ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকেও ঐকমত্য ॥ অন্তর্বর্তী সরকার- ০ মন্ত্রিসভা হতে পারে ১১ সদস্যের- ০ বিরোধী দলকে ৫ মন্ত্রী দিতে চায় সরকার- ০ সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার জন্য কূটনীতিকদের জানিয়েছে বিএনপি
অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন কি হবে? নির্বাচনকালীন এই অন্তর্বর্তী সরকারের আকার কেমন হবে, ছোট আকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে কি না, সংসদই ভেঙ্গে দেয়া হবে মেয়াদ পূর্তির আগে নাকি পরে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন নিয়ে রাজনীতিতে চলছে জোর যুক্তিতর্ক।
সংবিধানের পাতা থেকে ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে বহুল আলোচিত ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা।’ ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় জোট ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে অটল থেকেই ‘তত্ত্বাবধায়ক’-এর পরিবর্তে এখন ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার ব্যবস্থা প্রশ্নে মোটামুটি ঐকমত্যে এসেছে। কিন্তু ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার ব্যবস্থার গঠন কাঠামো প্রশ্নে প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের অবস্থান এখনও রয়েছে বিপরীত মেরুতে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর পাল্টে গেছে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। আগে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের কথা বললেও শাসক দল আওয়ামী লীগ এখন বলছে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী নির্বাচন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখন কৌশল পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো। এখন ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ প্রশ্নে কিছুটা নমনীয় হলেও বিএনপি চাইছে সংবিধান লঙ্ঘন না করে কোন নির্দলীয় ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে এনে তাঁকে দিয়ে নিরপেক্ষ ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার গঠন হোক। এ ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নিলে বিএনপি সংলাপ করতে রাজি বলেও কূটনীতিকদের কাছে জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারক নেতারা।
এদিকে বিএনপি চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতিনিধিত্ব দিতে রাজি আওয়ামী লীগ। তবে সরকারপ্রধান প্রশ্নে কোনরকম ছাড় দিতে নারাজ তারা। অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ নিতে বিএনপি রাজি হলে সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ চাইবে, অন্তর্বর্তী সরকার হতে হবে বেজোড় সংখ্যার। যদি অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভার আকার ১১ হয়, তবে সরকার প্রধান ছাড়া মন্ত্রিসভায় বিএনপিকে ৫টি মন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতেও তারা রাজি। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ ৫ ও বিএনপি ৫ এমন মন্ত্রিসভা গঠনেও সম্মতি জানাবে আওয়ামী লীগ। এই হিসাব-নিকাশ থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারা আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত বিএনপি আলোচনার মাধ্যমে সরকারের এমন প্রস্তাব মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে।
সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে আগামী নির্বাচন এবং অন্তর্বর্তী সরকারে চাইলে বিএনপিকে অংশীদারিত্ব দেয়া হবে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ দুটো ঘোষণা সকল পক্ষের মধ্যে ইতিবাচক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। তবে কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দিতে পারেন কি না এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মতে, রাষ্ট্রপতি ঠিক করবেন সংসদ কবে ভেঙ্গে দেবেন, কতজনের মন্ত্রিসভা থাকবে। তিনি যে নির্দেশ দেবেন সে অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে বলছেন, সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারে কোন প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। খালেদা জিয়ার আমলে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদে সঠিক ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। নির্বাচনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের রানীকে অনুরোধ করেন সংসদ ভেঙ্গে দিতে। সে অনুযায়ী রানী সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। আমরা ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপ ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি বিধায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে সে পদ্ধতিতে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক।
তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধান কে হবেন তা রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করবেন। নির্বাচনের ছয় সপ্তাহ আগে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে অল্প কিছুসংখ্যক মন্ত্রী দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যাবে। আর এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনই শক্তিশালী থাকবে।
আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন। এর ফলে কোন অনির্বাচিত ব্যক্তি সরকার প্রধান হতে পারবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পূর্ণাঙ্গ রায়টি ঘোষণার পর বিরোধী দল এতদিন ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’ যে দাবি জানিয়ে আসছিল, এখন তার আর কোন আইনগত ভিত্তি থাকল না। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিরোধী দলের নেতারা মুখে নানা বক্তব্য রাখলেও এখন তাঁরা ‘অন্তর্বর্তী’ সরকারকে কিভাবে নিরপেক্ষতার আদলে গঠন করা যায়- রাজনীতির সেই অঙ্ক মেলাতেই এখন ব্যস্ত। দলের হাইকমান্ডের মধ্যে নির্বাচনকালীন ‘অন্তর্বর্তী সরকারে’ প্রধানমন্ত্রীর অংশীদারিত্বের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে কি না এ নিয়েও আলোচনা চলছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এমন প্রস্তাবের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে সে ক্ষেত্রে সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটবে না। যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী অনির্বাচিত কেউ অন্তর্বর্তী সরকারে থাকতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই কিছুটা ছাড় দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই ছোট আকারে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক জনকণ্ঠকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর নির্বাচনের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী যে নামেই সরকার গঠন করা হোক না কেন তা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই গঠন করতে হবে। অনির্বাচিত সরকার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে অসাংবিধানিক হয়ে গেছে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ ৩ উপ-দফা অনুযায়ী, বর্তমান সংসদ বহাল রেখে ৯০ দিন পূর্বে অথবা সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পরর্বর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দু’ধরনেরই বিধান রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ দুটিতে বলা রয়েছে- ‘সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সুপ্রীমকোর্টে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার সুপারিশ করে বলা হয় ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল পূর্বে, যথা- ৪২ দিন পূর্বে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে নির্বাচন-পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভর গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবে।’ অর্থাৎ নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙ্গে যাবে এবং পরবর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বর্তমান সংক্ষিপ্ত মন্ত্রিসভাই ক্ষমতায় থাকবে।
দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে কি না, এমন বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকা বিশ্বের সকল দেশেই দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনের হাতেই থাকে সর্বময় ক্ষমতা।
এছাড়া রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা ছাড়া অন্তর্বর্র্তী ওই সরকার ইচ্ছে করলেও কোন নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ বা নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা সরকারী সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারলেও নির্বাচনী এলাকা বা প্রচারে কোন প্রটোকল ব্যবহার করতে পারবে না। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের যে কোন চাহিদা বা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যা চাইবে তা পূরণ করতে ওই অন্তর্বর্তী সরকার বাধ্য। বাস্তবে ওই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনিক কোন ক্ষমতায় থাকে না। তবে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান একমাত্র পথ উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে আলোচনার কোন বিকল্প নেই। আলোচনার বিকল্প হলো সংঘাত, যা দেশ ও জনগণ- কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। সরকারী দল যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী হয়, বিরোধী দলের উচিত তাতে সাড়া দেয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন কি হবে, নির্বাচন কমিশনকে কিভাবে শক্তিশালী করা যাবে, নির্বাচনে কিভাবে দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যাবে সেসব বিষয়ে দু’পক্ষই সংসদে কিংবা সংসদের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ালেই ক্ষতি হবে দেশের, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কষ্টার্জিত গণতন্ত্র।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর পাল্টে গেছে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। আগে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের কথা বললেও শাসক দল আওয়ামী লীগ এখন বলছে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী নির্বাচন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখন কৌশল পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো। এখন ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ প্রশ্নে কিছুটা নমনীয় হলেও বিএনপি চাইছে সংবিধান লঙ্ঘন না করে কোন নির্দলীয় ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে এনে তাঁকে দিয়ে নিরপেক্ষ ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার গঠন হোক। এ ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নিলে বিএনপি সংলাপ করতে রাজি বলেও কূটনীতিকদের কাছে জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারক নেতারা।
এদিকে বিএনপি চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতিনিধিত্ব দিতে রাজি আওয়ামী লীগ। তবে সরকারপ্রধান প্রশ্নে কোনরকম ছাড় দিতে নারাজ তারা। অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ নিতে বিএনপি রাজি হলে সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ চাইবে, অন্তর্বর্তী সরকার হতে হবে বেজোড় সংখ্যার। যদি অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভার আকার ১১ হয়, তবে সরকার প্রধান ছাড়া মন্ত্রিসভায় বিএনপিকে ৫টি মন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতেও তারা রাজি। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ ৫ ও বিএনপি ৫ এমন মন্ত্রিসভা গঠনেও সম্মতি জানাবে আওয়ামী লীগ। এই হিসাব-নিকাশ থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারা আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত বিএনপি আলোচনার মাধ্যমে সরকারের এমন প্রস্তাব মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে।
সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে আগামী নির্বাচন এবং অন্তর্বর্তী সরকারে চাইলে বিএনপিকে অংশীদারিত্ব দেয়া হবে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ দুটো ঘোষণা সকল পক্ষের মধ্যে ইতিবাচক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। তবে কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙ্গে দিতে পারেন কি না এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মতে, রাষ্ট্রপতি ঠিক করবেন সংসদ কবে ভেঙ্গে দেবেন, কতজনের মন্ত্রিসভা থাকবে। তিনি যে নির্দেশ দেবেন সে অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে বলছেন, সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারে কোন প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। খালেদা জিয়ার আমলে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদে সঠিক ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। নির্বাচনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের রানীকে অনুরোধ করেন সংসদ ভেঙ্গে দিতে। সে অনুযায়ী রানী সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। আমরা ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপ ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি বিধায় ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে সে পদ্ধতিতে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক।
তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধান কে হবেন তা রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করবেন। নির্বাচনের ছয় সপ্তাহ আগে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে অল্প কিছুসংখ্যক মন্ত্রী দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যাবে। আর এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনই শক্তিশালী থাকবে।
আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন। এর ফলে কোন অনির্বাচিত ব্যক্তি সরকার প্রধান হতে পারবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পূর্ণাঙ্গ রায়টি ঘোষণার পর বিরোধী দল এতদিন ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’ যে দাবি জানিয়ে আসছিল, এখন তার আর কোন আইনগত ভিত্তি থাকল না। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিরোধী দলের নেতারা মুখে নানা বক্তব্য রাখলেও এখন তাঁরা ‘অন্তর্বর্তী’ সরকারকে কিভাবে নিরপেক্ষতার আদলে গঠন করা যায়- রাজনীতির সেই অঙ্ক মেলাতেই এখন ব্যস্ত। দলের হাইকমান্ডের মধ্যে নির্বাচনকালীন ‘অন্তর্বর্তী সরকারে’ প্রধানমন্ত্রীর অংশীদারিত্বের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে কি না এ নিয়েও আলোচনা চলছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এমন প্রস্তাবের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে সে ক্ষেত্রে সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটবে না। যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী অনির্বাচিত কেউ অন্তর্বর্তী সরকারে থাকতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই কিছুটা ছাড় দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই ছোট আকারে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক জনকণ্ঠকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর নির্বাচনের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী যে নামেই সরকার গঠন করা হোক না কেন তা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই গঠন করতে হবে। অনির্বাচিত সরকার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে অসাংবিধানিক হয়ে গেছে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ ৩ উপ-দফা অনুযায়ী, বর্তমান সংসদ বহাল রেখে ৯০ দিন পূর্বে অথবা সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পরর্বর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দু’ধরনেরই বিধান রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ দুটিতে বলা রয়েছে- ‘সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সুপ্রীমকোর্টে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার সুপারিশ করে বলা হয় ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে, যুক্তিসঙ্গত কাল পূর্বে, যথা- ৪২ দিন পূর্বে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া বাঞ্ছনীয় হইবে, তবে নির্বাচন-পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভর গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করতঃ উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবে।’ অর্থাৎ নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙ্গে যাবে এবং পরবর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বর্তমান সংক্ষিপ্ত মন্ত্রিসভাই ক্ষমতায় থাকবে।
দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে কি না, এমন বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকা বিশ্বের সকল দেশেই দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনের হাতেই থাকে সর্বময় ক্ষমতা।
এছাড়া রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা ছাড়া অন্তর্বর্র্তী ওই সরকার ইচ্ছে করলেও কোন নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ বা নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা সরকারী সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারলেও নির্বাচনী এলাকা বা প্রচারে কোন প্রটোকল ব্যবহার করতে পারবে না। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের যে কোন চাহিদা বা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যা চাইবে তা পূরণ করতে ওই অন্তর্বর্তী সরকার বাধ্য। বাস্তবে ওই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনিক কোন ক্ষমতায় থাকে না। তবে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে অপরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান একমাত্র পথ উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে আলোচনার কোন বিকল্প নেই। আলোচনার বিকল্প হলো সংঘাত, যা দেশ ও জনগণ- কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। সরকারী দল যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী হয়, বিরোধী দলের উচিত তাতে সাড়া দেয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন কি হবে, নির্বাচন কমিশনকে কিভাবে শক্তিশালী করা যাবে, নির্বাচনে কিভাবে দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যাবে সেসব বিষয়ে দু’পক্ষই সংসদে কিংবা সংসদের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ালেই ক্ষতি হবে দেশের, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কষ্টার্জিত গণতন্ত্র।
No comments