উপচেপড়া ভিড় এবার আদায় ৮৩১ কোটি, গতবারের দ্বিগুণ- আয়কর মেলা শেষ by এম শাহজাহান

কেনাকাটা নয়, নেই শপিং ব্যাগও। মুড়ি-মুড়কি কিংবা হাওয়াই মিঠাইয়েরও দেখামেলা ভার। তবুও মেলা, আয়কর মেলা। কর দিতে সবাই ছুটে এসেছেন মেলায়। শনিবার সকাল ১০টার মধ্যে করদাতাদের উপচেপড়া ভিড়ে বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাব চত্বর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।


দুপুরের পর তিল ধারণের জায়গাটুকু যেন আর খালি নেই। কাগজের ফাইল হাতে সবাই ছুটে এসেছেন আয়কর মেলায়। কর দিতে মানুষ এভাবে ছুটে আসে নিজের চোখে না দেখলে তা অবিশ্বাস্য মনে হবে। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে এসেছেন মেলায়। ফলে পুরুষের পাশাপাশি মহিলা করাদাতার ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেয়ার ফলে কর প্রদানসহ একই ছাদের নিচে আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণসহ টিআইএন নম্বর গ্রহণের সুযোগ মিলেছে। এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এ বছর মেলায় প্রায় তিনগুণ বেশি মানুষ সেবা নিয়েছে। এ বছর মেলায় কর আদায় হয়েছে ৮৩১ কোটি টাকা, যা গত বছরের মেলার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। চূড়ান্ত হিসেবে হাজার কোটি টাকার কর আদায় হবে বলে এনবিআর আশা করছে।শনিবার শেষ বিকেলে মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনিও আয়কর মেলা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আজ সত্যিই গর্ববোধ করছি। সরকারকে টাকা দিতে মানুষ এভাবে ছুটে আসছে! আয়কর প্রদান দেশপ্রেমের কাজ। সত্যিকার অর্থেই এটা মেলায় পরিণত হয়েছে। শুধু হাওয়াই মিঠাই থাকলে এটা পুরোপুরি মেলা হয়ে যেত। আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা ভালভাবেই কাজ করছে বলে মনে হয়। আয়কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি ভাল হচ্ছে কিন্তু এটা আরও বাড়াতে হবে। দেশের ৫ শতাংশ মানুষ কর দিলে তাতে ৭৫ লাখ মানুষ কর নেটের আওতায় আসে। আগামীতে ৭৫ লাখ করদাতা সৃষ্টি করতে পারব।’ সমাপনী অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ দাবি করেন, এ বছর মেলায় ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। আগামীতে শুধু ১১টি জেলা নয়, দেশের সব জেলায় যাতে আয়কর মেলা করা যায় সে উদ্যোগ নেয়া হবে। সমাপনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা বক্তব্য রাখেন।
এনবিআরের হিসেবে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর মেলায় ব্যাপক সাফল্য এসেছে। বিশেষ করে আয়কর আদায়ে সাফল্য সবচেয়ে বেশি। গত বছর আয়কর আদায় হয়েছিল ৪১৪ কোটি টাকা, বিপরীতে এ বছর আদায় হয়েছে ৮৩১ কোটি। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় আদায় হয়েছে ৬৬৫ কোটি টাকা। গত বছর টিআইএন নম্বর নিয়েছিল ১০ হাজার ৪১ জন, বিপরীতে এ বছর নিয়েছে ১৬ হাজার ২৮৭ জন। এ বছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে ৯৭ হাজার ৮৬৭ জন কিন্তু গত বছর দিয়েছে ৬২ হাজার ২৭২ জন। এভাবে গত বছর আয়কর মেলায় সেবা নিয়েছিল ৭৫ হাজার, বিপরীতে এ বছর নিয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার মানুষ।
আয়কর মেলার এ সাফল্যে গর্বিত মেলা আয়োজক কমিটির প্রধান ও এনবিআরের করনীতি এবং প্রশাসন বিভাগের সদস্য এমএ কাদের সরকার। তাঁর মুখে ছিল বিজয়ের হাসি। মেলা প্রস্তুতি থেকে শুরু করে গত ৭ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের সব ক্লান্তির ছাপ যেন দূর হয়ে যায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। মেলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি হাসতে হাসতে জনকণ্ঠকে বলেন, আয়কর মেলা সফল হয়েছে। দেখুন কিভাবে লোকজন ছুটে আসছে মেলায়! বৈশাখী কিংবা বাণিজ্যমেলার মতো কেনাকাটার সুযোগ না থাকলেও আয়কর মেলায় মানুষ কর দিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছুটে এসেছেন। তিনি বলেন, আমরা এটাই চেয়েছিলাম। সকল প্রকার ভয়ভীতির উর্ধে থেকে মানুষ করবান্ধব পরিবেশের মধ্যে কর প্রদান করবে। যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা পূরণ করেও বেশি কর আদায় হয়েছে। বেশিসংখ্যক মানুষ সেবা নিয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের রাজস্ব বাড়াতে আগামী বছর রাজধানীর একাধিক স্থানে আয়কর মেলা করার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সঙ্গে সাত বিভাগীয় শহরসহ দেশের ৬৪টি জেলায় যাতে আয়কর মেলা করা যায় সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
এদিকে আয়কর মেলায় এসে করদাতারা দারুন খুশি। কারণ একই ছাদের নিচে সব ধরনের সেবা পাওয়া গেছে। আয়কর মেলায় এ বছর নতুন করদাতাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বর থেকে আয়কর মেলায় রিটার্ন দাখিল ও টিআইএন নম্বর নিতে এসেছেন ইলেক্ট্রিক ব্যবসায়ী জুবুর হোসেন আকাশ ও শাহীন সেক। মেলায় এসে হেল্প ডেস্কের সহায়তায় তাঁরা ফরম পূরণ করতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন, আয়কর বিষয়ে কোন তথ্য জানতে হলে উকিল কিংবা আয়কর আইনজীবীর সহায়তা লাগে। সেক্ষেত্রে তাঁদের ফি দিতে হয়। কিন্তু মেলায় এসে ফি ছাড়াই সেবা পাওয়া যাচ্ছে। তবে আগামীতে মেলায় হেল্প ডেস্ক আরও বাড়ানো উচিত। তাঁরা বলেন, দেশের জন্য কর দিতে এসেছি। কর নিয়ে সরকার দেশের উন্নয়নে কাজ করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
প্রথম থেকেই মেলা উদ্্যাপনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এনবিআরের সহকারী কর কমিশনার নাফিসা নূর তালুকদার। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তৃতীয় বারের মতো আয়কর মেলা অুনষ্ঠিত হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া এনবিআর করবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। মেলায় ইউজার ফ্রেন্ডলি পরিবেশে সবাই কর দিতে পারছেন। তিনি বলেন, এনবিআর কর্মকর্তাদের সম্পর্কে মানুষের মনে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল আয়কর মেলার মাধ্যমে তা দূর হয়েছে। আর এ জন্যই মেলায় করদাতারা ছুটে আসছেন।
এদিকে মেলায় করদাতাদের নতুন কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও প্রত্যায়নপত্র প্রদান, আয়কর রিটার্ন, টিআইএন আবেদন ও চালান ফরম এবং সেগুলো পূরণে সহযোগিতা প্রদান, আয়কর পরিশোধের জন্য সোনালী ও জনতা ব্যাংকের বুথ, করদাতাদের সহায়তা কেন্দ্র, তথ্যকেন্দ্র ও আয়কর অধিক্ষেত্র বুথ, ই-পেমেন্টে সুবিধাসংবলিত পৃথক বুথ, আয়কর আইনবিষয়ক প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণের সুবিধা ছিল। এছাড়া ভলান্টারি সেবা দিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১২০ রোভার স্কাউট মেলায় সর্বক্ষণিক কাজ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.