স্মরণাঞ্জলি-রোকেয়া : অসম সাহসের আধার
সময়ের বিস্ময়কর সৃষ্টি রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন (১৮৮০_১৯৩২)। বাঙালি যখন মূর্খতা আর অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা শুরু করেছে, যখন বহুবিধ কুসংস্কারে সমাজ পরিপূর্ণ, তখন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন জন্মগ্রহণ করেন। নারী প্রগতির প্রতিকূলমুখর সমাজে জন্মগ্রহণ করেও তিনি অসম সাহসিকতার সঙ্গে নারীদের প্রগতিশীল করে গড়ে তোলার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনকে মূল্যায়ন করতে হলে
কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, তাঁর সময়চিত্র; দ্বিতীয়ত, তাঁর দর্শন; তৃতীয়ত, তাঁর সাহিত্য। এ তিনটি বিষয় নিয়ে মূল্যায়ন করলে তাঁর সামগ্রিকতাকে মূল্যায়ন করা সম্ভব। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের সময় মুসলমান পুরুষরাই বাংলা ভাষা একটু একটু গ্রহণ করলেও তখনো ইংরেজি ভাষাকে গ্রহণ করেনি। মূলত ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালিদের বাংলা শিক্ষার দ্বারোন্মোচন হয়। প্রাচীন এবং মধ্যযুগে চেতনার প্রধান স্রোতটি প্রবাহিত ছিল ধর্মকে অবলম্বন করে। সাহিত্যের অনুষঙ্গ মানুষ হওয়ার পরিবর্তে তাই ধর্মই ছিল প্রধান ভিত্তি। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, মঙ্গল কাব্য, চরিত সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, দোভাষী পুঁথি সাহিত্য_সব কিছুতেই প্রতিনিধিত্ব করেছে ধর্ম। বিচ্ছিন্নভাবে একটু একটু মানুষের জয়গান গাওয়া হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাঙালি নারী-পুরুষ সবাই ছিল পশ্চাৎপদ। এর মধ্যে নারীরা একটু বেশি পিছিয়ে ছিল। নারীদের পিছিয়ে থাকা শুধু মুসলমানদের নয়, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নারীরা পিছিয়ে ছিল। হিন্দু নারীদের পিছিয়ে থাকার দৃষ্টান্ত হিসেবে সেই সময়ে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের রক্ষণশীলতার কথা স্মরণযোগ্য। মুসলমান নারীদের অবস্থাও ছিল অবরুদ্ধ। অন্য বাড়ির পুরুষ শুধু নয়, অনাত্মীয় মহিলাদের সামনেও মুসলমান নারীদের যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, দিনের বেলা স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর দেখা করাও নিষিদ্ধ ছিল। এ রকম একটি সময় সমাজপতিরা ধর্মের নামে মুসলমানদের গৃহবাসের বাইরে আসাকে যখন নরক যাত্রার কারণ বলে প্রচার করছিলেন, তখন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন নারীদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য লেখনী ধারণ করলেন। শুধু লেখনীর দ্বারা এ কাজ দ্রুত ত্বরান্বিত হবে না ভেবে তিনি নারীদের জন্য স্কুল খুললেন। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন বিশেষত্ব অর্জন করেছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। শাস্ত্র-সমাজ যখন অন্তঃসারশূন্য মতবাদের দ্বারা নারীদের স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বিকাশের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছিল, তখন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন মুক্তির বারতা নিয়ে নতুন চেতনায় নারীদের চলার পথ ঠিক করে দিলেন। তাঁর দর্শন হচ্ছে যে নারী এবং পুরুষ সমাজের দুটো অঙ্গ। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি বেশি দূর যেতে পারবে না। পুরুষতন্ত্র নারীদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। সেখান থেকে মুক্তি পেতে হলে শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিকল্প নেই। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন। মূলত প্রবন্ধে তাঁর খ্যাতি হলেও তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধের ভাষা সাবলীল। রচনাগুণে তাঁর প্রবন্ধগুলোর গভীরে সহজেই প্রবেশ করা যায়। বাঙালি মুসলমান পুরুষরা যখন ইংরেজি পাঠকে অন্যায় জ্ঞান করত, সেই সময় রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মতিচুর প্রথম খণ্ড (১৯০৫), ঝঁষঃধহধং ফৎবধস (১৯০৮), মতিচুর দ্বিতীয় খণ্ড (১৯২১), পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধবাসিনী (১৯২৮) প্রভৃতি। তিনি মূলত নারী প্রগতিবিষয়ক সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লিখেছেন। ফলে তাঁর লেখার আদ্যোপান্ত বিষয় হয়ে উঠেছে বাঙালি মুসলমান নারী। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন আমাদের নিত্য পূজনীয়।
ড. তুহিন ওয়াদুদ
ড. তুহিন ওয়াদুদ
No comments