সংলাপে রাজি বিএনপি-সরকারকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে

সংসদ নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, জনমনে শঙ্কা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। সবার মনেই দুশ্চিন্তা, এই বুঝি শুরু হয়ে গেল হরতাল কিংবা জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি, তথা লাশের রাজনীতি। এমন অবস্থায় একে একটি সুখবরই বলা যায়।


যুক্তরাষ্ট্রসহ চারটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতারা বলেছেন, সরকার উদ্যোগ নিলে বিএনপি নেতারা সংলাপে বসতে রাজি আছেন। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত শুক্রবার রাতে গুলশানের লেকশোর হোটেলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার হাইকমিশনার এবং তুরস্কের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে দুই ঘণ্টাব্যাপী মতবিনিময় করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বৈঠকে বিএনপি নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিসহ ব্যাংকিং খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট এবং হত্যা-গুম-নির্যাতনের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন বলে জানা গেছে। সংলাপে বসার যে সদিচ্ছা বিএনপি নেতারা ব্যক্ত করেছেন, আমরা আশা করি সরকার সেই সদিচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে অতি দ্রুত সংলাপের আয়োজন করবে এবং সংঘাতের রাজনীতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করবে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নিকট-অতীতের ঘটনাপরম্পরা থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে এ দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি কেবল মুখের কথায় আটকে আছে। আমাদের রাজনীতি থেকে পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ এবং আলাপ-আলোচনা, সংলাপ-সমঝোতা জাতীয় শব্দগুলো নির্বাসিত হয়েছে। আর এর জায়গা দখল করে নিয়েছে 'দেখে নেওয়ার' রাজনীতি। এটি দেশের মানুষের কাম্য নয়। এ অবস্থায় কেবল যে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে তা-ই নয়, দেশের উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষের মতো বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর আগামী নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের অনমনীয় অবস্থান আবার একটি অশান্ত পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই তারাও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চান। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতারা রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের যে সদিচ্ছা ব্যক্ত করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা চাই, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছতার সঙ্গে ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হোক। কারণ প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া যে নির্বাচন হবে, তা যেমন বাংলাদেশের জনগণের কাছে, তেমনি বিদেশিদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সরকার যত তাড়াতাড়ি এই সত্যটি উপলব্ধি করবে এবং নিজেদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করবে, ততই মঙ্গল।
আমাদের সচেতন নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার সংলাপে বসার জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে প্রধান দুটি দলকে আলোচনার টেবিলে বসানোর জন্য। কিন্তু তাদের সেসব উদ্যোগে এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি সূচিত হয়নি। একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিংবা রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের সরব উপস্থিতি সেই দেশের জন্য সম্মানজনক নয়; কিন্তু আমরাই কি সেই পরিস্থিতি তৈরি করে দিচ্ছি না? পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, এ দেশের উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীরা শত শত কোটি ডলার খরচ করছে। এখানে অনেক দেশেরই শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ আছে। সঙ্গে সেসব দেশের নাগরিকদের স্বার্থও জড়িত আছে। কাজেই এ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান থাকা তাদের জন্যও খুবই জরুরি।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বাংলাদেশে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণচিন্তা থেকেই তা করেন। তাঁরা জানেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি দেশকে অনেক পেছনে ঠেলে দেয়, অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উৎসাহী করে। কাজেই আমরা আশা করি, গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ন রাখতে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ উন্নয়নে কি সরকার, কি বিরোধী দল- সবাই সচেষ্ট হবেন। কোনো ধরনের সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিই আমাদের কাম্য নয়।

No comments

Powered by Blogger.