ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ এবং বিবিধ প্রসঙ্গ by এম এ খালেক
ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমানে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। এটা এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের রেকর্ড।
গত কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা হতে ২৪ হাজার কোটি টাকায় উঠানামা করছিল। সে হিসাবে হঠাৎ করেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এভাবে বেড়ে যাওয়াটা যে কোনো বিচারেই উদ্বেগজনক। তাই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল কিছুটা হলেও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বা দেশের অন্যান্য সিডিউল ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান সাধারণ্যে প্রকাশ করে তা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। কারণ ব্যাংকিং সেক্টরে বিগত বছরগুলোতে যে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে তা এই হিসাবের মধ্যে প্রদর্শন করা হয়নি। অবলোপনকৃত এই ঋণের পরিমাণ কম করে হলেও ২২ হাজার কোটি টাকা হবে। এটা খেলাপি ঋণের সঙ্গে একত্রে প্রদর্শন করা হলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থাপনা খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম করে দেখানোর জন্য অবলোপনকৃত ঋণকে মূল লেজারের বাইরে রেখে দিচ্ছে। অবশ্য ঋণ অবলোপন নীতিমালাই তাদের এ সুযোগ করে দিয়েছে। অবলোপনের আগে উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার শর্তারোপিত রয়েছে। কিন্তু ঋণ অবলোপনের বিধান নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকেই মনে করে থাকেন ঋণ অবলোপন অর্থ হচ্ছে ঋণ মওকুফ করে দেয়া। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। ঋণ অবলোপনের সহজ অর্থ হচ্ছে, একটি ঋণ হিসাব ৫ বছর বা তারও বেশি সময় খেলাপি হয়ে থাকার পর তা কিছু শর্ত সাপেক্ষে অবলোপন করা হয়। অবলোপনকৃত ঋণ আদায় হবে না বলেই ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ধরে নেয়। অবলোপনকৃত ঋণ ব্যাংকের মূল লেজারে না রেখে অন্য একটি লেজারে সংরক্ষণ করা হয়। কোন ঋণ হিসাব অবলোপন হবার পর তা থেকে যদি কোন অর্থ আদায় হয় তাহলে সেই অর্থ সরাসরি ব্যাংকের লাভের খাতে চলে যায়। ব্যাংক যদিও অবলোপনকৃত ঋণকে মোট খেলাপি ঋণের সঙ্গে প্রদর্শন করে না কিন্তু তাই বলে এই ঋণের ওপর ব্যাংকের দাবি নষ্ট বা শেষ হয়ে যায় না। ব্যাংকের পাওনা আছে। ব্যাংক সেই পাওনা আদায়ের জন্য চেষ্টা করে। অবলোপনকৃত ঋণ অস্তিত্বহীন নয় কিন্তু তা জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হয় না।
আমাদের দেশে খেলাপি ঋণ সমস্যা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই এ সমস্যা বিরাজ করছে। এটা ঠিক যে, বিশ্বের কোন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরই খেলাপি ঋণ সমস্যামুক্ত নয়। উন্নত দেশগুলো নানা প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণকে কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে সীমিত রাখছে। কিন্তু আমাদের দেশে কোনভাবেই সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ সমস্যা ক্রমাগত সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের সমস্যাটি প্রথমে জনসমক্ষে চলে আসে বিগত শতাব্দীর ’৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী, ব্যাংকিং সেক্টর সংস্কার কার্যক্রম শুরু হলে খেলাপি ঋণের প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে চলে আসে। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ শুধু বাড়ছেই। ১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এবার বোধহয় ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয়। সব ঋণ খেলাপিই কিন্তু একই ধরনের নয়। কোন কোনো ঋণ খেলাপি আছেন যারা নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে সমর্থ হন না। এরা প্রকৃত ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবার দাবি রাখেন। আর এক শ্রেণীর ঋণ খেলাপি আছেন যারা সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন না। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। এরা খুবই ভয়াবহ এবং শক্তিধর। তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব হয় না। আমাদের দেশে ব্যাংকিং সেক্টর হতে ঋণ গ্রহণে যেমন রাজনৈতিক এবং আর্থিক ক্ষমতার দরকার হয় তেমনি ঋণ খেলাপি হতেও এ ধরনের শক্তির প্রয়োজন হয়। প্রকৃত ঋণ খেলাপি এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের একই পাল্লায় পরিমাপ করা উচিত নয়।
ব্যাংকিং খাতের প্রচলিত আইন উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপি হতে প্রলুব্ধ করে। বিষয়টি অনেকের নিকট কিছুটা আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে কিন্তু কথাটি মোটেও মিথ্যে নয়। আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অনেক আইন ঋণ খেলাপিদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করার পর নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেন তাদের কোন ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয় না। কিন্তু যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করে বছরের পর বছর ফেলে রাখেন, ব্যাংক তাদের নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদান করে থাকে। যেমন তাদের সুদ ও দ- সুদ মওকুফ সুবিধা প্রদান করা হয়। একজন উদ্যোক্তা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করার পর যদি দেখেন যে তাকে কোন ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে না। অন্যদিকে বছরের পর বছর ঋণের কিস্তি আটকে রেখে ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টিকারী ঋণ খেলাপিকে যদি দীর্ঘদিন পর কোটি কোটি টাকা সুদ এবং দ- সুদ মওকুফ করে দেয়া হয় তাহলে যিনি নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তিনি হতাশ হয়ে ঋণ খেলাপি হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। য়দি ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে তারা ঋণ খেলাপি হতে সাহসী হতেন না। আমাদের দেশে একটি প্রকল্প গৃহীত হবার পর তা বাস্তবায়নে অহেতুক অনেকটা সময় দীর্ঘায়িত হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে। একটি প্রকল্প নির্মাণ চলাকালে ব্যাংক স্বল্পমাত্রায় সুদ চার্জ করে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে ব্যাংক পূর্ণ মাত্রায় সুদ চার্জ করতে থাকে। একটি প্রকল্পের নির্মাণ কাল যদি ৬ মাস হয় তাহলে ব্যাংক সপ্তম মাস থেকেই পূর্ণ মাত্রায় সুদ চার্জ করতে থাকবে। কিন্তু দেখা যায়, প্রকল্পটি উৎপাদনে যাওয়া তো দূরের কথা নির্মাণই শেষ করতে পারে না। এ অবস্থায় বিরাট অঙ্কের সুদ প্রকল্পের উপর চেপে বসে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবার কারণে অন্য কোন কোম্পানির পণ্য হয়তো বাজার দখল করে ফেলে। এতে নতুন প্রকল্পটির পণ্য বাজারজাতকরণে অসুবিধা হয়। এভাবে অনেক সময় একটি প্রকল্প উৎপাদন শুরু করার আগেই বিরাট অঙ্কের খেলাপি ঋণের দায়ভার নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণের নিয়মে কিছুটা কঠোরতা আরোপ করেছে। আগে সামান্য পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট প্রদানের বিনিময়ে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে যতবার ইচ্ছে ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণ করা যেতো। কিন্তু বর্তমান নতুন নিয়ম অনুযায়ী, তিনবারের বেশি কোনো ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণ করা যাবে না। এটা অত্যন্ত যৌক্তিক একটি বিধান। কারণ যে ঋণ হিসাব তিনবার পুনর্তফসিলিকরণের পরও নিয়মিত হয় না সেই ঋণ যে আর আদায় হবার কোন সম্ভাবনা নেই তা ধরে নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সার্কুলার অনুযায়ী, এখন থেকে কোন ঋণ হিসাব ‘নিম্নমান’ হিসেবে চিহ্নিত হবার পর থেকে সর্বোচ্চ ৯ মাসের জন্য পুনর্তফসিলিকরণ করা যাবে। সন্দেহজনক ঋণের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা হবে ৬ মাস। আর মন্দ ঋণের ক্ষেত্রে এটা হবে ৩ মাস। দ্বিতীয়বার পুনর্তফসিলিকরণের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা হবে যথাক্রমে ৬ মাস, ৩ মাস এবং ৩ মাস। তৃতীয়বার পুনর্তফসিলিকরণের ক্ষেত্রে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ৩ মাস করে। প্রথমবার পুনর্তফসিলিকরণের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে যদি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির ২৫ শতাংশ অথবা মোট পাওনা ঋণের ১০ শতাংশ নগদে ব্যাংকে জমা দেয়। দ্বিতীয়বার পুনর্তফসিলিকরণের ক্ষেত্রে এটা হবে যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ২০ শতাংশ। তৃতীয়বার পুনর্তফসিলিকরণের ক্ষেত্রে এটা হবে ৫০ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ। ঋণ হিসাব তিনবারের বেশি পুনর্তফসিলিকরণের সুযোগ না দেয়ার বিধানটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী এতে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলার শেষ পর্যন্ত টেকানো যাবে কিনা তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। কারণ ঋণ খেলাপিরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান। তারা সব সময়ই রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি থাকতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণের প্রবণতা বেড়ে যায়। যেসব রাজনৈতিক নেতা ঋণ খেলাপি তারা নির্বাচনের আগে তাদের ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণ করে নিজেদের ধোয়া তুলসী পাতায় পরিণত করেন। তাদের তখন আর কেউই ঋণ খেলাপি অপবাদ দিতে পারে না।
বিদ্যমান অবস্থায় যে কোনো ঋণ হিসাবকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে স্পেশাল মেইনশস এ্যাকাউন্ট ব্যতীত সকল প্রকার অশ্রেণীকৃত ঋণ হিসাবকে স্ট্যান্ডার্ড ঋণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কোনো স্ট্যান্ডার্ড ঋণ হিসেব ২ মাস যাবত অনদায়ী থাকলে তাকে স্পেশাল মেইনশস এ্যাকাউন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কোনো ঋণ হিসাব তিন মাসের বেশি কিন্তু ৬ মাসের কম সময় ধরে অনাদায়ী থাকলে তাকে নিম্ন মানের ঋণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কোন ঋণ হিসাব ৬ মাসের বেশি কিন্তু ৯ মাসের কম সময় ধরে অনাদায়ী থাকলে তাকে সন্দেহজনক ঋণ হিসেবে ধরা হয়। ৯ মাসের বেশি কোন ঋণ হিসাব অনাদায়ী থাকলে তাকে মন্দ ঋণ বলে আখ্যায়তি করা হয়। মন্দ ঋণকে লোকসান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই ঋণ আর আদায় হবে না বলেই ধরে নেয়। আমরা ইতোপূর্বে যে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপনের কথা বলেছি তার পুরোটাই মন্দ ঋণ। এ ছাড়া ২৯ হাজার কোটি টাকা যে খেলাপি ঋণের হিসাব প্রদর্শন করা হচ্ছে তার একটি বড় অংশই মন্দ ঋণ। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে যে তীব্র তারল্য সঙ্কট বিরাজ তার মূলে অনেকটাই দায়ি হচ্ছে এই পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারা। খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হলে ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সঙ্কট এতটা তীব্র আকার ধারণ করত না। ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনে এর জন্য ব্যাংকিং আইনের সংস্কার ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমাদের দেশে খেলাপি ঋণ সমস্যা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই এ সমস্যা বিরাজ করছে। এটা ঠিক যে, বিশ্বের কোন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরই খেলাপি ঋণ সমস্যামুক্ত নয়। উন্নত দেশগুলো নানা প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণকে কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে সীমিত রাখছে। কিন্তু আমাদের দেশে কোনভাবেই সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ সমস্যা ক্রমাগত সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের সমস্যাটি প্রথমে জনসমক্ষে চলে আসে বিগত শতাব্দীর ’৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী, ব্যাংকিং সেক্টর সংস্কার কার্যক্রম শুরু হলে খেলাপি ঋণের প্রসঙ্গটি প্রকাশ্যে চলে আসে। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ শুধু বাড়ছেই। ১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এবার বোধহয় ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু আমাদের হতাশ হতে হয়। সব ঋণ খেলাপিই কিন্তু একই ধরনের নয়। কোন কোনো ঋণ খেলাপি আছেন যারা নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে সমর্থ হন না। এরা প্রকৃত ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবার দাবি রাখেন। আর এক শ্রেণীর ঋণ খেলাপি আছেন যারা সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন না। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। এরা খুবই ভয়াবহ এবং শক্তিধর। তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব হয় না। আমাদের দেশে ব্যাংকিং সেক্টর হতে ঋণ গ্রহণে যেমন রাজনৈতিক এবং আর্থিক ক্ষমতার দরকার হয় তেমনি ঋণ খেলাপি হতেও এ ধরনের শক্তির প্রয়োজন হয়। প্রকৃত ঋণ খেলাপি এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের একই পাল্লায় পরিমাপ করা উচিত নয়।
ব্যাংকিং খাতের প্রচলিত আইন উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপি হতে প্রলুব্ধ করে। বিষয়টি অনেকের নিকট কিছুটা আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে কিন্তু কথাটি মোটেও মিথ্যে নয়। আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অনেক আইন ঋণ খেলাপিদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করার পর নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেন তাদের কোন ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয় না। কিন্তু যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করে বছরের পর বছর ফেলে রাখেন, ব্যাংক তাদের নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদান করে থাকে। যেমন তাদের সুদ ও দ- সুদ মওকুফ সুবিধা প্রদান করা হয়। একজন উদ্যোক্তা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করার পর যদি দেখেন যে তাকে কোন ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে না। অন্যদিকে বছরের পর বছর ঋণের কিস্তি আটকে রেখে ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টিকারী ঋণ খেলাপিকে যদি দীর্ঘদিন পর কোটি কোটি টাকা সুদ এবং দ- সুদ মওকুফ করে দেয়া হয় তাহলে যিনি নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তিনি হতাশ হয়ে ঋণ খেলাপি হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। য়দি ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে তারা ঋণ খেলাপি হতে সাহসী হতেন না। আমাদের দেশে একটি প্রকল্প গৃহীত হবার পর তা বাস্তবায়নে অহেতুক অনেকটা সময় দীর্ঘায়িত হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে। একটি প্রকল্প নির্মাণ চলাকালে ব্যাংক স্বল্পমাত্রায় সুদ চার্জ করে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে ব্যাংক পূর্ণ মাত্রায় সুদ চার্জ করতে থাকে। একটি প্রকল্পের নির্মাণ কাল যদি ৬ মাস হয় তাহলে ব্যাংক সপ্তম মাস থেকেই পূর্ণ মাত্রায় সুদ চার্জ করতে থাকবে। কিন্তু দেখা যায়, প্রকল্পটি উৎপাদনে যাওয়া তো দূরের কথা নির্মাণই শেষ করতে পারে না। এ অবস্থায় বিরাট অঙ্কের সুদ প্রকল্পের উপর চেপে বসে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবার কারণে অন্য কোন কোম্পানির পণ্য হয়তো বাজার দখল করে ফেলে। এতে নতুন প্রকল্পটির পণ্য বাজারজাতকরণে অসুবিধা হয়। এভাবে অনেক সময় একটি প্রকল্প উৎপাদন শুরু করার আগেই বিরাট অঙ্কের খেলাপি ঋণের দায়ভার নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণের নিয়মে কিছুটা কঠোরতা আরোপ করেছে। আগে সামান্য পরিমাণ ডাউন পেমেন্ট প্রদানের বিনিময়ে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে যতবার ইচ্ছে ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণ করা যেতো। কিন্তু বর্তমান নতুন নিয়ম অনুযায়ী, তিনবারের বেশি কোনো ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণ করা যাবে না। এটা অত্যন্ত যৌক্তিক একটি বিধান। কারণ যে ঋণ হিসাব তিনবার পুনর্তফসিলিকরণের পরও নিয়মিত হয় না সেই ঋণ যে আর আদায় হবার কোন সম্ভাবনা নেই তা ধরে নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সার্কুলার অনুযায়ী, এখন থেকে কোন ঋণ হিসাব ‘নিম্নমান’ হিসেবে চিহ্নিত হবার পর থেকে সর্বোচ্চ ৯ মাসের জন্য পুনর্তফসিলিকরণ করা যাবে। সন্দেহজনক ঋণের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা হবে ৬ মাস। আর মন্দ ঋণের ক্ষেত্রে এটা হবে ৩ মাস। দ্বিতীয়বার পুনর্তফসিলিকরণের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা হবে যথাক্রমে ৬ মাস, ৩ মাস এবং ৩ মাস। তৃতীয়বার পুনর্তফসিলিকরণের ক্ষেত্রে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ৩ মাস করে। প্রথমবার পুনর্তফসিলিকরণের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে যদি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির ২৫ শতাংশ অথবা মোট পাওনা ঋণের ১০ শতাংশ নগদে ব্যাংকে জমা দেয়। দ্বিতীয়বার পুনর্তফসিলিকরণের ক্ষেত্রে এটা হবে যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ২০ শতাংশ। তৃতীয়বার পুনর্তফসিলিকরণের ক্ষেত্রে এটা হবে ৫০ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ। ঋণ হিসাব তিনবারের বেশি পুনর্তফসিলিকরণের সুযোগ না দেয়ার বিধানটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী এতে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলার শেষ পর্যন্ত টেকানো যাবে কিনা তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। কারণ ঋণ খেলাপিরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান। তারা সব সময়ই রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি থাকতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণের প্রবণতা বেড়ে যায়। যেসব রাজনৈতিক নেতা ঋণ খেলাপি তারা নির্বাচনের আগে তাদের ঋণ হিসাব পুনর্তফসিলিকরণ করে নিজেদের ধোয়া তুলসী পাতায় পরিণত করেন। তাদের তখন আর কেউই ঋণ খেলাপি অপবাদ দিতে পারে না।
বিদ্যমান অবস্থায় যে কোনো ঋণ হিসাবকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে স্পেশাল মেইনশস এ্যাকাউন্ট ব্যতীত সকল প্রকার অশ্রেণীকৃত ঋণ হিসাবকে স্ট্যান্ডার্ড ঋণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কোনো স্ট্যান্ডার্ড ঋণ হিসেব ২ মাস যাবত অনদায়ী থাকলে তাকে স্পেশাল মেইনশস এ্যাকাউন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কোনো ঋণ হিসাব তিন মাসের বেশি কিন্তু ৬ মাসের কম সময় ধরে অনাদায়ী থাকলে তাকে নিম্ন মানের ঋণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কোন ঋণ হিসাব ৬ মাসের বেশি কিন্তু ৯ মাসের কম সময় ধরে অনাদায়ী থাকলে তাকে সন্দেহজনক ঋণ হিসেবে ধরা হয়। ৯ মাসের বেশি কোন ঋণ হিসাব অনাদায়ী থাকলে তাকে মন্দ ঋণ বলে আখ্যায়তি করা হয়। মন্দ ঋণকে লোকসান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই ঋণ আর আদায় হবে না বলেই ধরে নেয়। আমরা ইতোপূর্বে যে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপনের কথা বলেছি তার পুরোটাই মন্দ ঋণ। এ ছাড়া ২৯ হাজার কোটি টাকা যে খেলাপি ঋণের হিসাব প্রদর্শন করা হচ্ছে তার একটি বড় অংশই মন্দ ঋণ। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে যে তীব্র তারল্য সঙ্কট বিরাজ তার মূলে অনেকটাই দায়ি হচ্ছে এই পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারা। খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হলে ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সঙ্কট এতটা তীব্র আকার ধারণ করত না। ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনে এর জন্য ব্যাংকিং আইনের সংস্কার ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
No comments