল ঝরনা খাল, নয়া খাল, ঢাকা ট্রাংক লেইন খাল, রামপুর খাল, নাছির খাল, পাকিজা খাল, মহেশ খাল, কালীরছড়া খাল, গইন্যাছড়া খাল, কাট্টলী খাল, জামাল খান খাল, চট্টেশ্বরী খাল, নেভাল খাল, মুন্সি খাল, উত্তরা খাল, গুপ্ত খাল ও জেলেপাড়া খাল ইতিমধ্যে প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। এসব খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন কার্যত বন্ধ। এগুলো পুনরুদ্ধার এবং চাক্তাই খালের সঙ্গে সংযুক্ত ১৫টি উপ-খাল সংস্কারের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে সিটি মেয়র মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান মতে জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে মেয়র জানান।
অপরদিকে নগরীর সড়ক দখল হতে হতে সরু থেকে আরও সরু হচ্ছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের বিশাল এলাকা এখনও রয়ে গেছে অবৈধ দখলে। একইসঙ্গে নগরীর যেসব উপ-সড়ক দখলে রয়েছে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে না। আবার নগরীর সড়কগুলো সনাতনী পরিকল্পনায় নির্মিত হওয়ায় এগুলোর বেশিরভাগ বর্তমানে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব সড়কে প্রায় সময় থাকে যানজট। অথচ মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহরে বাইপাস সড়ক নির্মাণের কথা রয়েছে। বিষয়টি বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত এটি বাস্তবায়ন হয়নি। প্রস্তাবিত বাইপাস সড়কটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার শাহ্ আমানত সেতু হয়ে কালুরঘাট- মোহরা- মদুনাঘাট- হাটহাজারী-ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে ভাটিয়ারি হয়ে ঢাকা যাবে। প্রাথমিক জরিপে এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্ল্যানে শহরের পুরনো আমলের সড়ক ব্যবস্থার পরিবর্তন করে ৭৩ কিলোমিটারের একটি রেডিয়েল সড়ক নির্মাণের প্রস্তাবও রয়েছে। প্রস্তাবিত এ সড়কে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিমানবন্দর থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার, ফৌজদারহাট থেকে ভাটিয়ারি পর্যন্ত ২ কিলোমিটার, বড়দিঘির পাড় থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার, মদুনাঘাট থেকে মোহরা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার, মোহরা থেকে কালামিয়া বাজার পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার, কালামিয়া বাজার থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার, বারিক বিল্ডিং থেকে নেভাল হেড কোয়াটার পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এবং নেভাল হেড কোয়াটার থেকে বিমানবন্দর বেড়িবাঁধ পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সড়ক। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা লেগেই আছে। যে কারণে বছর ঘুরে বছর এলেও দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর।
চলতি বছর বর্ষায় নগরীর সড়কগুলোর অবস্থা আরও করুণ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় চউকের মতো বরাদ্দ চেয়েছেন চসিক মেয়র এম মনজুর আলম। তিনি সমকালকে বলেন, 'নগরীর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না পাওয়ায় নগরীর ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো সংস্কারে বিলম্ব হচ্ছে।'
 

No comments

Powered by Blogger.