নীতা-নৈতিকতার ফাঁদ by হামীম কামরুল হক

মাদের তথাকথিত সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা যে কয়টা জায়গায় ধরা পড়ে, এর তিনটি ক্ষেত্র হলো_জেলখানা, হাসপাতাল আর পতিতালয়। লাখো বছর পরেও যে মানুষ তার পাশবিক বৃত্তি থেকে মুক্ত নয়, সেটি খোলাসা হয়ে যায় ওসব জায়গায়। মানুষ যে মূলত সেই 'ন্যাকেড এইপ'-এর চেয়ে বেশি কিছু নয়, তাও স্পষ্ট হয়। মিশেল ফুকো মহাশয় এগুলোর প্রথম দুটির তদন্ত করেছেন। শেষটির একটা সূত্র পাওয়া যেতে পারে তার 'যৌনতার ইতিহাস' প্রকল্পের


ভেতর।জেলখানায় সত্য-মিথ্যা, হাসপাতালে জীবন-মৃত্যু, কিন্তু পতিতালয়ে একজন মানুষের কোন দিকটা নিশ্চিত হয়? নিত্য পতিতালয়ে যাওয়া-আসা করা আর বেশ্যাসক্তি প্রায় একই কথা। এবার দুটি লোকের তুলনা করা যাক_একটি লোক যিনি বেশ্যাসক্ত কিন্তু এক পয়সাও এদিক-ওদিক করেন না, একটি মানুষের গায়ে ফুলের টোকাটি দিতে তার হাত ওঠে না; আরেকটি লোক যিনি ধর্মীয় আচার পালন করেন, বেশ্যার নাম শুনলে ঘেন্নায় নাক-মুখ কুঁচকে আসে যার, কিন্তু কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারেন অবলীলায়, স্বার্থে আঘাত লাগলে খুন করতে বা করাতে যার হাত কি মন, একটুও কাঁপে না_এই দুয়ের ভেতরে কোনজন সমাজের জন্য ভালো, সেই প্রশ্ন কোথাও খুব একটা জোরেশোরে তোলা হয় না। এমনই আরো অনেক নৈতিক দিক, যা হতে পারে সাহিত্যের চিরন্তন বিষয়_সেই বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন সব সময় তাঁদের লেখা দিয়ে জীবন খুঁড়েছেন, তাঁদের ভেতর সমরেশ বসুর নাম করা যায়। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর পত্রিকা দেশেই ছাপা হয়েছিল 'বিবরে'র মতো উপন্যাস। যেখানে তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নৈতিকতার ফাঁদগুলোকে পরতে পরতে খুলে দেখিয়েছেন। নীতা জীবনের সঙ্গে যৌনতা দিয়ে লগ্ন। কিন্তু 'মোটের ওপর বাজারের বেশ্যা ও নীতা এক নয় বলে আমার বিশ্বাস, কারণ ওর জীবনেও নানা বাধ্যবাধকতা থাকলেও ইচ্ছেমতো, পুরুষ বন্ধুর সংসর্গ করার উপায় আছে। এমন নয় কি যে পুরুষের সংসর্গই হচ্ছে ওর জীবিকা। ভালো লাগার একটা ব্যাপার এখনো বোধ হয় আছে। অবিশ্যি এ রকম মেয়েদেরই স্বৈরিণী বলে কি না, আমি জানি না। স্বেচ্ছাচারিণী যাকে বলে। কারণ নীতা ওর ভালো লাগাটাকে স্বাধীনভাবে কাজে লাগিয়ে থাকে। যেমন আমি। আমিও ওর ভালো লাগা স্বাধীনতার কাজে লেগে থাকি। আমি নিজেও তাই নয় কি? কে নয়, তা জানি না। এ ক্ষেত্রে ভালো লাগার স্বাধীনতাকে, কাজে লাগাতে পারলে কেউ কি ছেড়ে দেয়? কে স্বেচ্ছাচারী নয়? আমার তো মনে হয়, গোটা পৃথিবী বন্দি-স্বেচ্ছাচারীতে ভারাক্রান্ত।'
নীতার প্রতি কথকের প্রেম ও ঘৃণার দোলাচল 'বিবর' উপন্যাসটিকে তুঙ্গে নিয়ে চলে, কিন্তু আছে আরো অনেক বিষয়_পেশাগত দুর্নীতি, ক্ষমতার বিচিত্র মাত্রা-উপমাত্রাকে চিরে দেখার নানা কাহিনী-উপকাহিনী। কথকের হাতে খুন হয় নীতা। একটা প্রবল প্রায় অব্যাখ্যনীয় জায়গা এই খুনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়, 'নীতার সংসর্গ না করার সব স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও ওর এক ডাকেই আমি চলে এসেছি। যার মানে আমার প্রতিটি রক্তকণাও পরাধীনতার মদ খেয়ে নেশা করে বসে আছে।' এখানে পরাধীনতা, যৌনতা, মদ্যপান আর নীতা জীবনের সেই গর্তের সমার্থক হয়ে ওঠে_একে নিশ্চিহ্ন ও পাথরচাপা দেওয়া দেওয়া ছাড়া মুক্তির আর কোনো উপায় নেই। কথক যখন বলে, "আমার পরাধীনতা এবং গর্তের সুখের মধ্যে, প্রায়_কী বলব_প্রায় 'মধ্যমণি'র মতোই তো নীতা ছিল, যাকে বলে, গর্তের সুখের মধ্যমণি, স্বাধীনতাই তাকে হঠাৎ মেরে ফেলল।" তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না পুরো 'বিবর' উপন্যাসের গ্যাঁড়াকলটা কোথায়।
যৌন-সংসর্গকে সত্য-সংসর্গ এবং স্বাধীনতা-সংসর্গের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে সমরেশ বসু আমাদের নির্বাচন বা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা তথা নিজস্ব ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার দিকে ঠেলে দেন। সার্ত্র-কাম্যুর অস্তিত্ববাদ দিয়ে 'বিবরে'র একটা জাত চেনা যায়, এর গায়ে অস্তিত্ববাদী উপন্যাসের তকমা সেঁটে দেওয়া যায়, কী দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমাদের চিত্তের মধ্যবিত্ততায় পরিপূর্ণ আশপাশের সব কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে ওঠে 'বিবরে'র কথক, বিবর থেকে বেরিয়ে আসা ওই কণ্ঠস্বরটি_এটি এই উপন্যাসের অনন্য দিক।
'বিবর' উপন্যাসটি কাউকে উৎসর্গ করা হয়নি। উৎসর্গ কথাটি যে পৃষ্ঠায় থাকে সেখানে লেখা হয়েছে, 'আচ্ছা, আমরা যদি সবাই সত্য বলতে পারতাম...' সেই সত্য হলো নীতার মতো কোনো একটা মোহমুগ্ধতা থেকে মুক্তি, তেমনি নিজেকে ভণ্ডামির দিক থেকে ধাপে ধাপে সত্যের দিকে ক্রমে উন্নীত হওয়ার প্রণোদনা।

No comments

Powered by Blogger.