রঙ্গব্যঙ্গ-একজন মসিউরের আত্মকাহিনী by মোস্তফা কামাল
প্রিয় পাঠক, স্কুলজীবনে আপনারা নিশ্চয়ই বটবৃক্ষ কিংবা নদীর আত্মকাহিনী পড়েছেন! এবার একজন উপদেষ্টার আত্মকাহিনী পড়ুন।আমার নাম মসিউর রহমান। আমি আমার নিজের সম্পর্কে বলব। কিন্তু কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি বড়ই বিপদে আছি। যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমি যেকোনো মুহূর্তে হার্টফেল করতে পারি।
ব্রেইন স্ট্রোকও হতে পারে। আমাকে আপনারা বাঁচান! বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। আমি কিন্তু গভীর খাদের একেবারে কিনারে চলে গেছি। যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারি। কেউ কি আসবেন আমাকে বাঁচাতে? হায় হায়! আমার মাথাটা এমনভাবে ঘুরছে কেন! আমি তো চোখে কেবল ধুয়াকার খুয়াকার দেখছি!
ইংরেজিতে একটি কথা আছে। নো দাইসেলফ! নিজেকে চেনো। কিন্তু আমি তো নিজেকে চিনতে পারছি না! কে আমি! আমি কি সেই ডিএইচডি ডিগ্রিধারী আমলা! আমি কি প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা! তাহলে আমার এই পরিণতি কেন হলো! কেন আমাকে নির্বাসনে পাঠানো হলো! অথচ বিশ্বব্যাংকের তদবিরেই আমাকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার করা হয়েছিল। ওহ! বুঝতে পারছি, আমি একটা বলির পাঁঠায় পরিণত হয়েছি! কী চমৎকার খেলা! বিশ্বব্যাংকের বিশ্বখেলা! আমি একটা ফাটা বাঁশের চিপায় আটকে পড়েছি। আমার কষ্ট দেখে বিশ্বব্যাংক বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছে। দেখবেন, শেষ পর্যন্ত আমরা কিন্তু কোনো টাকাকড়ি পাব না। আর বিশ্বব্যাংকের ওসব শর্তফর্ত কিচ্ছু না, বুঝলেন! সব ষড়যন্ত্র! দেশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের চক্রান্ত চলছে। সরকার উৎখাতের চক্রান্ত তো অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সরকার না বুঝে বিশ্বব্যাংকের দেশবিরোধী শর্ত পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি সারা জীবন ধোয়া তুলসীপাতা ছিলাম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এত বড় একটা বিপদের মধ্যে পড়ব, তা কোনো দিন ভাবিনি। ছাত্রজীবনে আমি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলাম। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে গ্লোরিয়াস রেজাল্ট করেছিলাম। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম। চাকরিজীবনেও সব সময় সুনামের সঙ্গে ভালো ভালো জায়গায় চাকরি করেছি।
আরো শুনবেন? আওয়ামী লীগের আগের সরকারের (১৯৯৬-২০০১) আমি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ছিলাম। তখন আমাকে ডাকসাইটে আমলা বলা হতো! তখনো আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন ছিলাম। তখন চারজন সচিব নানা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতেন। তাঁদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। তা ছাড়া আমার বিদেশি কানেকশন খুব ভালো ছিল। আমি ইআরডি সচিব হিসেবে দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ জোগাড় করেছিলাম। আমার কাজ দেখে প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই আমাকে বাহবা দিতেন। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে আরো বেশি বেশি কাজ দেখাতাম। এতে প্রধানমন্ত্রীর মনে হতো, আমার মতো আর চার-পাঁচজন সচিব যদি থাকতেন তাহলে সরকারের আর কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে হতো না!
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পরও আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে যাইনি। তাঁর দলে যোগ না দিলেও বাইরে থেকে পরামর্শ দিয়েছি। অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে আমার পরামর্শ নেত্রী লুফে নিতেন। যা হোক, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো, আমিও আবার লাইমলাইটে চলে এলাম। নেত্রীর একটা ভালো গুণ হলো, তিনি উপকারের কথা খুব মনে রাখেন। আমরা চার সচিবই নেত্রীর কাছে আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলাম। আমাকে তিনি মন্ত্রীর মর্যাদায় অর্থ উপদেষ্টা করলেন। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা, বাড়ি-গাড়ি, লোকবল- সবই পেলাম। এর মধ্যে একটা বড় দেশ আমাকে বড় ধরনের টোপ দিল। আমি সেই টোপ গিলে ফেললাম। সেটাই বুঝি আমার জীবনের জন্য কাল হয়েছে। আমি দেশের বিপক্ষে কাজ করতে গিয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছি। দেশ আমাকে তার সাজা দিচ্ছে।
ন্যাচারাল জাস্টিস (প্রকৃতির বিচার) বলে একটা কথা আছে না! আমি তারই শিকার। তা না হলে সারা জীবন বিশ্বব্যাংকের হয়ে কাজ করেছি। সেই বিশ্বব্যাংকই আমাকে শত্রু ভাবল! হঠাৎ কেন বিশ্বব্যাংক আমার বিরুদ্ধে চলে গেল বুঝতে পারলাম না। অনেক আগে থেকেই বিশ্বব্যাংক আমার বিরুদ্ধে লেগে ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমাকে পছন্দ করেন বলে সরে যেতে বলেননি। আমিও ভাবলাম, দুর্নাম নিয়ে সরে যাব! মানুষ কী ভাববে! শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এমন চাল চালল যে আমাকে নির্বাসনে যেতে হলো।
আমি দেখলাম, ধীরে ধীরে আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। আমার ব্রেইন আমার সঙ্গে বিট্রে করছে। আমি ধীশক্তি হারিয়ে ফেললাম। আমি ভাবলাম, আমাকে যখন চলে যেতেই হবে, বিষয়টা গণমাধ্যমকে জানাই। কিন্তু এর আগেই সাংবাদিকরা আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলেন। তাঁরা আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। প্রশ্ন শুনে আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। কী বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তারপর কোত্থেকে কী হয়ে গেল! কে আমার ছুটির আবেদন করল? কে সেই আবেদনপত্রে সই করল? আর কে-ই বা তা অনুমোদন করল? আমার কাছে সব কিছু আউলা-ঝাউলা লাগছে! আমার চোখে ঘুম নেই। সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে আছি। বিশ্বব্যাংকের গুপ্তচরেরা আমাকে গলাটিপে হত্যা করতে চায়। সাপের ফণার মতো ওই কালো হাতগুলো আমাকে ছোবল মারতে চায়। আমি এখন কী করব? কোথায় লুকাব? কে দেবে আমাকে আশ্রয়?
আমি দেখলাম, আমার চারপাশে আপনারা, মিডিয়ার বন্ধুরা ছাড়া আর কেউ নেই। আপনারা আমাকে সহানুভূতি দিন! আপনাদের সহানুভূতি নিয়েই আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি সব সময় আপনাদের সহানুভূতি চাই। আমি বাঁচতে চাই! যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমি বাঁচতে চাই! আপনাদের কাছে আমি করুণা ভিক্ষা চাই! আর আমি সরে যাওয়ায় বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ শর্ত পূরণ হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ফিরে এসেছে। তাই বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে আমি আগে যা বলেছিলাম তা ফিরিয়ে নিলাম। এখন দেখব, বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় করতে কত দিন সময় নেয়। আমার বক্তব্য শেষ। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আমি যেন বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারি। আমিন, ছুম্মা আমিন!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ইংরেজিতে একটি কথা আছে। নো দাইসেলফ! নিজেকে চেনো। কিন্তু আমি তো নিজেকে চিনতে পারছি না! কে আমি! আমি কি সেই ডিএইচডি ডিগ্রিধারী আমলা! আমি কি প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা! তাহলে আমার এই পরিণতি কেন হলো! কেন আমাকে নির্বাসনে পাঠানো হলো! অথচ বিশ্বব্যাংকের তদবিরেই আমাকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার করা হয়েছিল। ওহ! বুঝতে পারছি, আমি একটা বলির পাঁঠায় পরিণত হয়েছি! কী চমৎকার খেলা! বিশ্বব্যাংকের বিশ্বখেলা! আমি একটা ফাটা বাঁশের চিপায় আটকে পড়েছি। আমার কষ্ট দেখে বিশ্বব্যাংক বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছে। দেখবেন, শেষ পর্যন্ত আমরা কিন্তু কোনো টাকাকড়ি পাব না। আর বিশ্বব্যাংকের ওসব শর্তফর্ত কিচ্ছু না, বুঝলেন! সব ষড়যন্ত্র! দেশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের চক্রান্ত চলছে। সরকার উৎখাতের চক্রান্ত তো অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সরকার না বুঝে বিশ্বব্যাংকের দেশবিরোধী শর্ত পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমি সারা জীবন ধোয়া তুলসীপাতা ছিলাম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এত বড় একটা বিপদের মধ্যে পড়ব, তা কোনো দিন ভাবিনি। ছাত্রজীবনে আমি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলাম। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে গ্লোরিয়াস রেজাল্ট করেছিলাম। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম। চাকরিজীবনেও সব সময় সুনামের সঙ্গে ভালো ভালো জায়গায় চাকরি করেছি।
আরো শুনবেন? আওয়ামী লীগের আগের সরকারের (১৯৯৬-২০০১) আমি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ছিলাম। তখন আমাকে ডাকসাইটে আমলা বলা হতো! তখনো আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন ছিলাম। তখন চারজন সচিব নানা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতেন। তাঁদের মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। তা ছাড়া আমার বিদেশি কানেকশন খুব ভালো ছিল। আমি ইআরডি সচিব হিসেবে দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ জোগাড় করেছিলাম। আমার কাজ দেখে প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই আমাকে বাহবা দিতেন। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে আরো বেশি বেশি কাজ দেখাতাম। এতে প্রধানমন্ত্রীর মনে হতো, আমার মতো আর চার-পাঁচজন সচিব যদি থাকতেন তাহলে সরকারের আর কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে হতো না!
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পরও আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে যাইনি। তাঁর দলে যোগ না দিলেও বাইরে থেকে পরামর্শ দিয়েছি। অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে আমার পরামর্শ নেত্রী লুফে নিতেন। যা হোক, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো, আমিও আবার লাইমলাইটে চলে এলাম। নেত্রীর একটা ভালো গুণ হলো, তিনি উপকারের কথা খুব মনে রাখেন। আমরা চার সচিবই নেত্রীর কাছে আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলাম। আমাকে তিনি মন্ত্রীর মর্যাদায় অর্থ উপদেষ্টা করলেন। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা, বাড়ি-গাড়ি, লোকবল- সবই পেলাম। এর মধ্যে একটা বড় দেশ আমাকে বড় ধরনের টোপ দিল। আমি সেই টোপ গিলে ফেললাম। সেটাই বুঝি আমার জীবনের জন্য কাল হয়েছে। আমি দেশের বিপক্ষে কাজ করতে গিয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছি। দেশ আমাকে তার সাজা দিচ্ছে।
ন্যাচারাল জাস্টিস (প্রকৃতির বিচার) বলে একটা কথা আছে না! আমি তারই শিকার। তা না হলে সারা জীবন বিশ্বব্যাংকের হয়ে কাজ করেছি। সেই বিশ্বব্যাংকই আমাকে শত্রু ভাবল! হঠাৎ কেন বিশ্বব্যাংক আমার বিরুদ্ধে চলে গেল বুঝতে পারলাম না। অনেক আগে থেকেই বিশ্বব্যাংক আমার বিরুদ্ধে লেগে ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমাকে পছন্দ করেন বলে সরে যেতে বলেননি। আমিও ভাবলাম, দুর্নাম নিয়ে সরে যাব! মানুষ কী ভাববে! শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এমন চাল চালল যে আমাকে নির্বাসনে যেতে হলো।
আমি দেখলাম, ধীরে ধীরে আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। আমার ব্রেইন আমার সঙ্গে বিট্রে করছে। আমি ধীশক্তি হারিয়ে ফেললাম। আমি ভাবলাম, আমাকে যখন চলে যেতেই হবে, বিষয়টা গণমাধ্যমকে জানাই। কিন্তু এর আগেই সাংবাদিকরা আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলেন। তাঁরা আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। প্রশ্ন শুনে আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। কী বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তারপর কোত্থেকে কী হয়ে গেল! কে আমার ছুটির আবেদন করল? কে সেই আবেদনপত্রে সই করল? আর কে-ই বা তা অনুমোদন করল? আমার কাছে সব কিছু আউলা-ঝাউলা লাগছে! আমার চোখে ঘুম নেই। সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে আছি। বিশ্বব্যাংকের গুপ্তচরেরা আমাকে গলাটিপে হত্যা করতে চায়। সাপের ফণার মতো ওই কালো হাতগুলো আমাকে ছোবল মারতে চায়। আমি এখন কী করব? কোথায় লুকাব? কে দেবে আমাকে আশ্রয়?
আমি দেখলাম, আমার চারপাশে আপনারা, মিডিয়ার বন্ধুরা ছাড়া আর কেউ নেই। আপনারা আমাকে সহানুভূতি দিন! আপনাদের সহানুভূতি নিয়েই আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি সব সময় আপনাদের সহানুভূতি চাই। আমি বাঁচতে চাই! যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমি বাঁচতে চাই! আপনাদের কাছে আমি করুণা ভিক্ষা চাই! আর আমি সরে যাওয়ায় বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ শর্ত পূরণ হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ফিরে এসেছে। তাই বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে আমি আগে যা বলেছিলাম তা ফিরিয়ে নিলাম। এখন দেখব, বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় করতে কত দিন সময় নেয়। আমার বক্তব্য শেষ। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আমি যেন বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারি। আমিন, ছুম্মা আমিন!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments