হৃদয়নন্দন বনে-রূপালি চাঁদের আরশিতে আমার মাতৃভূমির প্রতিচ্ছবি by আলী যাকের
সপ্তাহ তিনেক আগের কথা। ভাদ্রের জোছনা আকাশ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পূর্ণচন্দ্র আজ। হঠাৎই মনে হলো পূর্ণিমার কথা। আমার গাড়িচালককে বললাম, নিয়ে চল কোথাও, যেখান থেকে চাঁদ দেখা যায়। গেলাম আশুলিয়ায়। সেখানে এখনও জল টলটল করছে রাস্তার উভয় পাশে।
গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। বাইরে বেরিয়ে এলাম। থালার মতো চাঁদটি তখন জল ছাড়িয়ে অনেক ওপরে উঠে গেছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একবার চাঁদ দেখি, একবার জলের ওপরে চাঁদের আলো। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। মুঠোফোনে বার্তা পাঠাই আমার কিছু আপনজনকে। লিখি, 'জল-জোছনার এমন বর্ণনাতীত সমন্বয় আর কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না।' জবাব আসে কেবল একজনের কাছ থেকে। সেই যুবক আমায় লেখে, 'আমি আপনাকে ঈর্ষা করি।' অন্য সবাই, অনুমান করি, নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আমি আশুলিয়ায় পূর্ণচন্দ্রের সৌন্দর্যে অবগাহন করতে থাকি। ঢাকা শহর তখন প্রচণ্ড গরমে আইঢাই করছে। অথচ আশুলিয়ায় বইছে তখন মৃদুমন্দ বাতাস।
কতক্ষণ যে চাঁদের সৌন্দর্যস্পৃৃষ্ট হয়ে স্থাণু হয়ে পড়েছিলাম, লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ যখন সম্বিৎ ফিরে এলো, ফিরে এলাম ধরায়। দেখলাম যে, দৃষ্টিটাকে ডান দিক থেকে সামান্য বাঁ দিকে নিলে পরেই কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে জলমগ্ন চাঁদ, মৃদুমন্দ বাতাস আর দূরের নাগরিক আলোর বিন্দু। আমার পাশ দিয়েই ছুটে চলেছে সারি সারি গাড়ি প্রচণ্ড শব্দ তুলে। প্রতিটি গাড়িই উগরে দিচ্ছে ধোঁয়া, যার তীব্র গন্ধে ভেতর থেকে উঠে আসে অন্নপ্রাশনের ভাত। হঠাৎ আমার চৈতন্যে উদয় হয় একটি অতি আপাত সাধারণ উপলব্ধির। আমি ভাবি, আমাদের চারপাশের রূঢ় যে বাস্তব, যেখানে বসবাস আমাদের দিন-রাত, তাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে নিসর্গের আকর্ষণ কত অবলীলায়! যখন আমরা ঠাট্টাচ্ছলে বলি যে, প্রতিদিনের জীবনযাত্রার কঠিন পথপরিক্রমা থেকে মনকে সরিয়ে নিয়ে সুন্দরের প্রতি দৃষ্টি স্থাপন করা কি আদৌ সম্ভব? তখন আমরা অহেতুক সেই প্রশ্ন করি। এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। হয় আমাদের প্রবৃত্তি নেই প্রকৃতিপ্রদত্ত সৌন্দর্যে অবগাহন করার; নয়তো আমাদের জীবনটাকে আমরা এত বেশি যন্ত্রদগ্ধ করে ফেলেছি যে, আমাদের নজরেই পড়ে না কখন সকাল হয়, কখন সূর্য মধ্যগগনে, কখন দিন শেষে পাখি নীড়ে ফেরে, অথবা কখন নিশুতি রাত আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে শান্তির প্রলেপে! আমরা জানি না_ এটাই কারণ কিনা আমাদের অস্থিরতার!
কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিজ্ঞাপন উৎসবের (অফ-ঋবংঃ) কথা। সেখানে বিদেশে অবস্থিত একটি বহুজাতিক বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি তোফায়েল রশীদ একটি বর্ণময় উপস্থাপনায় মুগ্ধ করেছিলেন আমাদের। সেই উপস্থাপনার বিষয়বস্তু ছিল এ রকম যে, আমাদের এই হতভাগা দেশে যেখানে প্রতিদিন আমরা কেবলই দুর্নীতি, অসদাচরণ, হানাহানি, মৃত্যু_ এসব জীবনবিমুখ বিষয়ের দ্বারা উতলা হচ্ছি, তখন আমাদের দৃষ্টি একটু ফিরিয়ে নিয়ে চারপাশে তাকালেই দেখতে পাব যে, এই দেশে এই সময়েও এমন মানুষ আছেন, যাদের নিয়ে গর্ব করা যায়। আছে এমন বনফুল অথবা ফলের প্রাচুর্য, ধানক্ষেতের গাঢ় সবুজ, নদীর শান্তিময়তা, হাওর-বাঁওড়ে অতিথি পাখির কলকাকলি, যা আমাদের উজ্জীবিত করতে পারে প্রতিনিয়ত। আছে আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের দল, পুরুষ-নারী উভয়েই, যারা নিদ্বর্িধায় এবং নিঃসংকোচে আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দিনের পর দিন নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তাদেরই কল্যাণে আমরা ঘরে তুলছি সোনার ধান, ক্রমবর্ধমান হারে। তাদেরই পরিশ্রমের ফসল আমাদের পোশাক আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি ক্রমবর্ধমান হারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য। তাদেরই সমগোত্রীয় বাংলাদেশি বিদেশ থেকে নিরন্তর দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। যার দ্বারা আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমরা কেন বাংলাদেশের এই অতি ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরি না বিশ্বের কাছে? কেন এগুলোকেই বাহন করি না আমাদের চিন্তা-চেতনাকে সুদূরপ্রসারী করতে এবং যদি আমাদের ওপরে এমন দায়িত্ব বর্তায় যে, বাংলাদেশকে ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাব আমরা, তবে সেই ব্র্যান্ডের মোদ্দা কথা কেন হতে পারে না এই দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এমন জীবননিষ্ঠ বিষয়ের প্রতিচ্ছবি?
তোফায়েল রশীদের ওই উপস্থাপনার পরে আমি যখন উজ্জীবিত বোধ করছিলাম, ঠিক সেই সময় বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক তরুণ নির্বাহী তাকে প্রশ্ন করলেন, যখন আমাদের দৈনন্দিন জীবন রাস্তার যানজট, বাজারের দুর্মূল্য কিংবা নানাবিধ হতাশাব্যঞ্জক কথাবার্তা দ্বারা বিপর্যস্ত, তখন কী করে সম্ভব কাউকে আশার বাণী শোনানো? আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। তোফায়েল তার স্বভাবসুলভ প্রতীচ্যীয় শিক্ষায় দীক্ষিত মৃদু ভাষায় বললেন, 'এ সবই আছে। তা সত্ত্বেও তো আমাদের সবারই উচিত হবে ইতিবাচক দিকগুলোকে বের করে নিয়ে আসা।' যেহেতু আমার সেখানে কথা বলার কথা ছিল না, তাই আমি আমার মনের কথাগুলো বলতে পারলাম না। পারলে আমি বলতাম, আমাদের এই বাংলাদেশে প্রতিদিনের জীবনযাপনে একাধিক নেতিবাচক বিষয়ে আমরা সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত থাকি_ এ কথা সত্য। কিন্তু এর দোহাই দিয়ে আমরা ইতিবাচক সম্ভাবনাগুলোকে অবহেলা করব_ সেটাই বা কোন যুক্তির কথা হলো?
আমার এক তরুণ আত্মীয়ের কথা প্রসঙ্গত আমার মনে আসছে এখন। এই আত্মীয়টি প্রতিদিন তার বাসস্থান থেকে কর্মস্থল পর্যন্ত বাসে যাতায়াত করে। এই সামান্য পথটুকুতে প্রায়ই তাকে যানজটে এক-দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বাসের ভেতর তিল ধারণের জায়গা নেই, প্রচণ্ড গরম। তা সত্ত্বেও সে সহ্য করে যায়। এসব প্রতিবন্ধকতাকে তার জীবনের প্রাত্যহিকতার মধ্যে সে স্থান করে নিয়েছে। তার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিল, সে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই ভেবে যে, একদিন তার জীবনে সুবাতাস বইবে, যখন তার থাকবে একটি নিজস্ব যানবাহন। এই তরুণটি আমায় হাসতে হাসতে বলেছিল যে, একবার তার পাশের এক যাত্রী বারবার অভিযোগ করছিলেন, 'এখান থেকে আমার অফিসে হেঁটে যেতে ৫-৬ মিনিট সময় লাগে। অথচ কী দুর্বিষহ যানজটে আমি আটকা পড়ে আছি!' আমার আত্মীয়টি তাকে বলেছিল, '৫-৬ মিনিট সময় যদি লাগে, তাহলে এক্ষুণি বাস থেকে নেমে হেঁটে চলে যান না কেন? কেন এই দুর্বিষহ একটি অবস্থার মধ্যে আপনি ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন?' মোদ্দা কথাটা এই_ আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে সব বিষয়ে অভিযোগ করা এবং যা নিয়ে অভিযোগ করছি, তার থেকে বেরোবার হাজারটা পথ থাকলেও আমরা সেগুলোর প্রতি চোখ বন্ধ করে অভিযোগের খৈ ফোটাতে থাকি। সেই বিজ্ঞাপন উৎসবের তরুণটিকে আমার বলার ইচ্ছা ছিল যে, ওই দিনের উপস্থাপনায় আমাদের জীবনের নেতিবাচক দিকগুলো তো শুরুতেই তুলে ধরা হয়েছে এবং এর পরেই বলা হয়েছে যে, এসব সত্ত্বেও আমাদের এত সব ইতিবাচক দিক রয়েছে। রাস্তায় জ্যাম আছে বলে আমাদের খাদ্যোৎপাদন তো কমে যায়নি? আমাদের বিদেশি রেমিট্যান্স তো লাঘব হয়নি? আমাদের সাক্ষরতা তো ঊর্ধ্বমুখীই আছে? আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন তো তিন হাজার মেগাওয়াটের কোঠা ছাড়িয়ে ছয় হাজারে গিয়ে পেঁৗছেছে? আমাদের নারীরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তো এগিয়ে চলেছে? আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের ঊর্ধ্বগতি কি একটুও শ্লথ হয়েছে? এবং এসব কর্মকাণ্ডের ফসল কি ঘরে তুলছে না সাধারণ বাংলাদেশি কৃষক এবং শ্রমজীবী মানুষ? আজকের গ্রামবাংলায় মানুষের সমৃদ্ধি দেখলে সহজেই বোঝা যায়, এক যুগ আগের গ্রামবাংলা আর আজকের মধ্যে কত ফারাক! এ সবকিছুই কি ম্লান হয়ে যাবে ঢাকা শহরের রাস্তায় যানজট হলে?
এসব কথা তো বলে আসছি প্রতিনিয়ত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু তাতে কার-বা কী এসে যায়? অতএব যুক্তি, বুদ্ধি, বিতর্ক ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিয়ে আপাতত চাঁদের সুধাপানের স্বপ্নে নিমজ্জিত হই আবার।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
কতক্ষণ যে চাঁদের সৌন্দর্যস্পৃৃষ্ট হয়ে স্থাণু হয়ে পড়েছিলাম, লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ যখন সম্বিৎ ফিরে এলো, ফিরে এলাম ধরায়। দেখলাম যে, দৃষ্টিটাকে ডান দিক থেকে সামান্য বাঁ দিকে নিলে পরেই কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে জলমগ্ন চাঁদ, মৃদুমন্দ বাতাস আর দূরের নাগরিক আলোর বিন্দু। আমার পাশ দিয়েই ছুটে চলেছে সারি সারি গাড়ি প্রচণ্ড শব্দ তুলে। প্রতিটি গাড়িই উগরে দিচ্ছে ধোঁয়া, যার তীব্র গন্ধে ভেতর থেকে উঠে আসে অন্নপ্রাশনের ভাত। হঠাৎ আমার চৈতন্যে উদয় হয় একটি অতি আপাত সাধারণ উপলব্ধির। আমি ভাবি, আমাদের চারপাশের রূঢ় যে বাস্তব, যেখানে বসবাস আমাদের দিন-রাত, তাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে নিসর্গের আকর্ষণ কত অবলীলায়! যখন আমরা ঠাট্টাচ্ছলে বলি যে, প্রতিদিনের জীবনযাত্রার কঠিন পথপরিক্রমা থেকে মনকে সরিয়ে নিয়ে সুন্দরের প্রতি দৃষ্টি স্থাপন করা কি আদৌ সম্ভব? তখন আমরা অহেতুক সেই প্রশ্ন করি। এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। হয় আমাদের প্রবৃত্তি নেই প্রকৃতিপ্রদত্ত সৌন্দর্যে অবগাহন করার; নয়তো আমাদের জীবনটাকে আমরা এত বেশি যন্ত্রদগ্ধ করে ফেলেছি যে, আমাদের নজরেই পড়ে না কখন সকাল হয়, কখন সূর্য মধ্যগগনে, কখন দিন শেষে পাখি নীড়ে ফেরে, অথবা কখন নিশুতি রাত আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে শান্তির প্রলেপে! আমরা জানি না_ এটাই কারণ কিনা আমাদের অস্থিরতার!
কথা প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিজ্ঞাপন উৎসবের (অফ-ঋবংঃ) কথা। সেখানে বিদেশে অবস্থিত একটি বহুজাতিক বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি তোফায়েল রশীদ একটি বর্ণময় উপস্থাপনায় মুগ্ধ করেছিলেন আমাদের। সেই উপস্থাপনার বিষয়বস্তু ছিল এ রকম যে, আমাদের এই হতভাগা দেশে যেখানে প্রতিদিন আমরা কেবলই দুর্নীতি, অসদাচরণ, হানাহানি, মৃত্যু_ এসব জীবনবিমুখ বিষয়ের দ্বারা উতলা হচ্ছি, তখন আমাদের দৃষ্টি একটু ফিরিয়ে নিয়ে চারপাশে তাকালেই দেখতে পাব যে, এই দেশে এই সময়েও এমন মানুষ আছেন, যাদের নিয়ে গর্ব করা যায়। আছে এমন বনফুল অথবা ফলের প্রাচুর্য, ধানক্ষেতের গাঢ় সবুজ, নদীর শান্তিময়তা, হাওর-বাঁওড়ে অতিথি পাখির কলকাকলি, যা আমাদের উজ্জীবিত করতে পারে প্রতিনিয়ত। আছে আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের দল, পুরুষ-নারী উভয়েই, যারা নিদ্বর্িধায় এবং নিঃসংকোচে আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দিনের পর দিন নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তাদেরই কল্যাণে আমরা ঘরে তুলছি সোনার ধান, ক্রমবর্ধমান হারে। তাদেরই পরিশ্রমের ফসল আমাদের পোশাক আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি ক্রমবর্ধমান হারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য। তাদেরই সমগোত্রীয় বাংলাদেশি বিদেশ থেকে নিরন্তর দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। যার দ্বারা আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমরা কেন বাংলাদেশের এই অতি ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরি না বিশ্বের কাছে? কেন এগুলোকেই বাহন করি না আমাদের চিন্তা-চেতনাকে সুদূরপ্রসারী করতে এবং যদি আমাদের ওপরে এমন দায়িত্ব বর্তায় যে, বাংলাদেশকে ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাব আমরা, তবে সেই ব্র্যান্ডের মোদ্দা কথা কেন হতে পারে না এই দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এমন জীবননিষ্ঠ বিষয়ের প্রতিচ্ছবি?
তোফায়েল রশীদের ওই উপস্থাপনার পরে আমি যখন উজ্জীবিত বোধ করছিলাম, ঠিক সেই সময় বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক তরুণ নির্বাহী তাকে প্রশ্ন করলেন, যখন আমাদের দৈনন্দিন জীবন রাস্তার যানজট, বাজারের দুর্মূল্য কিংবা নানাবিধ হতাশাব্যঞ্জক কথাবার্তা দ্বারা বিপর্যস্ত, তখন কী করে সম্ভব কাউকে আশার বাণী শোনানো? আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। তোফায়েল তার স্বভাবসুলভ প্রতীচ্যীয় শিক্ষায় দীক্ষিত মৃদু ভাষায় বললেন, 'এ সবই আছে। তা সত্ত্বেও তো আমাদের সবারই উচিত হবে ইতিবাচক দিকগুলোকে বের করে নিয়ে আসা।' যেহেতু আমার সেখানে কথা বলার কথা ছিল না, তাই আমি আমার মনের কথাগুলো বলতে পারলাম না। পারলে আমি বলতাম, আমাদের এই বাংলাদেশে প্রতিদিনের জীবনযাপনে একাধিক নেতিবাচক বিষয়ে আমরা সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত থাকি_ এ কথা সত্য। কিন্তু এর দোহাই দিয়ে আমরা ইতিবাচক সম্ভাবনাগুলোকে অবহেলা করব_ সেটাই বা কোন যুক্তির কথা হলো?
আমার এক তরুণ আত্মীয়ের কথা প্রসঙ্গত আমার মনে আসছে এখন। এই আত্মীয়টি প্রতিদিন তার বাসস্থান থেকে কর্মস্থল পর্যন্ত বাসে যাতায়াত করে। এই সামান্য পথটুকুতে প্রায়ই তাকে যানজটে এক-দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বাসের ভেতর তিল ধারণের জায়গা নেই, প্রচণ্ড গরম। তা সত্ত্বেও সে সহ্য করে যায়। এসব প্রতিবন্ধকতাকে তার জীবনের প্রাত্যহিকতার মধ্যে সে স্থান করে নিয়েছে। তার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিল, সে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই ভেবে যে, একদিন তার জীবনে সুবাতাস বইবে, যখন তার থাকবে একটি নিজস্ব যানবাহন। এই তরুণটি আমায় হাসতে হাসতে বলেছিল যে, একবার তার পাশের এক যাত্রী বারবার অভিযোগ করছিলেন, 'এখান থেকে আমার অফিসে হেঁটে যেতে ৫-৬ মিনিট সময় লাগে। অথচ কী দুর্বিষহ যানজটে আমি আটকা পড়ে আছি!' আমার আত্মীয়টি তাকে বলেছিল, '৫-৬ মিনিট সময় যদি লাগে, তাহলে এক্ষুণি বাস থেকে নেমে হেঁটে চলে যান না কেন? কেন এই দুর্বিষহ একটি অবস্থার মধ্যে আপনি ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন?' মোদ্দা কথাটা এই_ আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে সব বিষয়ে অভিযোগ করা এবং যা নিয়ে অভিযোগ করছি, তার থেকে বেরোবার হাজারটা পথ থাকলেও আমরা সেগুলোর প্রতি চোখ বন্ধ করে অভিযোগের খৈ ফোটাতে থাকি। সেই বিজ্ঞাপন উৎসবের তরুণটিকে আমার বলার ইচ্ছা ছিল যে, ওই দিনের উপস্থাপনায় আমাদের জীবনের নেতিবাচক দিকগুলো তো শুরুতেই তুলে ধরা হয়েছে এবং এর পরেই বলা হয়েছে যে, এসব সত্ত্বেও আমাদের এত সব ইতিবাচক দিক রয়েছে। রাস্তায় জ্যাম আছে বলে আমাদের খাদ্যোৎপাদন তো কমে যায়নি? আমাদের বিদেশি রেমিট্যান্স তো লাঘব হয়নি? আমাদের সাক্ষরতা তো ঊর্ধ্বমুখীই আছে? আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন তো তিন হাজার মেগাওয়াটের কোঠা ছাড়িয়ে ছয় হাজারে গিয়ে পেঁৗছেছে? আমাদের নারীরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তো এগিয়ে চলেছে? আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের ঊর্ধ্বগতি কি একটুও শ্লথ হয়েছে? এবং এসব কর্মকাণ্ডের ফসল কি ঘরে তুলছে না সাধারণ বাংলাদেশি কৃষক এবং শ্রমজীবী মানুষ? আজকের গ্রামবাংলায় মানুষের সমৃদ্ধি দেখলে সহজেই বোঝা যায়, এক যুগ আগের গ্রামবাংলা আর আজকের মধ্যে কত ফারাক! এ সবকিছুই কি ম্লান হয়ে যাবে ঢাকা শহরের রাস্তায় যানজট হলে?
এসব কথা তো বলে আসছি প্রতিনিয়ত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু তাতে কার-বা কী এসে যায়? অতএব যুক্তি, বুদ্ধি, বিতর্ক ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিয়ে আপাতত চাঁদের সুধাপানের স্বপ্নে নিমজ্জিত হই আবার।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments