শবযাত্রী by দুর্লভ বিশ্বাস

হতে চেয়েছিলাম বরযাত্রী, হতে হলো শবযাত্রী। সম্ভাবনাময় এবং উদীয়মান নাট্যাভিনেতা দিলীপ চক্রবর্তীর অকালপ্রয়াণে আমাকে এমন পরিস্থিতির সম্মুুখীন হতে হলো।প্রয়াত নাট্যাভিনেতা দিলীপ চক্রবর্তীর বাড়ি মির্জাপুর উপজেলার নগরভাতগ্রাম গ্রামে। ১৯৮৬ সালে সে মির্জাপুর কলেজ থেকে বিকম পাস করে।


ওই কলেজের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সমাজ প্রগতির সংগ্রামে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে ১৯৮৪ সালের পর থেকে দিলীপসহ আরও কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা গভীর হয়, যাকে বলা চলে অনেকটা আত্মিক সম্পর্ক। দেশে চলছে তখন স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন। মির্জাপুরেও তার ঢেউ লাগছে। সুদর্শন দিলীপ চক্রবর্তী ভালো পোস্টার লিখতে পারত। ভালো সেল্গাগানও দিত। ওর দরাজ কণ্ঠের সেল্গাগানে সবাই আন্দোলিত হতো। রাতে ক্ষেত-মজুরদের উঠান বৈঠকে ওকে যেতে বললেও সদা হাস্যোজ্জ্বল দিলীপের তাতে কোনো বিরক্তি ছিল না। এসবের পাশাপাশি লেখাপড়াও ঠিকমতো করত। নাটক-থিয়েটারের প্রতি ওর যে টান আছে তা কিন্তু ওই সময় পর্যন্ত জানা ছিল না। তবে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত এবং শামসুর রাহমানের কবিতা সুন্দরভাবে আবৃত্তি করতে দেখেছি।
১৯৯০ সালের দিকে ও ঢাকায় চলে যায়। প্রায় দুই বছর পর হঠাৎ একদিন মির্জাপুরে দেখা হলে কী করছ জিজ্ঞেস করতেই ও বলল স্যার, রুটি-রুজির জন্য ছোট্ট একটি চাকরি এবং নাটক-টাটক করে দিন কাটাচ্ছি। আরও প্রায় তিন বছর পর মির্জাপুরে ওর সঙ্গে দেখা। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল দেখে ওকে জিজ্ঞেস করলাম_ এ কোন বেশ? পাশে দাঁড়ানো ওর এক সহপাঠী বলল, স্যার জানেন না ওর নাটক চলছে। এটা ওর নাটকের বেশ। বললাম, এখন বিয়ে কর। আমি বরযাত্রী হয়ে যাব। আমার এ কথা শুনে ও শুধু হাসল। এর পর ওর সঙ্গে যতবারই দেখা বা টেলিফোনে কথা হয়েছে কুশলাদি বিনিময়ের পর ওকে আমি সেই একই কথা বলেছি। সর্বশেষ মৃত্যুর চার দিন আগেও আমাকে টেলিফোন করেছিল। বলেছি, বিয়ে করছ কবে? ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে শ্যালকের টেলিফোনের মাধ্যমে জানলাম দিলীপের না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার খবর। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও এ মর্মান্তিক সংবাদ প্রচার হচ্ছিল। আমার প্রিয় সেই দিলীপ যে নাট্যজগতে এত বড়মাপের হয়েছিল তা পরের দিন তার কফিনে বর্তমানে দেশের নাট্যজগতের গুরুজনসহ সর্বস্তরের নাট্যব্যক্তিদের ভালোবাসার অর্ঘ্য দেওয়ার দৃশ্য দেখে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে মির্জাপুর থেকে তা অনুভব করলাম। মাত্র ৫-৬ বছর আমার সানি্নধ্যে থাকা দিলীপের মরণোত্তর সম্মানপ্রাপ্তিতে আমারও যে গর্ব!
১৮ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টার দিকে যখন দিলীপের কফিনবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি মির্জাপুর এসে পেঁৗছল তখন তারই একসময়ের রাজপথের মিছিলের সাথী বলেছিল, স্যার দিলীপের সব গুণই ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় গুণটি হলো অতি অল্প সময়ের মধ্যে মানুষকে আপন করে নেওয়া। এর প্রমাণ পেলাম সেদিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও শবযাত্রী হয়ে তার জন্মস্থান নগরভাতগ্রাম গ্রামে গিয়ে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অশ্রুসজল নয়নে হাজারো মানুষ তাকে শেষ বিদায় জানায়। ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে ১৪-১৫ বছরের কিশোর সবারই চোখের পাতা ভেজা ছিল। সবারই এককথা_ দিলীপ এলাকার একজন রত্ন ছিল। অত্যন্ত কষ্টের ও পীড়াদায়ক হলেও আমি তার শবযাত্রী হয়েছিলাম। তার আত্মার শান্তি হোক এ কামনা করি।

দুর্লভ বিশ্বাস : সহকারী অধ্যাপক, মির্জাপুর কলেজ
 

No comments

Powered by Blogger.