‘এজিং উইথ ডিগনিটি’ by মিলু শামস

পৃথিবী এখন অকল্পনীয়ভাবে ষাটোর্ধ মানুষের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দিকে এগোচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে ষাটোর্ধদের সংখ্যা ছয় শ’ মিলিয়ন থেকে দুই বিলিয়ন পর্যন্ত পৌঁছাবে। এ নিয়ে উন্নত বিশ্বের চেয়ে উন্নয়নশীল বিশ্ব চার গুণ বেশি সমস্যায় পড়বে।


২০০১ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব বয়স্ক সম্মেলনে তখনকার জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান এ তথ্য জানিয়েছিলেন। আরও জানিয়েছিলেন, ষাটোর্ধ বয়স্কদের মধ্যে জেন্ডার বৈষম্যের কারণে পুরুষের চেয়ে নারীদের অবস্থা বেশি ভালনারএবল হবে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এবং গড় আয়ু বেশি হওয়ায় নারী বয়স্কদের সংখ্যা বেশি হবে অথচ বয়স্কদের মানবিধাকার সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে কোন সনদ বা আইন নেই।
এদিকটি সামনে এনে জাতিসংঘ সিডও কমিটি ২০০৮ সালে তাদের ৪২তম অধিবেশনে ষাটোর্ধ নারীদের মানবাধিকার রক্ষায় কমিটি গঠন করে, ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর দ্যা জেনারেল রিকমেন্ডেশন অন ওল্ডার উইমেন নামে। এর চেয়ারপার্সন বাংলাদেশে সিডও কমিটির সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম। কমিটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দিলেন তিনি আমাদের দেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষ বিশেষ করে নারীরা মানবাধিকার বঞ্চিত জীবনযাপন করেন। তারা যত বৃদ্ধ হতে থাকেন পরিবারে তত গুরুত্ব হারাতে থাকেন। এখানে আমরা প্রতিবাদ করছি। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এজিং উইথ ডিগনিটি অর্থাৎ বয়স বাড়বে মর্যাদার সঙ্গে। বয়স্করা যেন পরিবারে প্রাপ্য মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারেন। তাঁরা যেন পরিত্যক্ত না হন। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশের কথা আমরা জানি যেখানে বয়স্কদের আপদ মনে করে পুড়িয়ে মারা হয়।
প্রাচ্য মূল্যবোধের দেশগুলোতে এত বীভৎসতা আমরা কল্পনা করতে পারি না। তবে মূল্যবোধ যে অক্ষুণœ রয়েছে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। পরিবর্তন আমাদের এখানেও শুরু হয়েছে। শারীরিকভাবে পুড়িয়ে না ফেললেও অনেক ক্ষেত্রে মানসিকভাবে দগ্ধ করা হয় বৃদ্ধ স্বজনদের।
পৃথিবীজুড়ে চিকিৎসা শাস্ত্রের উৎকর্ষ, জীবনমান উন্নত হওয়া ইত্যাদি কারণে গড় আয়ু বাড়ছে। বেড়ে যাওয়া আয়ু যেন তাঁদের জন্য অভিশাপ না হয় বরং তাঁরা যেন কর্মক্ষম সময় পার করতে পারেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা, আবাসন সুবিধা পান সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে কমিটি সুপারিশমালা তৈরি করবে।
মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বিভিন্ন জটিল রোগ নিরাময়ের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। এটা নিঃসন্দেহে চিকিৎসা শাস্ত্রের অন্যতম সাফল্য। পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও এ সাফল্যের ছোঁয়া লেগেছে। আশির দশকের মাঝামাঝিতে দেশের চিকিৎসা জগতে মোটা দাগে তিনটি ভাগ ছিল মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনি। এখন শুধু সার্জারিতেই কমপক্ষে পঞ্চাশটা সুপার স্পেশালিটি তৈরি হয়েছে। তার মানে নতুন কনসেপ্ট, নতুন প্রযুক্তির চর্চা ও প্রসার ঘটছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতেও সাধারণ এনজিওগ্রাম করাতে দেশের বাইরে যেতে হতো। এখন শুধু ঢাকাতেই সরকারী-বেসরকারী মিলে অন্তত বিশটি সেন্টার আছে যেখানে এনজিও গ্রামের সুবিধা রয়েছে। ঢাকার বাইরেও আছে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান। বাইপাস ওপেন হার্ট সার্জারি অপারেশন অনায়াসে হচ্ছে। ভাল্ব রিপ্লেস, হার্টের কনজেনিটাল ডিফর্মেটি বা জন্মগত ত্রুটি, জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি, এ্যান্ডোস্কোপিক সার্জারি ইত্যাদি অপারেশন খুবই সফলতার সঙ্গে হচ্ছে। কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টের মতো জটিল প্রক্রিয়ার সাফল্য অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কিডনি প্রতিস্থাপনে সাফল্যের হার বাড়ায় রোগীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমেছে। বিদেশগামী শতকরা সত্তর ভাগ রোগী এখন দেশে চিকিৎসা করাচ্ছেন। অনেক কম খরচে তারা বিদেশের উন্নত চিকিৎসা দেশে পাচ্ছেন।
আমাদের দেশে বয়স্ক নারীরা যতদিন কর্মক্ষম থাকেন পরিবারে কোননা কোন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এসব কাজের কোন স্বীকৃতি তাঁরা পান না। বেশ কিছুকাল ধরে বয়স্ক নারীদের ওপর অন্য ধরনের দায়িত্ব বর্তেছে। দেখা যায় মা-বাবা বিদেশে যাচ্ছেন, সন্তানদের রেখে যাচ্ছেন নানী, দাদী বা খালা, ফুফুদের কাছে। একটি সন্তান দেখাশোনার দায়িত্ব বিশাল। কিন্তু এ কাজের জন্য তাঁদের কোন মূল্যায়ন হয় না। গ্রাম অঞ্চলে বয়স্ক ভাতা হিসেবে যা দেয়া হয় তা নিতান্ত অপ্রতুল। তাদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধা নেই। বয়সের ভারে যাঁরা বাড়ির বাইরে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন না তাঁদের বাড়িতে এসে চিকিৎসা সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রায়ই দেখা যায়, মেনোপজের পর আমাদের দেশের নারীরা পরিবারে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েন। যারা চাকরি করেন ৫৭ বছরে তাঁদের অবসর নিতে হয়। ৫৭ বছরের পরও অনেকে কর্মক্ষম থাকেন। তাঁরা যাতে তাদের কাজ দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারেন সে জন্য সরকার থেকে নানা ধরনের কর্মসংস্থানমূলক কাজের উদ্যোগ নেয়া জরুরী। সরকার চাইলে তাদের সম্মানসূচক বিভিন্ন কাজ দিতে পারে। যেখানে তাঁরা তাঁদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন। এ শুধু আমাদের দেশের জন্য নয় ইউনিভার্সল নীড। ওয়ার্কি গ্রুপ ফর দ্যা জেনারেল রিকমেন্ডেশন অন ওল্ডার উইমেন এজ গ্রুপ করেছি। যেমন ষাট থেকে সত্তর বছর পর্যন্ত এক ধরনের নীড আবার সত্তর থেকে আশি বছর বা তার বেশি পর্যন্ত অন্য ধরনের নীড থাকে। বিষয়গুলো সিডও অধিবেশনে জেনারেল রিকমেন্ডেশনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। সিডও কনভেনশনের আলোকে ষোলোটি বিভিন্ন আর্টিকেলের আওতায় উপস্থাপন করা হয়েছে। যাতে এটি বয়স্ক নারীদের মানবাধিকার রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক দলিল বা আইনে পরিণত হয়। তাহলে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য আইনী বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে।
সিডও যার অর্থ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ অষষ ঋড়ৎসং ড়ভ ফরংপৎরসরহধঃরড়হ ধমধরহংঃ ড়িসবহ. বাংলায়, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ। সমাজের পশ্চাৎপদতা ও বৈষম্য দূর করতে জাতিসংঘ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা করেছিল। নয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত সনদের মধ্যে সিডও অন্যতম। এর আগে ১৯৪৬ সালের ২১ জুন গঠিত হয়েছিল কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন। নারীর মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন তৈরি এবং এজন্য কি করতে হবে তা সুপারিশ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। এর ধারাবাহিকতায় আসে দাবি দশক। তারও পরে সিডও সনদ। এতে স্বাক্ষর শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে। বাংলাদেশ সনদ অনুমোদন করে স্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সালের ৬ নবেম্বর। এ পর্যন্ত এক শ’ পচাশিটি দেশ সিডও সনদে অনুমোদন দিয়েছে।
সিডও সনদের মূল কথা হচ্ছে সমাজ বিকাশের ধারায়, উন্নয়ন ও এগিয়ে যাওয়ায় নারী যে ভূমিকা রেখেছে ও রাখছে তার স্বীকৃতি দেয়া। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে নারী-পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠা করা এবং নারীর বিকাশের জন্য সাবলীল পরিবেশ তৈরি করা। এ জন্য আইন প্রণয়ন, আইনের সংস্কার ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা। নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। যেসব রাষ্ট্র সনদে স্বাক্ষর করেছে তারা এসব শর্ত পূরণ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। নারীর জন্য আন্তর্জাতিক বিল অব রাইটস হিসেবে পরিচিত এ দলিল নারী অধিকার সংরক্ষণের স্বয়ংসম্পূর্ণ মানদ- বলে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি ধারায় সংরক্ষণ রেখে সনদে সই করেছিল। সেগুলো হলো ধারা দুই, তেরো (ক), ষোল এক (গ) ও (চ)। ধারা দুই এ বলা হয়েছে বৈষম্য বিলোপ করে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার নীতিমালা গ্রহণ। প্রতিটি দেশের জাতীয় সংবিধান, আইনকানুন ও নীতিমালায় নারী ও পুরুষের সমতার নীতিমালা সংযুক্তকরণ ও তার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনকানুন, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কর্মকা- থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ। আদালত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীকে সব ধরনের বৈষম্য থেকে রক্ষা করা। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি বৈষম্য রোধ করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। তিন সেপ্টেম্বর আরেকটি সিডও দিবস পেরিয়ে গেল। এবারের অধিবেশনে নারীর এজিং এর বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাবে- এমনটাই আশা সবার।

No comments

Powered by Blogger.