যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা এবং নাগরিকত্ব প্রসঙ্গ by রণেশ মৈত্র
সম্প্রতি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে না পারলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম আইনে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদেরও উচ্চতর আদালতে আপীল করার সুযোগ রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
আমি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামকে বিশেষ করে ধন্যবাদ জানাই আইনে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের সাধারণ অপরাধীদের মতো আপীলের বিধান রাখার বিধানের বিরোধিতা করায়।
বস্তুত বছর দুয়েক আগে, অনেক টালবাহানার পর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্যের জন্য আদালত কক্ষ, বিচারপতিদের নিয়োগদান, তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরদের নিয়োগদান করে অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করা হয়। এত সীমিত সংখ্যক যুদ্ধাপরাধীর গ্রেফতার ও বিচার শুরু করার কোন কারণ আজতক সরকার দেশবাসীকে জানায়নি। বিচার শুরুর প্রাক্কালে এই বিষয়টি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে একজন সাংবাদিক জনৈক মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলে বসেন ঞড়শবহ ঞৎরধষ (প্রতীকী বিচার) করা হচ্ছে যাতে এ দেশে জাতির বিরুদ্ধে, তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ কোন অপরাধ করলে, তা তিনি যত বড় কেউকেটাই হোন না কেন, বিচারের সম্মুখীন অবশ্যই হতে হবে এবং অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তিও পেতে হবে।
মন্ত্রী মহোদয়ের এমন উক্তির পর এ নিয়ে বিস্তর প্রতিবাদ ওঠে, পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য লেখা বের হতে থাকে, বহু সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন প্রভৃতির আয়োজনও অব্যাহতভাবে হতে থাকলে, খুব সম্ভব জনমতের চাপেই, গোলাম আযমসহ আরও জনাকয়েককে গ্রেফতার করা হয় এবং অত্যন্ত ধীরে সুস্থে সবার বিচারকার্য শুরুও করা হয়। বিচারের সকল আয়োজন সম্পন্ন করতে যেমন দীর্ঘসূত্রতা করা হয়েছে, বিচার প্রক্রিয়াতেও দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক এবং অযৌক্তিকভাবে সময়ক্ষেপণ। এতে লাভটা হচ্ছে ঐ জাতির বিরুদ্ধে হাজারো অপরাধ করা ঘৃণ্য অপরাধীদেরই।
প্রথমে দেখা গেল বিস্ময়কর তদন্ত প্রক্রিয়া। তদন্ত দলের সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ভিডিও ক্যামেরা এবং তাই নিয়ে দেশের নানা স্থানে ঘোরা এবং প্রস্তাবিত সাক্ষীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অপরাধীর অপরাধ বর্ণনা এবং এগুলো দেখানো হতে থাকল টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীরা এবং তাদের সমর্থক ও স্বজনরা তো টেলিভিশন ২/১ সেট করে কেনেননি বা দেখেন না তা তো নয়। তাই তারাও সবাই দিব্যি কিনে রাখল ঐ সব সাক্ষীদের এবং তদন্ত দল চলে যাওয়ার পর বা ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচারের দিন ধার্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ সাক্ষীদের ওপর নির্যাতন-হুমকি-ধমকি শুরু হয়ে যায়। তাই অত্যন্ত সাহসী সাক্ষীরাই ঠিকমতো ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে সাক্ষী দিচ্ছেন, বাকিরা থাকছেন অনুপস্থিত। অনেকদিন শোনা গেল, সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য আইন ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোথায়? আজ পর্যন্ত এ জাতীয় কোন আইনও প্রণীত হয়নি বা সাক্ষীদের সকলের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থাও করা হয়নি।
অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু বাজারে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে পাবনার মাওলানা আবদুস সুবহান (ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে সদ্য গ্রেফতার হওয়া) এবং আরও অনেক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাসহ সারাদেশে অসংখ্য যুদ্ধাপরাধী সরকারী দলের এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদেরকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মামলা যাতে না হয়। ঐ অপরাধে গ্রেফতার যাতে হতে না হয় তার দিব্যি পাকাপোক্ত ব্যবস্থাটি করে ফেলেছেন। ফলে এমন আশঙ্কা অনেকে করেন যে, এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বহু যুদ্ধাপরাধীই তাঁদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য মামলা-মোকদ্দমা এড়াতে সক্ষম হবেন।
আদালতে আসামি পক্ষ যে নানা অজুহাতে বিচারকার্য বিলম্বিত করার চেষ্টা করবেন তা তো স্বাভাবিকই এবং তাঁরা তা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে করেও চলেছেন। নানা অজুহাতে তাঁরা দরখাস্ত জমা দিচ্ছেন এবং আদালতের স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রেখে ঐ দরখাস্তের পিছনে বিচারক-আইনজীবী-সবাইকে ছুটতে দেয়াই হচ্ছে অযথা সময়ক্ষেপণ। তৎক্ষণাৎ এ জাতীয় দরখাস্তগুলোর নিষ্পত্তি করা দরকার। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সংক্ষিপ্ত শুনানির মাধ্যমে ঐ প্রার্থনা মঞ্জুর বা বাতিল করে স্বাভাবিক কাজকর্ম আদৌ ব্যাহত না করা হবে সঙ্গত। এর ফলে আসামি পক্ষের দরখাস্তের পরিমাণ কমে আসবেÑসময়ের অপচয়ও একইভাবে কমে যাবে।
আসলে তো দেখা যাচ্ছে বিচারে আন্তর্জাতিক মানের নামেও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের নয় মাসের খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট কি রাজাকার আলবদর বাহিনীর তাস্কররা সাক্ষী দাঁড় করিয়ে রেখে করেছিল? বস্তুত ঘটনাবলীর চোখে দেখা সাক্ষী তো শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই না পাওয়ার কথা। অবশিষ্টদের মধ্যে অনেকে দেশত্যাগ করেছেন, অনেকে মারাও গেছেন। তাই নির্ভর করতে হবে মূলত তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনের ওপর। আর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিও দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। তবে দেখা-সাক্ষী পাওয়া গেলে এবং তাঁর স্মৃতিশক্তি ঠিকমতো থাকলে সাহসিকতার সঙ্গে তিনি যদি সাক্ষী দেন তবে তা হবে সর্বোত্তম।
বাস্তবে ট্রাইব্যুনালে কী ঘটছে জানি না। তবে আজতক একটি মামলারও নিষ্পত্তি হলো না দেখে বিস্ময়ে ভাবি ১৯৭৩ সালের আমার ওকালতিকালীন তখনকার পাবনা জেলা ও দায়রা বিচারকের একটি প্রশ্নের কথা। একদিন মধ্যাহ্ন বিরতিকালে উক্ত বিচারক তাঁর চেম্বারে আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন। ভদ্রলোক ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ। তিনি আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, রণেশ বাবু, বলুন তো আসলে সরকার কি চায়। আপনি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমান সরকারের সবকিছুর খবর রাখেন। তাই জিজ্ঞেস করি, সরকার কি আসলে রাজাকার আলবদরদের শাস্তি দিতে চায়Ñ না কি বিচার করে তাদের খালাস দেয়াই তাদের ইচ্ছে? প্রশ্ন শুনে আমি তো স্তম্ভিত। বললাম, আপনি স্বয়ং বিচারক, আইনের ওপর আপনার দক্ষতাও সর্বজনস্বীকৃত। কেন জিজ্ঞেস করছেন এমন কথা? উনি বললেন, ঊারফবহপব অপঃ (সাক্ষ্য আইন) এই বিচারকালে প্রযোজ্য হবে এ কথা আইনে বলা হয়েছে। সাক্ষ্য আইনে চাক্ষুস দেখা সাক্ষীকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। তা কি সম্ভব? ১৯৭১ সালের নয় মাসের ঘটনাবলীর কি কোন দেখা সাক্ষী পাওয়া সম্ভব? আইনে ঐ বিধানটির ফলে বহু অপরাধী (তৎকালীন দালাল আইন বা ঈড়ষষধনড়ৎধঃড়ৎ অপঃ অনুযায়ী অপরাধ সংঘটনকারী) সহজেই মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবেন এবং সারাদেশে তখন ঘটেছিলও তাই। এখন আবার এই সব সেরা সেরা যুদ্ধাপরাধীর বিচারও তেমনই ব্যর্থতার পরিচয় না বহন করে তা দেখা প্রয়োজন। আশা করব, আইনমন্ত্রী বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখবেন যাতে কোন আইনী ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা বেরিয়ে আসতে না পারে।
ইবহবভরঃ ড়ভ ফড়ঁনঃ মড়বং ঃড় ঃযব ধপপঁংবফ সাক্ষ্য আইনের এই বিধানও (অর্থাৎ বিচারে কোন সাক্ষ্য বা কোন কিছু সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হলে সন্দেহের ফলে সৃষ্ট সুবিধাটি আসামি পাবেন) এক মস্ত বিষফোঁড়া। এগুলো সাধারণ কোন অপরাধের সাধারণ কোন আইনে বিচার নয় মানবতার বিরুদ্ধে সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের বিচার। তাই এই বিধানটি সহসা আসামি পক্ষ পাবেন কিনা বা সুযোগ থাকলে পেতে দেওয়া সঙ্গত হবে কিনা তাও গভীরভাবে আইন মন্ত্রণালয়কেই ভাবতে হবে।
পরিশেষে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম উত্থাপিত আপিলের সুযোগ সংক্রান্ত বিষয়টি সাধ্যানুযায়ী আলোচনা করতে চাই। আপীলের সুযোগ থাকলে কি ঘটতে পারে? বর্তমান সাধারণ আইনে বলে, নৈতিকতাবিরোধী কোন অপরাধে দুই বছরের বেশি মেয়াদের জন্য কারও কারাদ- হলে সংশ্লিষ্ট অপরাধী সাজার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন নির্বাচনে প্রার্থী হতে বা ভোট দিতে পারবেন না। এমন বিধান থাকার ফলে চতুর আসামিরা উচ্চতর আদালতে আপীল ঠুকে দেন। উচ্চতর আদালত যদি আপীল গ্রহণ করে, তখন আসামি পক্ষের সার্বিক চেষ্টা থাকে জামিন গ্রহণের। সাত থেকে দশ বছর মেয়াদী বা ততোধিক মেয়াদের কারাদ- হয়ে থাকলে সাধারণত জামিন দেয়া হয় না। তবুও জামিন দেয়া না দেয়াটা হলো পুরোপুরি বিচারকের এখতিয়ার। আপীল দায়ের হলে অনেক ক্ষেত্রে আসামি জামিন পেয়েও যান। তবে জামিন পেলেন কি পেলেন না তার চেয়েও বড় কথাÑ আপীল গৃহীত হওয়া মাত্র ধরে নেয়া হয় কথিত আসামি সাজাপ্রাপ্ত বা অপরাধী নন। তাই তাঁর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার আইনত স্বীকৃত। অতীতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন নির্বাচনে এভাবে আপীল দায়ের করে দাঁড়াতে দেখেছি এবং সংশ্লিষ্ট প্রার্থী কারারুদ্ধ থাকলেও নির্বাচনে তাঁর সমর্থক কর্মীরা, এমনকি স্ত্রী পর্যন্ত নেমে যান বাড়ি বাড়ি ভোট প্রার্থনা করতে। তাঁর আবেদন এমন করুণ হয় (একটি ভোট দিয়ে আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন... ইত্যাদি) যে তাৎক্ষণিকভাবে হলেও এতে অনেকেরই মনটা নরম হয়ে পড়ে এবং ফলে ঐ প্রার্থী ঘৃণিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনে জিতেও যান এমন কি খুনের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি পর্যন্ত।
এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এমন সুযোগ কি যুদ্ধাপরাধীদের জন্যেও উন্মুক্ত রাখা সঙ্গত? বিষয়টি সম্পর্কে যে বিশেষ নজর এখনই দেয়া প্রয়োজন, এই ক্ষুদ্র নিবন্ধ মারফত তা আইন মন্ত্রণালয়কে এখনই বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব রাখতে চাই যে আপীলের সুযোগ রেখে আইনে যে বিধানটি রয়েছে তা এখনই বাতিল করা হোক। নইলে সমূহ সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। সরকারকে এ প্রসঙ্গে আর তিনটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আমার দৃষ্টিতে এই দুটি বিষয়ই অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
এক. অবিলম্বে দেশের সকল যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রণয়ন করে তা সংবাদপত্র মারফত দেশবাসীকে অবহিত করা হোক;
দুই. ঐ তালিকাভুক্ত সকল যুদ্ধাপরাধীর নাগরিকত্ব বাতিল করা হোক এবং
তিন. যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশব্যাপী তার সকল অফিস সিলগালা করা হোক, তাদের সকল ব্যাংক হিসাব বাজেয়াফত করা হোক। তাদের যারা অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে, এমন সকল প্রতিষ্ঠানকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক এবং সাহায্যদানকারী সকল ব্যক্তিকেও যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী হিসেবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।
জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী প্রস্তাব এনে জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ধর্মভিত্তিক দলকে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।
জানি না, সরকার এ প্রস্তাবগুলো মেনে নেবেন কি-না? তবে তা না করলে আগামী নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির যে মারাত্মক বিপদ আসন্ন তা জোর করেই বলা যায়।
E-mail: maitraranesh@gmail.com
বস্তুত বছর দুয়েক আগে, অনেক টালবাহানার পর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্যের জন্য আদালত কক্ষ, বিচারপতিদের নিয়োগদান, তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরদের নিয়োগদান করে অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করা হয়। এত সীমিত সংখ্যক যুদ্ধাপরাধীর গ্রেফতার ও বিচার শুরু করার কোন কারণ আজতক সরকার দেশবাসীকে জানায়নি। বিচার শুরুর প্রাক্কালে এই বিষয়টি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে একজন সাংবাদিক জনৈক মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে তিনি বলে বসেন ঞড়শবহ ঞৎরধষ (প্রতীকী বিচার) করা হচ্ছে যাতে এ দেশে জাতির বিরুদ্ধে, তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ কোন অপরাধ করলে, তা তিনি যত বড় কেউকেটাই হোন না কেন, বিচারের সম্মুখীন অবশ্যই হতে হবে এবং অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তিও পেতে হবে।
মন্ত্রী মহোদয়ের এমন উক্তির পর এ নিয়ে বিস্তর প্রতিবাদ ওঠে, পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য লেখা বের হতে থাকে, বহু সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন প্রভৃতির আয়োজনও অব্যাহতভাবে হতে থাকলে, খুব সম্ভব জনমতের চাপেই, গোলাম আযমসহ আরও জনাকয়েককে গ্রেফতার করা হয় এবং অত্যন্ত ধীরে সুস্থে সবার বিচারকার্য শুরুও করা হয়। বিচারের সকল আয়োজন সম্পন্ন করতে যেমন দীর্ঘসূত্রতা করা হয়েছে, বিচার প্রক্রিয়াতেও দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক এবং অযৌক্তিকভাবে সময়ক্ষেপণ। এতে লাভটা হচ্ছে ঐ জাতির বিরুদ্ধে হাজারো অপরাধ করা ঘৃণ্য অপরাধীদেরই।
প্রথমে দেখা গেল বিস্ময়কর তদন্ত প্রক্রিয়া। তদন্ত দলের সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ভিডিও ক্যামেরা এবং তাই নিয়ে দেশের নানা স্থানে ঘোরা এবং প্রস্তাবিত সাক্ষীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অপরাধীর অপরাধ বর্ণনা এবং এগুলো দেখানো হতে থাকল টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীরা এবং তাদের সমর্থক ও স্বজনরা তো টেলিভিশন ২/১ সেট করে কেনেননি বা দেখেন না তা তো নয়। তাই তারাও সবাই দিব্যি কিনে রাখল ঐ সব সাক্ষীদের এবং তদন্ত দল চলে যাওয়ার পর বা ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচারের দিন ধার্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ সাক্ষীদের ওপর নির্যাতন-হুমকি-ধমকি শুরু হয়ে যায়। তাই অত্যন্ত সাহসী সাক্ষীরাই ঠিকমতো ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে সাক্ষী দিচ্ছেন, বাকিরা থাকছেন অনুপস্থিত। অনেকদিন শোনা গেল, সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য আইন ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোথায়? আজ পর্যন্ত এ জাতীয় কোন আইনও প্রণীত হয়নি বা সাক্ষীদের সকলের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থাও করা হয়নি।
অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু বাজারে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে পাবনার মাওলানা আবদুস সুবহান (ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে সদ্য গ্রেফতার হওয়া) এবং আরও অনেক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাসহ সারাদেশে অসংখ্য যুদ্ধাপরাধী সরকারী দলের এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদেরকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মামলা যাতে না হয়। ঐ অপরাধে গ্রেফতার যাতে হতে না হয় তার দিব্যি পাকাপোক্ত ব্যবস্থাটি করে ফেলেছেন। ফলে এমন আশঙ্কা অনেকে করেন যে, এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বহু যুদ্ধাপরাধীই তাঁদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য মামলা-মোকদ্দমা এড়াতে সক্ষম হবেন।
আদালতে আসামি পক্ষ যে নানা অজুহাতে বিচারকার্য বিলম্বিত করার চেষ্টা করবেন তা তো স্বাভাবিকই এবং তাঁরা তা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে করেও চলেছেন। নানা অজুহাতে তাঁরা দরখাস্ত জমা দিচ্ছেন এবং আদালতের স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রেখে ঐ দরখাস্তের পিছনে বিচারক-আইনজীবী-সবাইকে ছুটতে দেয়াই হচ্ছে অযথা সময়ক্ষেপণ। তৎক্ষণাৎ এ জাতীয় দরখাস্তগুলোর নিষ্পত্তি করা দরকার। প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সংক্ষিপ্ত শুনানির মাধ্যমে ঐ প্রার্থনা মঞ্জুর বা বাতিল করে স্বাভাবিক কাজকর্ম আদৌ ব্যাহত না করা হবে সঙ্গত। এর ফলে আসামি পক্ষের দরখাস্তের পরিমাণ কমে আসবেÑসময়ের অপচয়ও একইভাবে কমে যাবে।
আসলে তো দেখা যাচ্ছে বিচারে আন্তর্জাতিক মানের নামেও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের নয় মাসের খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট কি রাজাকার আলবদর বাহিনীর তাস্কররা সাক্ষী দাঁড় করিয়ে রেখে করেছিল? বস্তুত ঘটনাবলীর চোখে দেখা সাক্ষী তো শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই না পাওয়ার কথা। অবশিষ্টদের মধ্যে অনেকে দেশত্যাগ করেছেন, অনেকে মারাও গেছেন। তাই নির্ভর করতে হবে মূলত তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনের ওপর। আর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিও দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। তবে দেখা-সাক্ষী পাওয়া গেলে এবং তাঁর স্মৃতিশক্তি ঠিকমতো থাকলে সাহসিকতার সঙ্গে তিনি যদি সাক্ষী দেন তবে তা হবে সর্বোত্তম।
বাস্তবে ট্রাইব্যুনালে কী ঘটছে জানি না। তবে আজতক একটি মামলারও নিষ্পত্তি হলো না দেখে বিস্ময়ে ভাবি ১৯৭৩ সালের আমার ওকালতিকালীন তখনকার পাবনা জেলা ও দায়রা বিচারকের একটি প্রশ্নের কথা। একদিন মধ্যাহ্ন বিরতিকালে উক্ত বিচারক তাঁর চেম্বারে আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন। ভদ্রলোক ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ। তিনি আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, রণেশ বাবু, বলুন তো আসলে সরকার কি চায়। আপনি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমান সরকারের সবকিছুর খবর রাখেন। তাই জিজ্ঞেস করি, সরকার কি আসলে রাজাকার আলবদরদের শাস্তি দিতে চায়Ñ না কি বিচার করে তাদের খালাস দেয়াই তাদের ইচ্ছে? প্রশ্ন শুনে আমি তো স্তম্ভিত। বললাম, আপনি স্বয়ং বিচারক, আইনের ওপর আপনার দক্ষতাও সর্বজনস্বীকৃত। কেন জিজ্ঞেস করছেন এমন কথা? উনি বললেন, ঊারফবহপব অপঃ (সাক্ষ্য আইন) এই বিচারকালে প্রযোজ্য হবে এ কথা আইনে বলা হয়েছে। সাক্ষ্য আইনে চাক্ষুস দেখা সাক্ষীকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। তা কি সম্ভব? ১৯৭১ সালের নয় মাসের ঘটনাবলীর কি কোন দেখা সাক্ষী পাওয়া সম্ভব? আইনে ঐ বিধানটির ফলে বহু অপরাধী (তৎকালীন দালাল আইন বা ঈড়ষষধনড়ৎধঃড়ৎ অপঃ অনুযায়ী অপরাধ সংঘটনকারী) সহজেই মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবেন এবং সারাদেশে তখন ঘটেছিলও তাই। এখন আবার এই সব সেরা সেরা যুদ্ধাপরাধীর বিচারও তেমনই ব্যর্থতার পরিচয় না বহন করে তা দেখা প্রয়োজন। আশা করব, আইনমন্ত্রী বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখবেন যাতে কোন আইনী ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা বেরিয়ে আসতে না পারে।
ইবহবভরঃ ড়ভ ফড়ঁনঃ মড়বং ঃড় ঃযব ধপপঁংবফ সাক্ষ্য আইনের এই বিধানও (অর্থাৎ বিচারে কোন সাক্ষ্য বা কোন কিছু সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হলে সন্দেহের ফলে সৃষ্ট সুবিধাটি আসামি পাবেন) এক মস্ত বিষফোঁড়া। এগুলো সাধারণ কোন অপরাধের সাধারণ কোন আইনে বিচার নয় মানবতার বিরুদ্ধে সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের বিচার। তাই এই বিধানটি সহসা আসামি পক্ষ পাবেন কিনা বা সুযোগ থাকলে পেতে দেওয়া সঙ্গত হবে কিনা তাও গভীরভাবে আইন মন্ত্রণালয়কেই ভাবতে হবে।
পরিশেষে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম উত্থাপিত আপিলের সুযোগ সংক্রান্ত বিষয়টি সাধ্যানুযায়ী আলোচনা করতে চাই। আপীলের সুযোগ থাকলে কি ঘটতে পারে? বর্তমান সাধারণ আইনে বলে, নৈতিকতাবিরোধী কোন অপরাধে দুই বছরের বেশি মেয়াদের জন্য কারও কারাদ- হলে সংশ্লিষ্ট অপরাধী সাজার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন নির্বাচনে প্রার্থী হতে বা ভোট দিতে পারবেন না। এমন বিধান থাকার ফলে চতুর আসামিরা উচ্চতর আদালতে আপীল ঠুকে দেন। উচ্চতর আদালত যদি আপীল গ্রহণ করে, তখন আসামি পক্ষের সার্বিক চেষ্টা থাকে জামিন গ্রহণের। সাত থেকে দশ বছর মেয়াদী বা ততোধিক মেয়াদের কারাদ- হয়ে থাকলে সাধারণত জামিন দেয়া হয় না। তবুও জামিন দেয়া না দেয়াটা হলো পুরোপুরি বিচারকের এখতিয়ার। আপীল দায়ের হলে অনেক ক্ষেত্রে আসামি জামিন পেয়েও যান। তবে জামিন পেলেন কি পেলেন না তার চেয়েও বড় কথাÑ আপীল গৃহীত হওয়া মাত্র ধরে নেয়া হয় কথিত আসামি সাজাপ্রাপ্ত বা অপরাধী নন। তাই তাঁর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার আইনত স্বীকৃত। অতীতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন নির্বাচনে এভাবে আপীল দায়ের করে দাঁড়াতে দেখেছি এবং সংশ্লিষ্ট প্রার্থী কারারুদ্ধ থাকলেও নির্বাচনে তাঁর সমর্থক কর্মীরা, এমনকি স্ত্রী পর্যন্ত নেমে যান বাড়ি বাড়ি ভোট প্রার্থনা করতে। তাঁর আবেদন এমন করুণ হয় (একটি ভোট দিয়ে আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন... ইত্যাদি) যে তাৎক্ষণিকভাবে হলেও এতে অনেকেরই মনটা নরম হয়ে পড়ে এবং ফলে ঐ প্রার্থী ঘৃণিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনে জিতেও যান এমন কি খুনের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি পর্যন্ত।
এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, এমন সুযোগ কি যুদ্ধাপরাধীদের জন্যেও উন্মুক্ত রাখা সঙ্গত? বিষয়টি সম্পর্কে যে বিশেষ নজর এখনই দেয়া প্রয়োজন, এই ক্ষুদ্র নিবন্ধ মারফত তা আইন মন্ত্রণালয়কে এখনই বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব রাখতে চাই যে আপীলের সুযোগ রেখে আইনে যে বিধানটি রয়েছে তা এখনই বাতিল করা হোক। নইলে সমূহ সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। সরকারকে এ প্রসঙ্গে আর তিনটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আমার দৃষ্টিতে এই দুটি বিষয়ই অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
এক. অবিলম্বে দেশের সকল যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রণয়ন করে তা সংবাদপত্র মারফত দেশবাসীকে অবহিত করা হোক;
দুই. ঐ তালিকাভুক্ত সকল যুদ্ধাপরাধীর নাগরিকত্ব বাতিল করা হোক এবং
তিন. যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশব্যাপী তার সকল অফিস সিলগালা করা হোক, তাদের সকল ব্যাংক হিসাব বাজেয়াফত করা হোক। তাদের যারা অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে, এমন সকল প্রতিষ্ঠানকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক এবং সাহায্যদানকারী সকল ব্যক্তিকেও যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী হিসেবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।
জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী প্রস্তাব এনে জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ধর্মভিত্তিক দলকে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক।
জানি না, সরকার এ প্রস্তাবগুলো মেনে নেবেন কি-না? তবে তা না করলে আগামী নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির যে মারাত্মক বিপদ আসন্ন তা জোর করেই বলা যায়।
E-mail: maitraranesh@gmail.com
No comments