উৎপলা-উৎপলাকে নিয়ে নতুন তর্ক by শাহনাজ নাসরীন

মাদের সমাজব্যবস্থায়, মানসিকতায় নারীর অবস্থান সর্বদাই নিম্নতর, বক্রতর, সাবঅলটার্ন। 'মাল্যবান' উপন্যাসের নায়িকা উৎপলা, পক্ষান্তরে খলনায়িকাও সে-ই। উৎপলা সম্পর্কে আমরা জানি মাল্যবানের বয়ানে। মাল্যবানের মহত্ত্ব, সততা, সহিষ্ণুতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে উৎপলার সৃষ্টি। মাল্যবান পেশায় নিম্নমধ্যবিত্ত, তবু সুন্দরের প্রতি তার গভীর বোধ। কাব্যিক তার ভাবনা। সে সব সময় অর্থকষ্টে থাকে। দারিদ্র্যপীড়িত এই জীবনে অর্থ চায়ও সে।


এর কারণ, সে জানে অর্থ থাকলে আরো সম্মান লাভ করতে পারত, স্ত্রীর ভলোবাসা পেত। কিন্তু স্ত্রী উৎপলার মতো শুধুই জাঁকজমকের জীবন সে অবশ্যই চায় না। বরং সবচেয়ে আগে, সবচেয়ে বেশি চেয়েছে বিদ্যা। অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়ার সাধ ছিল তার, অনেক কিছু বোঝার ইচ্ছা ছিল। জীবনটাকে নেহাত কেরানির জীবন করে তুলতে চায়নি। এহেন মাল্যবানের সঙ্গে ঘর করেও উৎপলার সামান্যতম অনুভূতি জাগে না স্বামীর প্রতি। মাল্যবান জানায়, উৎপলার দয়ামায়া নেই, মাতৃত্বের স্নেহ-মমতা নেই। সে কেবল হিংস্রতা বিকীর্ণ করে। সে হলো, 'ভালো বংশের সুন্দর শরীরের নীচু কাণ্ডজ্ঞানের নীরস মেয়েমানুষ। চেহারা যদি কালো ও খারাপ হতো, তাহলে তো চামারের মেয়েরও অযোগ্য হতো।'
উৎপলা, যাকে তার আত্মীয়-পরিজন সবাই ডাকে পলা। সে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা বিবমিষা উদ্রেককারী, বীভৎস এক নারী চরিত্র। পড়তে গেলেই প্রশ্ন জাগে, উৎপলার মতো এতটা একরৈখিক মানুষ কি হয়? উৎপলা যেন জীবনের সবটুকু বক্রতা, অসুন্দর, নীচতা নিয়ে নারীর সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ হিসেবে তার মাথা নীচু করে দেয়, তার অস্তিত্বে কালিমা লেপন করে। কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই তার স্বামীর ভাবনার প্রতি। বরং স্বামীকে সে ইঁদুর-বেড়ালের বেশি মর্যাদা দেয় না। ইঁদুরের মতো মেরে ফেলার হুমকিও দেয় খুব সহজেই। জার্মান কল পেতে সব ইঁদুর মেরে ফেলার খবর জানায় দাঁতে দাঁত চেপে অদ্ভুত এক নিরেট নিগ্রহময়তায়। উৎপলার প্রতিটি অকরুণ আচরণে, বাক্যে যে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে, তার মধ্যে তা শুধু নষ্ট দাম্পত্যকেই প্রতিফলিত করে না, বরং মাল্যবানের প্রতি দুর্দমনীয় বিতৃষ্ণা, ক্রোধ ও হতাশাকে প্রতিষ্ঠা করে।
দুজনই পরস্পরের প্রতি হিংস্র, খৰহস্ত। নইলে উৎপলার ঘরের পরিচ্ছন্নতা, পারিপাট্য, সংগীতের নানা রকম আয়োজন থেকে পাঠক তো উৎপলার সৌন্দর্যবোধ আর শিল্পপ্রীতির সংবাদও পায়। অথচ মাল্যবানের বয়ানে পায় তার বিবেকহীনতার সংবাদ। বিবেক তার একেবারেই নেই। বাড়ির সবচেয়ে ভালো, বাথরুম-লাগোয়া ঘরটি দখল করে রেখেছে সে। সাজানো-গোছানো ঘরটির বর্ণনায় উৎপলার মননের চেয়ে ঘরের অবস্থানগত উৎকৃষ্টতার কথাই বেশি। সেই ঘরটি উৎপলা এমনভাবে দখল করে নিয়েছে যে মাল্যবান ওই ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ফটোগ্রাফটি উৎপলার বাবার কি না তাও চিনতে পারে না।
সংগীতচর্চার নামেও সে মাল্যবানের প্রিয় ছাদের এক চিলতে জায়গাটি অধিকার করে রাখে। সংগীতকে কেন্দ্র করেই বারবার দাম্পত্য কলহ ঘটে। ছাদে বা ওপরের ঘরে উৎপলার প্রেমিকদের আগমন ঘটে তার সংগীতের স্তুতি করতে আর মাল্যবানকে তাচ্ছিল্য ও অপমান করতে। উৎপলা যে গান গায়, তাতেও নেই কোনো মাধুর্য, তার স্বভাবেও নেই গানের কোমলতা বা সৌন্দর্য, বরং তা চূড়ান্ত কুশ্রীতারই যেন অনুষঙ্গ। উপন্যাসে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে উৎপলার এই সংগীতচর্চার চিত্র; উৎপলার ঘরে সুন্দর করে সাজানো অর্গান, সেতার আর এস্রাজের কথা আর তার গানের বর্ণনা। কখনো গুনগুন করে সুর ভাঁজা আর বাথরুমে ধারাস্নানের সময় বেশ জোরে গান গাওয়ার কথা, যা শুনতে শুনতে পৃথিবীর সব গান-বাজনার প্রতি হতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে মাল্যবানের মন। উৎপলা যেন গান করে না, চেঁচায়। যা অতি সহিষ্ণু মাল্যবানের ধৈর্যেও চিড় ধরায় প্রতিনিয়ত। অথচ গান মাল্যবানের অপছন্দ নয়। গান নস্টালজিক করে তাকে। মনে পড়ে গ্রামের কথা, ছোটবেলার কথা, মায়ের কথা 'শীতের শেষরাতে বাউল গান দূর হিজলবনের, অন্ধকারের সে সুর'। কিন্তু উৎপলার গান এমনই যে উৎপলার ষড়জ ঋষভ গান্ধারের অত্যাচার সহিষ্ণুতার সঙ্গে সহ্য করতে করতে বাধ্য হয়ে দু-এক সময় মাল্যবান ইশারায় বলেই ফেলে, গান ভালো করে শিখতে হয়। কিন্তু তাতেও কিছুমাত্র বিবেক জাগে না এই নারীর। বরং মাল্যবানকে কঠিন শাস্তি দেয়, এমনই অর্বাচীন সে! পাঠক বোঝে না কেমন সে গাইয়ে বা কেমন গানই বা মাল্যবানের পছন্দ। বরং বেশি করে দেখে পারস্পরিক প্রতিহিংসা।
এমনই পারস্পরিক হিংসা যে উৎপলা যখনই জানে মাল্যবানের পাখিপ্রীতির কথা, তখনই পাখির ওপর আক্রোশ উৎপলার। জাল পেতে সব পাখি ধরে ঠাকুরকে দেবে বলে, বলে মাংস খেতে বেশ। সঙ্গে সঙ্গেই মাল্যবানও জানায় একটি বিড়ালছানা মেরে ফেলার কথা। উৎপলার যেমন মাল্যবানের প্রতি কুৎসিত প্রতিটি উচ্চারণ! 'রাত দুপুরে ন্যকড়া করতে এল গায়েন', 'হাত পা পেটে সেঁধিয়ে কম্বল পেঁচিয়ে এ কোন বলির কুমড়ো সেজেছে দেখো, বড় শামকল'। তেমনি মাল্যবানও উৎপলা সম্পর্কে বলে, 'জলভারানত নীল মেঘ নয়...সাদা কড়কড়ে মেঘ', 'সমীচীন কচ্ছপের চামড়ার মতো কঠিন', 'কত যে সজারুর ধাষ্টামো, কাকাতুয়ার নষ্টামি, ভোঁদড়ের কাতরতা, বেড়ালের ভেংচি, কেউটের ছোবল আর বাঘিনীর থাবা এই নারীটির।'
পছন্দের জায়গাটিতেও বিস্তর ফারাক দুজনের। যদিবা চিড়িয়াখানায় যাওয়ার ব্যাপারে দুজন একমত হলো তো পথ নিয়ে শুরুতেই লাগল গণ্ডগোল। মাল্যবান পথের মাঝখানে নেমে বাজারের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করতে গেলে উৎপলার মন্তব্য, 'ছিঃ, মুরগি-খাসির বাজারের ভেতর দিয়ে...। কলকাতা শহরে কি আর পথ ছিল না।' অস্টিন থাকলে চিড়িয়াখানার গেটে নামা যেত, এই নালা-নর্দমা, পচা কাদা আর মুতের গন্ধ নাগালে পেত না' ইত্যাদি নিয়ে চলল কিছুক্ষণ। এর পরেই বসা নিয়ে। মাল্যবান ঘাসে কেন বসল...উৎপলার শাড়ি নষ্ট হয়, গা কুটকুট করে, কাজেই সবাইকে ফেলে একা গিয়ে বেঞ্চিতে বসে রইল। মাল্যবান পাখি দেখার কথা বললেও সোজাসাপটা উত্তর_'পাখি সব দেখে ফেলেছি। ও আমার দেখার পিবিত্তি নেই' বা 'তোমার রুচি তো আমার নয়'। মাল্যবানের পছন্দ বলেই যেন উৎপলার পাখি-বিদ্বেষ চরমে। মাল্যবানকে শামকল পাখি বলে আবার নিজের শামকল হয়ে জন্মানোর সম্ভাবনা ভাবতে গিয়েই কেঁপে উঠে বলে, 'না রে বাবা, এর চেয়ে জন্ম না পাওয়াও ভালো।' পুরো চিড়িয়াখানায় এ ধরনের আক্রমণ চলতেই থাকে।
পাশের বাড়ির মেয়েটি সেলাই কল নিতে এলে মাল্যবানের প্রতি আক্রোশবশত উৎপলা রুক্ষ আচরণ করে মেয়েটির সঙ্গে, কিন্তু এর মাঝেও মেয়েটির অসুখের দিকে তার নজর পড়ে। মাল্যবানকেও দেখায় তা। মেয়েটির মাথার উকুন বেছে দেয়, ক্ষীর খাওয়ায়, সরিষার তেল আর নুন দিয়ে দাঁত মাজার পরামর্শ দেয় এবং সেলাই মেশিনটিও দেয়। উৎপলার এই স্নেহ-মমতার প্রকাশ কিন্তু তার নিজের মেয়েটির ক্ষেত্রে সেভাবে দেখা যায় না। হয়তো তা মাল্যবানের প্রতি আক্রোশবশতই। মাল্যবান রাতে মেয়েকে দেখতে ঢুকেছে বলার সঙ্গে সঙ্গে অতি সহজেই সে বলে, 'যাও, তোমার মেয়েকে নিয়ে যাও, কাল থেকে ও আমার সঙ্গে শোবে না।' মাল্যবান আর উৎপলার একমাত্র রোগা হাড় জিরজিরে মেয়ে মনু, মাল্যবানের মতে, 'ছোট্ট মেয়েটার ধঞ্চের কাঠির মতো শরীরটা পড়ে আছে...শুকনো সেলাইকাঠির মতো কয়েকখানা হাড় আছে শুধু।' মেয়েটা দিন দিন আরো শুকিয়ে যায়, কারণে-অকারণে তাকে উৎপীড়ন করে উৎপলা। চিড়িয়খানায় বাঁদর দেখতে দেখতে হঠাৎ মেয়ের ঝুঁটিতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলে, 'তোকে এর মধ্যে পুরে দিলে বেশ হয়।' আবার আরেকটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলে, 'মানুষের পেটে জন্মেছিলি কেন বল তো দেখি।'
আর কী স্বার্থান্ধ! একবার মাত্র হাসিমুখে মাল্যবানের গলা পেঁচিয়ে হ্যাঁচকা টান দেয়, সেও টাকার জন্য! ভাই আসবে বলে আরেকটি ঘর ভাড়া নেয় জোর করে। স্বামীর ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে। এর পরও তৃপ্তি নেই। ঘড়ি বেচতে বাধ্য করে তাকে এবং নির্লজ্জভাবে মেসেও নির্বাসিত করে তার তীব্র অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করে। মাল্যবান বারবার মেসে থাকার সমস্যার কথা বলে, খাবারের অসুবিধার কথা জানিয়ে, তার শরীর খারাপের অজুহাত দিয়েও সামান্যতম সহানুভূতি জাগাতে পারে না উৎপলার মনে। আবার উৎপলার বড় বৌদি চুয়ান্ন বছর বয়সে গর্ভবতী হলে সে খুশিতে ডগমগ করে, খরচপত্র করে। উৎপলার একটিমাত্র সন্তান নিয়ে বসে থাকার প্রতি মাল্যবানের ইশারাকে পাশ কাটিয়ে যায়।
মাল্যবানের প্রতি উৎপলার সীমাহীন বিমুখতা। বারবার সে তা প্রকাশ করে নিষ্ঠুরভাবে। চিড়িয়াখানায় বলে, 'তোমাকে হয়তো মনে করত আমার মেসো বা মামাশ্বশুর'...অর্থাৎ যদি উৎপলা সিঁদুর পরে না আসত! উৎপলা ভাবেও সিঁদুর, টিপ না পরার কথা। লেখাপড়া করেছে সে কলেজ অবধি। তীব্র হতাশায় মাল্যবানের অসামাজিকতাকে শ্লেষ করে। বলে, 'এত বড় পৃথিবীতে একজন মেয়েলোকও তোমাকে খাতির করার দরকার মনে করল না...একজন বেশ্যার সঙ্গেও যদি সমান ভাগে তোমার দায়িত্বভার ভাগ করে নিতে পারতাম।'
তবে মাল্যবান উৎপলার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ বোধ করে তার সব রুচিহীনতা, চারিত্রিক দীনতা ভুলে। পৌরাণিক যুগ থেকেই নারীর সৌন্দর্য সর্বাগ্রে বিচার্য, সৌন্দর্য নিয়েই শিল্প। তাই মাল্যবানও উৎপলা সুন্দরী বলেই কি নিষ্ঠুর অপমান ও প্রাত্যহিক প্রত্যাখ্যানের পরও স্বপ্ন দেখে, মনু শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে তাদের বেশ সুন্দর একটা শয্যা হবে দোতালার বিছানায়? এ কারণেই কি সে ফিরে যেতে পারে না কলকাতা থেকে প্রায় দেড় শ মাইল দূরে বাংলাদেশের একটা পাড়াগাঁয়ে, যেখানে খেজুরের জাঙ্গাল বেশি, তালের বন কম।...ঘুম ভেঙে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় শীতের কুয়াশার সে কোন অন্তিম কোচড়ের ফাঁকে ফাঁকে বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অভিজিৎ সিরিয়াস যেন লণ্ঠন হাতে করে এখান থেকে সেখানে কোন সুদূর যানে পথে চলছে। কোনো দিন কুয়াশা কম_সাদা মেঘ আছে একফালি গড়ানে মেঘের পাশে_নিজের কেমন যেন একটা বৃহৎ আলোর শরীর নিয়ে থেমে আছে চাঁদ।' মাল্যবান নিজেই এরপর বলছে, 'পঁচিশ-সাতাশ বছর বয়স পর্যন্ত পাড়াগাঁয়ে সে ফিরে ফিরে যেত, এই সব তার দেখার-শোনার জিনিস ছিল।' কিন্তু এখন আর ফিরতে পারে না। আরো অনেক কিছুই পারে না। অমরেশ চলে যাওয়ার পর মাল্যবান দেখে উৎপলার ঢিলেঢালা শাড়ি। যেন দাঁড়ালে কোমর থেকে খসে পড়বে। তবু মাল্যবানের প্রশ্নের উত্তরে উৎপলা মাল্যবানকেই তাতায়, 'কী করতে পেরেছ তুমি তার? কী করতে পারবে?' আবার সহজভাবেই বলে, 'কাল তুমি ওপরে এসে একটা বিহিত করে দিও।' তখন বরং উল্টো মাল্যবান ভাবে, উৎপলা মোটেই সে জাতের মেয়ে নয়। তাকে অবিশ্বাস করা কঠিন। অমরেশের সঙ্গে তার ভাই-বোনের সম্পর্ক ভেবে নিশ্চিন্ত হয় সে। উৎপলার উদ্ভট কুৎসিত চরিত্রের বয়ান করতে করতে এই যে যুক্তিহীন বিশ্বাস স্থাপন এবং স্বপ্নে উৎপলার সঙ্গে প্রেমময়তায় ডুব দেওয়া, তা থেকে উৎপলাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার, উৎপলাকে নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ থেকে যায়।

No comments

Powered by Blogger.