দ্রুত কাজ চাইলে আগের দরপত্রে ফিরতে হবে

পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক নতুন করে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণায় সরকার স্বস্তি পেয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা ছাড় করিয়ে পদ্মা সেতুর মূল কাজ শুরু করা একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। স্থগিত হয়ে যাওয়া ঋণচুক্তি সচল করা এবং যোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করে কার্যাদেশ দেওয়ায় অনেক সময় লাগবে।


তা ছাড়া নদীর প্রবাহ ও প্রতিবেশগত কারণে অন্তত তিন মাস ড্রেজিংয়ের কাজ করা যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব প্রক্রিয়া যদি আজও শুরু করা হয়, ২০১৩ সালের অক্টোবরের আগে মূল কাজে হাত দেওয়া যাবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরো বলছেন, প্রাকযোগ্যতা যাচাই হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন বিবেচনায় নিলে কম সময়ে কাজ শুরু করা যাবে। বর্তমান মেয়াদে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে চাইলে সরকারের উচিত হবে বিশ্বব্যাংককে সময় বেঁধে দিয়ে দ্রুত মূল কাজ শুরুর তাগিদ দেওয়া। বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার ঘোষণা ও বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ব্যক্তিরা এসব মতামত দেন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, 'প্রতিটি পর্যায়েরই নির্দিষ্ট কিছু সময় লাগবে। এসব শেষ করে মূল কাজ শুরু করতে আগামী বছরের অক্টোবর লেগে যাবে। এটিই বাস্তবসম্মত সময়।' তিনি জানান, পদ্মায় ইলিশের চলাচলের জন্য মাঝখানে তিন মাস নদীতে সব রকমের খননকাজ করা নিষেধ।
নতুন দুটি শর্ত পূরণ ও বোর্ডের সম্মতিসাপেক্ষে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসবে- শুক্রবার সংস্থাটির সদর দপ্তর থেকে এমন ঘোষণা আসার দুই দিন পরও সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এ প্রকল্পের অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসা নিয়ে কথা বলতে আজ রবিবার সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকাল শনিবার মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে ডাচ্বাংলা ব্যাংকের বার্ষিক শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
গতকাল অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য জানার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা অর্থমন্ত্রীকে ঘিরে ধরলে রবিবার সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাবেন বলেই মন্ত্রী চলে যান।
বাতিল করা কোনো প্রকল্পে ফিরে আসা বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসে নজিরবিহীন উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এতে ২৯০ কোটি ডলারের এ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে সহজ হবে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা পদে ড. মসিউর রহমানের বহাল থাকাকে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার পরে সর্বশেষ অন্তরায় হিসেবে দেখা হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, ড. মসিউর অর্থনৈতিক বা পদ্মা সেতু-সংক্রান্ত কাজে সম্পৃক্ত থাকবেন না। পরদিনই ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক জানায়, দুর্নীতি তদন্তে সরকারের এ যাবৎকালে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে বাংলাদেশ রাজি হওয়ায় সংস্থাটি পদ্মা সেতু প্রকল্পে নতুন করে যুক্ত হবে।
গতকাল কালের কণ্ঠের কাছে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ড. মসিউর বলেন, বিশ্বব্যাংকের আসার ঘোষণায় অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। তারা যদি এখন দরপত্রগুলো দ্রুত বাছাই করে কার্যাদেশ দেয়, তাহলে ভালো হয়। যাতে এ সরকারের আমলে সেতুর কাজ শুরু করা যায়, সে জন্য উভয় পক্ষকে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
ফিরে আসার শর্ত হিসেবে বিশ্বব্যাংক একটি স্বাধীন প্যানেল গঠন করার কথা বলেছে- পদ্মা সেতু নিয়ে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তকাজে এ প্যানেল দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে কাজ করবে। নতুন আরেকটি শর্ত হচ্ছে- পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকসহ অর্থায়নকারী অন্যান্য সংস্থার আরো বেশি তদারকি থাকবে।
এ ব্যাপারে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারিগরি কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এত দিন যে বিশ্বব্যাংকের তদারকি কম ছিল তা নয়। প্রতিটি সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাংকের অনুমতির জন্য পাঠানো হতো। একইভাবে অন্য দুটি সংস্থাকেও সব কিছু জানানো হতো। পদ্মা সেতুর মূল কাজ ও নদীশাসনসহ অন্তত পাঁচটি পর্যায়ের কাজের দরপত্রের নথি বিশ্বব্যাংকের কাছে পড়ে রয়েছে। এখনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।
পদ্মা সেতু বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মূল সেতুর কাজের প্রাকযোগ্যতা বিশ্বব্যাংক অনুমোদন করে গত বছরের জুলাই মাসে। এর আগে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এ-সংক্রান্ত দরপত্রের কাগজপত্র পাঠানো হয়। নদীশাসন কাজের দরপত্রের কাগজপত্র বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে গেছে ২০১১ সালের মার্চে। মাওয়া সংযোগ সড়কের দরপত্রের কাগজ পাঠানো হয়েছিল গত বছরের জুন মাসে। এসব কাগজপত্র পাঠানোর পর এক থেকে দেড় বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত কোনোটিরই সম্মতি দেয়নি বিশ্বব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, নতুন করে সম্পৃক্ত হওয়া বলতে যদি পুরো প্রক্রিয়া প্রথম থেকে শুরু করা বোঝায় তাহলে তা হবে সময়সাপেক্ষ। তার পরিবর্তে প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়ে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বেছে কার্যাদেশ দেওয়া হলে সময় কম লাগবে। সে ক্ষেত্রেও ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। কারণ তারা অন্তত দুই বছর আগে দরপত্রে অংশ নিয়েছিল। এখন তারা প্রস্তুত কি না তা জানতে হবে।
নির্মাণ তদারকির পরামর্শক নিয়োগের প্রাকযোগ্যতা যাচাই পর্বে এসে পুরো প্রকল্পই ঝুলে গেছে। এ ক্ষেত্রেও প্রাকযোগ্য হিসেবে বিবেচিত প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তালিকা পাঠানো হয়েছে, সেটি অনুমোদিতও হয়েছে। মূল্য দরপত্রও খোলা হয়েছিল। তার পরই কানাডীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক, আর অনিশ্চিত হয়ে পড়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক এবং সহযোগী এডিবি ও জাইকার অর্থায়ন। সেই কম্পানিকে বাদ দিয়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে এর আগেও বলা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সাড়া দেয়নি। তালিকার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রমানুসারে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা যায়। তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে কার্যাদেশ দিলে সময় বাঁচে। এ প্রসঙ্গে সেতু বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের দেশে এ নিয়মে কাজ দেওয়া যায়। বিশ্বব্যাংকের কী নিয়ম জানি না।' তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাংককে তাদের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন সম্পন্ন করার জন্য সরকার যদি সময় বেঁধে দিতে পারে, তাহলে হয়তো কম সময়ে সেতুর কাজ শুরু করা যাবে।
নতুন শর্তগুলোর 'সন্তোষজনক' বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসা। এদিকে দুর্নীতির তদন্তে বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্টির মাপকাঠিও স্পষ্ট নয় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের কাছে। এর আগে মূল সেতুর দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কোনো আভাস পায়নি দুদক। তবু তা গ্রহণযোগ্য হয়নি বিশ্বব্যাংকের কাছে। দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এখানে সরকারের কর্তৃত্বও গ্রহণযোগ্য নয়। সে ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংককে কতখানি প্রবেশাধিকার দেওয়া সম্মানজনক- এ প্রশ্নে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারাও এর আগে আপত্তি জানিয়েছিলেন।
ক্রয়প্রক্রিয়ায় অধিকতর তদারকির প্রস্তাবে সরকারের একজন নীতিনির্ধারক বলেন, সেতুটি তৈরি করছে বাংলাদেশ। ঋণের দায়দায়িত্ব এ দেশের সরকারের। পরিশোধও করতে হবে এদেশকেই। অথচ সেতুর কাজের মান নিয়ন্ত্রণে এ দেশের ভূমিকা থাকবে গৌণ। অথচ বাংলাদেশও এ প্রকল্পে অন্যতম অর্থায়নকারী।

No comments

Powered by Blogger.