দাসত্ব নয়, ভ্রাতৃত্ব by ফরহাদ জাকারিয়া

মানব ইতিহাসকে যেসব সামাজিক কুপ্রথা কলঙ্কিত করেছে তন্মধ্যে দাসপ্রথা অন্যতম। এই প্রথার প্রচলন শুরু হওয়ার পর মানুষের সমমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়ে মালিক-ভৃত্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের নীতি হলো, মানুষ আল্লাহর দাস। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সে প্রভু হিসেবে স্ব্বীকার করবে না এবং একইভাবে সে কাউকে দাস হিসেবে বিবেচনা করবে না।


ইসলামের আবির্ভাবের আগে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আরব দেশেও দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। দাসরা সে সময় আরবের অর্থনৈতিক উৎপাদনের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভাগ্যবিড়ম্বি্বত এই দাসদের কোনো রকম সামাজিক ও মানবিক অধিকার ছিল না। তাদের মানুষরূপে গণ্য করা হতো না। হাড়ভাঙা খাটুনি এবং পাশবিক নির্যাতনই ছিল তাদের নিয়তি। ইসলাম দাসদের প্রতি মালিকদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটায়_ যার ফলে তাদের প্রতি পাশবিক আচরণ ও বীভৎস নীতির পরিবর্তন ঘটে। মানুষ হিসেবে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সভ্যতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলাম বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
কোনো মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা ইসলাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো স্ব্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার প্রাপ্ত মূল্য ভোগ করবে, শেষ বিচারের দিন আমি তার বিপক্ষে যুক্তি উপস্থ্থাপন করব (বুখারি)। হাদিস শরিফে আরও বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো মানুষকে দাসে পরিণত করে তার নামাজ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় (আবু দাউদ)।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবীয় রীতি অনুযায়ী যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণ না আদায় করা পর্যন্ত সাময়িকভাবে দাসে পরিণত করা হতো। তৎকালীন আরবের দাসদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থ্থান_ এসবের যথাযথ সংস্থ্থান করতে নির্দেশ দিয়েছে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেন, দাসরা তোমাদের ভাই। সুতরাং যার মালিকানায় কোনো দাস রয়েছে তার উচিত সে নিজে যা খায়, পরে তাকেও তা খেতে ও পরতে দেওয়া। সাধ্যাতীত কোনো কাজ তাদের করতে দিও না। যদি তেমন কোনো কঠিন কাজ তাদের দ্বারা করানো হয়, তাহলে তোমরাও তাদের সাহায্য করো (বুখারি)। ইসলামের এসব নীতির মধ্যেই দাসদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি স্পষ্টত দৃশ্যমান। এর থেকে এ কথাও প্রতীয়মান হয়, আরবের রীতি অনুযায়ী ইসলামী সমাজে দাসপ্রথা সীমিতভাবে প্রচলিত থাকলেও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইসলাম সর্বদা সচেষ্ট ছিল। মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি হলো ভ্রাতৃত্ব। বর্ণবৈষম্য ও ভৃত্য-মনিবের সম্পর্ক ইসলাম মেনে নেয়নি। এসব ক্ষেত্রে কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেনি। শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে খোদাভীরুতা ও চারিত্রিক উৎকর্ষকেই মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করেছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহর কাছে সে-ই বেশি সম্মানিত যে বেশি খোদাভীরু।
আল্লাহতায়ালা মানুষকে করেছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আমি বনি আদমকে সম্মানিত করেছি। তাই মানুষ হিসেবে অপরের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখা প্রত্যেকের কর্তব্য। এমন কোনো কাজ বা বাধ্যবাধকতা কারও প্রতি আরোপ করা উচিত নয়, যার ফলে তার মর্যাদা নষ্ট হয়। দাসপ্রথা শুধু মানুষের অধিকার হরণ ও মর্যাদাই নষ্ট করেনি_ বরং মানুষ হিসেবে তাকে আত্মবিস্মৃৃত করেছে। আধুনিককালে দাসপ্রথা আক্ষরিক অর্থে না থাকলেও তার অবয়বটা রয়েই গেছে। মালিক-ভৃত্য কিংবা পুঁজিপতি-শ্রমিক সম্পর্ক সমাজে এখনও বিদ্যমান। আগেকার দিনে দাসদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হতো, মালিকরা যেভাবে কথা বলত তা এখনও বিদ্যমান। প্রথার অবসান হলেও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। তাই বলা যায়, বাহ্যত দাসপ্রথা মোচন হলেও মনস্তাত্তি্বকভাবে তা এখনও রয়েই গেছে। ইসলাম এটা সমর্থন করে না। এটা এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক সংকট। এই সংকট শুধু ইহলৌকিক উন্নতির পথেই বাধা নয়, পরকালীন মুক্তির পথেও।
fzakariabd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.