কাদম্বিনী বক্রভাষী by সাইদ হাসান দারা
'মেজদিদি' রচনায় শরৎ চন্দ্র তাঁর জাদুময়ী লেখনীশক্তির মাধ্যমে তৎকালীন সময়ের সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং মানসিক স্থবিরতাকে এমন একটা চতুষ্কোণী ফ্রেমে বন্দি করে ফেলেছেন, যে সমাজব্যবস্থা ও মানসিক স্থবিরতা বর্তমান কালেও বিরাজমান। তবে ভিন্ন রঙে একই লক্ষ্যে ও উপলক্ষে। অর্থাৎ অতীতকালেও যেমন সৎ-মা বা সৎ-ছেলেমেয়ে নিয়ে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ও বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে, এখনো তেমনি পারিবারিক
জীবনে সৎ-ছেলেমেয়েদের পরিবর্তে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। ভোরবেলায় খবরের কাগজ খুললে আমাদের প্রায়ই চোখে পড়ে, অমুক গৃহকর্মীর গরম খুন্তির ছ্যাঁকায় ১২ বছরের শিশু দগ্ধ...।
এসব কারণে শরৎ রচনায় শ্রীমতী কাদম্বিনী যথার্থই বাংলা সাহিত্যের অগণন খলনায়িকাদের মধ্যে অন্যতম চরিত্র, এই বিষয়টা তাঁর দীর্ঘ ছোটগল্প 'মেজদিদি'(!) পাঠ করলে প্রথমেই মনে হবে। সেই সঙ্গে এ-ও মনে হবে, ওই শ্রীমতীরা যেমন ব্যক্তি ও সমাজজীবনে শতবর্ষ আগে ছিলেন, তেমনি জগতের শেষ ঘণ্টা বাজা অবধি তাঁরা টিকে থাকবেন; এমনকি শ্রীমানরাও। কারণ ব্যাপারটা প্রকৃতির নিয়মের আওতাভুক্ত। ওঁরা ছাড়া জগৎ-সংসারে এক বিরাট অচলাবস্থা নেমে আসবে। যেমন রাত্রি ছাড়া দিবসের মহিমা বোঝা অসম্ভব, কিংবা দিবস ছাড়া রাত্রির...!
যা হোক আলোচ্য বিষয় যেহেতু খল-চরিত্র বা খলনায়িকা : সেহেতু পাঠক 'মেজদিদি' পাঠমাত্র সর্বপ্রথম কেষ্ট নামের এমন এক অনাথ বালকের বর্তমান হাল-অবস্থা দেখতে পায়, যাতে শুরুতেই তার সুকোমল হৃদয়টি হতভাগ্য কিশোরটির জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কারণ অনাথ কেষ্টর প্রতি সমাজের যে দায়িত্ব ছিল, তা পালনে সমাজ পুরোপুরি ব্যর্থ হয় এবং সেটাকে সে অস্বীকার করার জন্য একজন নরসুন্দরের মাধ্যমে তাকে দূর গাঁয়ের নামমাত্র একজন বৈমাত্র ভগি্নর সংসারে গছিয়ে দিতে পাঠায়।
সম্বোধনে রমণীটি কেষ্টর ভগি্ন হলেও কার্যত তারা উভয়েই ছিল পরস্পরের সম্পূর্ণ অচেনা এবং উভয়ে শুধু বৈমাত্র সম্পর্কে আবদ্ধ। আবেগের চোরাগর্ত ভরা শরৎ বাবুর এই আখ্যানের ঘটনা-বিস্তারে কাদম্বিনী কিংবা হেমাঙ্গিনি চরিত্রের অতীত সম্বন্ধে পাঠকের দ্বারা জানা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ কাদম্বিনী কিভাবে নবীন মুখার্জির মতো প্রায় অদৃশ্য এক সচ্ছল ধান-চালের কারবারির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো এবং সংসারজীবনে অতটা পথ অতিক্রম করল!
পাশাপাশি তার মায়ের মৃত্যু কবে ঘটেছিল, তখন তার অবস্থান কোথায় ছিল, পরবর্তী সময়ে তার বাবা দ্বিতীয়বারের মতো কখন বেলতলায় গেল (দ্বিতীয় বিবাহ), অতঃপর একজন পুত্রসন্তানের জনক হয়ে কিভাবে পটল তুলতে সক্ষম হলো, পাঠক সেসব কথা কখনোই জানতে পারে না!
এই অস্পষ্টতা শুধু কাদম্বিনীর ক্ষেত্রে নয়, বরং একমাত্র কেষ্ট ছাড়া অন্য সব চরিত্রও রয়েছে কুয়াশায় আবৃত, মৌন। অন্যদিকে কাদম্বিনী যে অত্যন্ত মুখরা রমণী তা কিন্তু সহজেই পাঠক বুঝতে পারে, যখন সে তার ধান-চালের আড়তকারবারি মহাজন স্বামীর মুখোমুখি হয়। অর্থাৎ স্বামী নবীন মুখার্জি যখন বেলা ১২টা নাগাদ গৃহে প্রবেশ করে, কেষ্ট দর্শন সম্পূর্ণ করে স্ত্রীর কাছে জানতে চাইল_এটি কে? তখন কাদম্বিনীর যে সহজ কথাটি বলা সমীচীন ছিল তার পরিবর্তে সে এমন এমন দীর্ঘ বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য পেশ করে, যেটি স্পষ্ট করে দেয়, বাতচিতের ক্ষেত্রে সে স্বামীর সঙ্গেও একগুঁয়ে। অর্থাৎ ওটা কাদম্বিনীর জন্য স্বভাবজাত ব্যাপার, সে সংসারের সাধারণ কথাটিও ওভাবেই বলে। এখানে একটি কথা ভুললে চলবে না যে কাদম্বিনী ও হেমাঙ্গিনির বড় হওয়ার পরিবেশ এক ছিল না। হেমাঙ্গিনি যেমন মসৃণ ও অনুকূল পথে অনায়াসে স্বাভাবিক চারিত্রিক ঔদার্য অর্জন করে, সেই রকম মসৃণ ও অনুকূল পরিবেশ কাদম্বিনী জীবনে কোনোদিনই পায় না। বরং তাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিশ্রম ও প্রতিকূলতার পথ পাড়ি দিতে হয়। যে কারণে কাদম্বিনী হেমাঙ্গিনির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রবৈশিষ্ট্য অর্জন করে। কাজেই কাদম্বিনী যা পছন্দ করে হেমাঙ্গিনি তা খুবই অপছন্দ করে। তাদের দুজনের ব্যাপারটি যেন একই চম্বুক দণ্ডের দুটি প্রান্ত, দুই চরিত্র, দুই মেরুর বাসিন্দা।
কাদম্বিনী তার জগৎ-সংসারে আপনার বাইরে কাউকে ভালোবাসতে না পারার যন্ত্রণায় যেমন সবাইকে ঝাঁঝিয়ে-তাঁতিয়ে তুলছে, তেমনি যেন হেমাঙ্গিনিও ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণায় বড় আকুল-ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, এ কথা কেবল সচেতন পাঠকই টের পাবেন_যখন তারা দেখতে পান, অসুস্থাবস্থায় সন্ধ্যার সময় সে যখন তার শয্যায় একাকী শুয়ে আছে, এমন সময় উত্তম সাজপোশাক পরে তার পুত্র ললিত ঘরে প্রবেশ করে অন্যত্র পুতুল নাচ দেখতে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে; আর তখন সাধু চরিত্রের রমণী হেমাঙ্গিনি যেন সহসা তার গুপ্ত কথাটি জানিয়ে দেয়, নিজের অগোচরেই বলে ওঠে_'হাঁরে ললিত, তোর মা যে পাঁচ-ছ দিন পড়ে আছে একটিবারও তো কাছে আসিসনি...!'
এসব নানাবিধ কারণে বক্রভাষী কাদম্বিনীকে খলনায়িকার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অতটা উচিত হবে না, আবার তেমনি চুলচেরা বিশ্লেষণে হেমাঙ্গিনিকেও সাধু চরিত্রের সার্টিফিকেট দেওয়া উচিত হবে না; কারণ মেজদিদি কেষ্টর ভালো দিদি হলেও হয়তো ললিতের অত ভালো মা নন, যতটা ভালো মা হলে অন্তত নিজের ছেলে প্রতিদিন একবার দেখতে আসে। অর্থাৎ মোটাদাগের বিচার-বিশ্লেষণে তারা উভয়েই এই যাপিত সমাজের বাসিন্দা, কখনো এবং কোনোভাবেও তারা আলাদা কেউ নয়, যা তারা হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
এসব কারণে শরৎ রচনায় শ্রীমতী কাদম্বিনী যথার্থই বাংলা সাহিত্যের অগণন খলনায়িকাদের মধ্যে অন্যতম চরিত্র, এই বিষয়টা তাঁর দীর্ঘ ছোটগল্প 'মেজদিদি'(!) পাঠ করলে প্রথমেই মনে হবে। সেই সঙ্গে এ-ও মনে হবে, ওই শ্রীমতীরা যেমন ব্যক্তি ও সমাজজীবনে শতবর্ষ আগে ছিলেন, তেমনি জগতের শেষ ঘণ্টা বাজা অবধি তাঁরা টিকে থাকবেন; এমনকি শ্রীমানরাও। কারণ ব্যাপারটা প্রকৃতির নিয়মের আওতাভুক্ত। ওঁরা ছাড়া জগৎ-সংসারে এক বিরাট অচলাবস্থা নেমে আসবে। যেমন রাত্রি ছাড়া দিবসের মহিমা বোঝা অসম্ভব, কিংবা দিবস ছাড়া রাত্রির...!
যা হোক আলোচ্য বিষয় যেহেতু খল-চরিত্র বা খলনায়িকা : সেহেতু পাঠক 'মেজদিদি' পাঠমাত্র সর্বপ্রথম কেষ্ট নামের এমন এক অনাথ বালকের বর্তমান হাল-অবস্থা দেখতে পায়, যাতে শুরুতেই তার সুকোমল হৃদয়টি হতভাগ্য কিশোরটির জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কারণ অনাথ কেষ্টর প্রতি সমাজের যে দায়িত্ব ছিল, তা পালনে সমাজ পুরোপুরি ব্যর্থ হয় এবং সেটাকে সে অস্বীকার করার জন্য একজন নরসুন্দরের মাধ্যমে তাকে দূর গাঁয়ের নামমাত্র একজন বৈমাত্র ভগি্নর সংসারে গছিয়ে দিতে পাঠায়।
সম্বোধনে রমণীটি কেষ্টর ভগি্ন হলেও কার্যত তারা উভয়েই ছিল পরস্পরের সম্পূর্ণ অচেনা এবং উভয়ে শুধু বৈমাত্র সম্পর্কে আবদ্ধ। আবেগের চোরাগর্ত ভরা শরৎ বাবুর এই আখ্যানের ঘটনা-বিস্তারে কাদম্বিনী কিংবা হেমাঙ্গিনি চরিত্রের অতীত সম্বন্ধে পাঠকের দ্বারা জানা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ কাদম্বিনী কিভাবে নবীন মুখার্জির মতো প্রায় অদৃশ্য এক সচ্ছল ধান-চালের কারবারির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো এবং সংসারজীবনে অতটা পথ অতিক্রম করল!
পাশাপাশি তার মায়ের মৃত্যু কবে ঘটেছিল, তখন তার অবস্থান কোথায় ছিল, পরবর্তী সময়ে তার বাবা দ্বিতীয়বারের মতো কখন বেলতলায় গেল (দ্বিতীয় বিবাহ), অতঃপর একজন পুত্রসন্তানের জনক হয়ে কিভাবে পটল তুলতে সক্ষম হলো, পাঠক সেসব কথা কখনোই জানতে পারে না!
এই অস্পষ্টতা শুধু কাদম্বিনীর ক্ষেত্রে নয়, বরং একমাত্র কেষ্ট ছাড়া অন্য সব চরিত্রও রয়েছে কুয়াশায় আবৃত, মৌন। অন্যদিকে কাদম্বিনী যে অত্যন্ত মুখরা রমণী তা কিন্তু সহজেই পাঠক বুঝতে পারে, যখন সে তার ধান-চালের আড়তকারবারি মহাজন স্বামীর মুখোমুখি হয়। অর্থাৎ স্বামী নবীন মুখার্জি যখন বেলা ১২টা নাগাদ গৃহে প্রবেশ করে, কেষ্ট দর্শন সম্পূর্ণ করে স্ত্রীর কাছে জানতে চাইল_এটি কে? তখন কাদম্বিনীর যে সহজ কথাটি বলা সমীচীন ছিল তার পরিবর্তে সে এমন এমন দীর্ঘ বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য পেশ করে, যেটি স্পষ্ট করে দেয়, বাতচিতের ক্ষেত্রে সে স্বামীর সঙ্গেও একগুঁয়ে। অর্থাৎ ওটা কাদম্বিনীর জন্য স্বভাবজাত ব্যাপার, সে সংসারের সাধারণ কথাটিও ওভাবেই বলে। এখানে একটি কথা ভুললে চলবে না যে কাদম্বিনী ও হেমাঙ্গিনির বড় হওয়ার পরিবেশ এক ছিল না। হেমাঙ্গিনি যেমন মসৃণ ও অনুকূল পথে অনায়াসে স্বাভাবিক চারিত্রিক ঔদার্য অর্জন করে, সেই রকম মসৃণ ও অনুকূল পরিবেশ কাদম্বিনী জীবনে কোনোদিনই পায় না। বরং তাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিশ্রম ও প্রতিকূলতার পথ পাড়ি দিতে হয়। যে কারণে কাদম্বিনী হেমাঙ্গিনির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রবৈশিষ্ট্য অর্জন করে। কাজেই কাদম্বিনী যা পছন্দ করে হেমাঙ্গিনি তা খুবই অপছন্দ করে। তাদের দুজনের ব্যাপারটি যেন একই চম্বুক দণ্ডের দুটি প্রান্ত, দুই চরিত্র, দুই মেরুর বাসিন্দা।
কাদম্বিনী তার জগৎ-সংসারে আপনার বাইরে কাউকে ভালোবাসতে না পারার যন্ত্রণায় যেমন সবাইকে ঝাঁঝিয়ে-তাঁতিয়ে তুলছে, তেমনি যেন হেমাঙ্গিনিও ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণায় বড় আকুল-ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, এ কথা কেবল সচেতন পাঠকই টের পাবেন_যখন তারা দেখতে পান, অসুস্থাবস্থায় সন্ধ্যার সময় সে যখন তার শয্যায় একাকী শুয়ে আছে, এমন সময় উত্তম সাজপোশাক পরে তার পুত্র ললিত ঘরে প্রবেশ করে অন্যত্র পুতুল নাচ দেখতে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে; আর তখন সাধু চরিত্রের রমণী হেমাঙ্গিনি যেন সহসা তার গুপ্ত কথাটি জানিয়ে দেয়, নিজের অগোচরেই বলে ওঠে_'হাঁরে ললিত, তোর মা যে পাঁচ-ছ দিন পড়ে আছে একটিবারও তো কাছে আসিসনি...!'
এসব নানাবিধ কারণে বক্রভাষী কাদম্বিনীকে খলনায়িকার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অতটা উচিত হবে না, আবার তেমনি চুলচেরা বিশ্লেষণে হেমাঙ্গিনিকেও সাধু চরিত্রের সার্টিফিকেট দেওয়া উচিত হবে না; কারণ মেজদিদি কেষ্টর ভালো দিদি হলেও হয়তো ললিতের অত ভালো মা নন, যতটা ভালো মা হলে অন্তত নিজের ছেলে প্রতিদিন একবার দেখতে আসে। অর্থাৎ মোটাদাগের বিচার-বিশ্লেষণে তারা উভয়েই এই যাপিত সমাজের বাসিন্দা, কখনো এবং কোনোভাবেও তারা আলাদা কেউ নয়, যা তারা হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
No comments