আসুন, সবাই মিলে অশুভ চক্রটা ভেঙে ফেলি by আমিরুল আলম খান
না,
২০১৭ সাল আমাদের আদৌ ভালো গেল না। না, রাজনীতি, গণতন্ত্র, অর্থনীতি,
সুশাসন, মানবাধিকার বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছি না। বলছি, দেশের
শিক্ষার সর্বনাশের কথা। মোটা দাগে দুটো ঘটনা আমাকে সবচেয়ে পীড়িত করেছে,
উদ্বিগ্ন করেছে। বছরের শেষে শিক্ষকদের অনশন ধর্মঘট আমাকে অত্যন্ত ব্যথাতুর
করেছে। আর উদ্বিগ্ন করেছে একেবারে জীবনের প্রথম পরীক্ষায় বসতে গিয়ে ছয়
বছরের শিশু পড়ুয়া যখন জানতে পেরেছে, তার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে।
শিক্ষাব্যবস্থাপনা এত অধঃপাতে যাবে, তা কেউ কল্পনা করেনি! কেউ যে
প্রশ্নফাঁস করে শিশুর এমন সর্বনাশ করবে, তা কে জানত? শিশুর সর্বনাশ মানে,
জাতির চরম ক্ষতি, যে ক্ষতি জাতি কোনো দিনই আর পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু
জেনেশুনে বছরের পর বছর এমন ‘কালাপাহাড়ি’ কাণ্ড চলবে তা কেউ স্বপ্নেও
ভাবেনি। বাস্তবতা হলো, সেটাই চলছে, চলছেই।এই যে সর্বনাশ, নিজ সন্তানের, তা
যেন ক্রমেই সয়ে যাচ্ছে সমাজে। না-ই যদি সইবে, তবে বাবা-মা ফাঁস হওয়া
প্রশ্ন জোগাড়ে পাগল হয়ে উঠবেন কেন? তারা কি জানেন না, নিজেই তার প্রাণের ধন
সন্তানকে হত্যা করছেন? কেনইবা শিক্ষক তার প্রাণের চেয়ে আপন শিক্ষার্থীর
এমন সর্বনাশ ঘটাবেন? নিষ্পাপ শিশুদের ওপর পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে আমরা রঙ্গ
দেখি। বলি, তারা নাকি উৎসবে মেতে পরীক্ষায় বসে! যদি নিজেকে প্রশ্ন করি, ওই
বয়সে আমার মন কী চাইত? শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে পাভলভের ‘কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স’
একটি অসাধারণ তত্ত্ব। তিনি কুকুর নিয়ে পরীক্ষা করে বলেছেন, প্রতিবার ঘণ্টা
পিটিয়ে খাবার দিতে দিতে একসময় তা এমন অভ্যাসে পরিণত হয় যে, ঘণ্টা পেটালেই
সে জানে, তার খাবার আসছে। যেমন স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজালেই শিশুরা আনন্দে
হই হই করে ক্লাস থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে খোলা বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে।
এভাবেই ‘কন্ডিশন্ড’ হয়ে যায় সবাই। বাংলা প্রতিশব্দটি লিখলাম না, কেননা
পণ্ডিতেরা যে পরিভাষা তৈরি করেছেন, তা বুঝতে পণ্ডিতেরই মাথা ঘেমে যায়। আবার
যদি উল্টোটা করি অর্থাৎ, ঘণ্টা পিটিয়ে খাবার পেতে তাকে অভ্যস্ত করার পর
একসময় থেকে ঘণ্টা পেটানোর পর খাবার দেয়া বন্ধ করে দেই, তাহলে কী হবে? সে
নতুনভাবে অভ্যস্ত হবে, ঘণ্টা পেটানোর সাথে খাবার মিলবে না জেনে হাজারবার
ঘণ্টা পেটালেও সে আর খাবারের আশায় ছুটে আসবে না। পরীক্ষার সোনালি
সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়ে আজ আমরা সাফল্যের মিথ্যা হাসি হাসছি। এভাবেই আমরা
অজস্র পরীক্ষার বাঁধনে বেঁধে ফেলছি, অভ্যস্ত করে তুলছি সার্টিফিকেটের লোভ
ধরিয়ে। সে দিন খুব দূরে নয়, যে দিন হাজার ঘণ্টা পেটালেও, সার্টিফিকেটের
ঘণ্টা বাজালেও কোনো শিশু স্কুলের ছায়াও মাড়াবে না। কিন্তু এখন যে ঢোল
পেটানো চলছে তার ফল এই হচ্ছে যে, সাধারণ একটি দরখাস্ত লেখার দক্ষতা নেই এমন
মাস্টার্স ডিগ্রিধারীতে দেশ ভরে যাচ্ছে। না, শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
নয়, ডিগ্রিদানের এই প্রতিযোগিতার তালিকার শীর্ষে আছে দেশের সবচেয়ে বড় বড়
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। এই প্রতারিত ডিগ্রিধারীরা যদি একযোগে বলে,
‘আমাকে ডিগ্রি দিয়েছ, এবার কাজ দাও, সেটা কি অন্যায় দাবি হবে? খবর
বেরিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি উচ্চ ডিগ্রিধারী বেকারের দেশ
বাংলাদেশ।’ কথাটা হজম করা কঠিন।সরকারের জরিপেই শিক্ষা নিয়ে যেসব ভয়ঙ্কর
তথ্য উঠে আসছে, তার পরও আমরা এই শিক্ষা নিয়ে বড়াই করেই চলেছি। ‘ডিম আগে, না
মুরগি আগে’ পণ্ডিতদের এ প্রশ্নের মীমাংসা না হয় কঠিন হতে পারে। কেননা, যত
পণ্ডিত তত মত। আবার সন্ন্যাসী অধিক হলে গাজন নষ্ট হবেই। কিন্তু ‘সৃজনশীল
পাঠদান’ আগে, না ‘সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণ আগে’ সেটাও কি তেমন কঠিন
কোনো প্রশ্ন? সৃজনশীল পাঠদান করতে না পারার দায় না হয় শিক্ষকের, কিন্তু
তাকে সৃজনশীল পাঠদানে দক্ষ করার দায় নিশ্চয়ই সরকারের। সেখানে সরকারের
উদ্যোগ বা সাফল্য দুটোই যে শূন্য! প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত এনসিটিবি
যেসব বই পড়ুয়াদের মাগনা বিলায়, তা কি আমরা কেউ পাঠ করে দেখেছি? কারা লেখেন
এসব মহামূল্যবান পাঠ্যপুস্তক? বই যদি সুখপাঠ্য না হয়, পড়ুয়ারা যদি তা পড়ে
আনন্দই না পায়, তবে তারা তা পড়বে কেন? আর বই-ই যদি পড়া না হয়, তাহলে পড়ার
অভ্যাস গড়ে উঠবে কোথা থেকে?
জানি, পাঠ্যবই কোনোকালেই সুখপাঠ্য নয়। কিন্তু
পাঠকে আনন্দদায়ক করার যেসব পথ মানুষ শত শত বছর আমল করে আসছে, সেই পথটা কেন
বন্ধ করে দিলাম আমরা? কেমন করে? শিশুর কাঁধে একাধারে বই আর পরীক্ষার বোঝা
চাপিয়ে। সে যে ক্লাসের পড়ার বাইরে আর আনন্দ পাওয়ার মতো কোনো বই পড়বে, সে
সময় পাবে কোথায়? বই ও পরীক্ষার বোঝার পর আছে সোনালি প্লাস না পেলে অভিভাবক,
শিক্ষক, প্রতিবেশীদের গঞ্জনা! কোনটা বেশি দরকারি? শিক্ষা, না কি পরীক্ষা
পাসের ‘সোনালি সার্টিফিকেট’? আমরা যে সার্টিফিকেটবাণিজ্যে নেমেছি, তা থেকে
হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের ব্যবস্থা করে চলেছি পাল্লা দিয়ে। আর কেড়ে
নিয়েছি শিশুদের জীবন থেকে সব আনন্দ। প্রায় এক দশক ধরে ১ জানুয়ারি দেশ ‘বই
উৎসবে’ মেতে ওঠে। এবার বিতরণ করা হচ্ছে ৩৫ কোটি পাঠ্যপুস্তক। খুব ভালো খবর।
সব উপজেলায়, সব স্কুলে এনসিটিবির বিলি করা হয়তো শেষ হয়েছে। কিন্তু তারও
আগে বিদ্যাবাণিজ্যের বণিকেরা অন্তত ২০০ কোটি নোট-গাইড স্কুলে স্কুলে তথা সব
পড়ুয়ার ঘরে পৌঁছে দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছে। তবে পার্থক্য এই
যে, সেসব কেতাব কিনতে অভিভাবকদের গোলার ধান উজাড় হয়ে গেছে। এই বাণিজ্যে ‘যে
দেবতা যাতে তুষ্ট’ তা দিয়েই পুজোর থালা সাজানো। খ্রিষ্টীয় বছরের প্রথম দিন
যে শিশু খয়রাতি বইয়ের গন্ধে আমোদিত হয়ে ঘরে ফেরে, সেগুলো কখনো তার
স্কুলব্যাগে ঢোকে না। পরদিন থেকেই ব্যাগ ভরে ‘বাজারি দামি নোট-গাইড’ নিয়ে
সে স্কুলে যায়। স্কুলগুলোতে সে বই কিনতে বাধ্য করার সাথে জড়িয়ে গেছে তারাই,
যাদের দায়িত্ব তা বন্ধ করার। লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, কেরানি, আমলা ও
জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সে তালিকা খুব লম্বাই। আমি বিভিন্ন স্কুলে শত শত
ছাত্রের ব্যাগ তালাশ করেই এ কথা লিখছি। তা হলে প্রশ্ন : যে অপাঠ্য
পাঠ্যপুস্তক এনসিটিবি লেখায়, ছাপে এবং পড়–য়াদের মধ্যে বিলিয়ে থাকে, তার লাভ
আসলে খায় কোন পিঁপড়া? দ্বিতীয় প্রশ্ন : ৩৫ কোটি বই লিখিয়ে, ছেপে, স্কুলে
স্কুলে পৌঁছে দিতে কত হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় জনগণের পকেট কেটে? তার একটা
হিসাব জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে। তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
প্রশ্নটি হলো, এই বিপুল অর্থ কি শুধু অপচয় তথা দুর্নীতি নয়? এবার দ্বিতীয়
প্রসঙ্গ। বছর শেষে অভুক্ত শিক্ষকেরা অনশন ধর্মঘট করেছেন তাদের অতি ন্যায্য
দাবি শ্রমের মজুরির (এমপিও) দাবিতে। আর বছর শুরু হলো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের
জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনের মাধ্যমে। বছরের পর বছর ধরে প্রায় দেড় লাখ
শিক্ষক বেগার দিয়ে যাচ্ছেন। হিসাব বেরিয়েছে, সব স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা
এমপিওভুক্ত করতে সরকারের দরকার মাত্র ১৩০০ কোটি টাকা। খাজাঞ্চি তো শূন্য
নয়, তবুও শিক্ষকের মজুরি দিতে এত কার্পণ্য কেন? শিক্ষকদের অভিভাবক
শিক্ষামন্ত্রী বেজায় গোস্বা শিক্ষকদের ওপর। কেবল তারাই নাকি দেশের শিক্ষার
বারোটা বাজানোর জন্য দায়ী। তাই অনশনরত শিক্ষকেরা তার দেয়া আশ্বাস মিথ্যা
বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, একজন শিক্ষিকা বলছেন,
তার সন্তান তাকে বলেছে চাকরি ছেড়ে দিতে। তাহলে সন্তান মা-বাবার অন্তত
সান্নিধ্যটুকু পেত। এ হলো সেই প্রাচীন আরব্য গল্প, মা হাঁড়িতে শুধু পানি
গরম করে ক্ষুধার্ত শিশুকে প্রবোধ দিচ্ছে, ‘এই তো খাবার তৈরি হলো বলে। আর
একটু সবুর করো, বাবা।’ কিন্তু কত কাল এভাবে দেশের দেড় লাখ বাবা-মা,
স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন আপন আত্মজাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দেবে? অশিক্ষা
অন্ধকারে মোড়া হলেও তার হয়তো শেষ আছে। কিন্তু কুশিক্ষা ভয়ঙ্কর। তা গোটা
সমাজকেই গিলে খায়। বইয়ের বোঝা বাড়িয়ে, পরীক্ষার হিমালয় পর্বত চাপিয়ে,
প্রশ্ন ফাঁস করে, পরীক্ষার হলে উত্তর বলে দিয়ে, ভালো ফল দেখাতে বেশি বশি
নম্বর দিয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের অশিক্ষা থেকে মুক্তি দেয়া দূরে থাক, কোন
অধিকারে তাদের কুশিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি? কোন অধিকারে আমরা শিশুদের অনৈতিক কাজে
অভ্যস্ত করছি? দুনিয়ার সেরা ট্র্যাজেডি হিসেবে স্বীকৃত সোফোক্লিসের ইদিপাস
নাটক। সে নাটকের মূল উপজীব্য, কার পাপে দেশে এমন মড়ক লাগল? ত্রিকালদর্শী
টিরেসাস যখন বললেন, সে পাপ স্বয়ং রাজা ইদিপাসের, তখন রাজা শুধু রুষ্টই
হননি, তিনি টিরেসাসকে বিদ্রুপ করছেন, ক্ষমতা প্রদর্শনেও কুণ্ঠা নেই তার।
কিন্তু পুরো ইতিহাস যখন জানা গেল, কেবল তখনই স্পষ্ট হলো, রাজা ইদিপাস কী কী
পাপ করেছেন। সে গল্প সবাই জানেন। এ নিয়ে বেশি কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন।
কিন্তু যেটা বলা দরকার তা হলো, মাছ পচে মাথা থেকেই। পচতে পচতে তার হাড়গোড়েও
পচন ধরেছে। আমাদের দেশেও লোককথা হলো, ‘রাজার পুণ্যে প্রজার সুখ’। শাসক
হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, প্রশাসক বা অভিভাবক হিসেবে এ পাপ আমাদের সবার।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি,
“ঘোর অন্ধকারে।
যত দুঃখ পৃথিবীর, যত পাপ, যত অমঙ্গল,
যত অশ্রুজল,
যত হিংসা হলাহল,
সমস্ত উঠিছে তরঙ্গিয়া,
কূল উল্লঙ্ঘিয়া,
ঊর্ধ্ব আকাশেরে ব্যঙ্গ করি।
তবু বেয়ে তরী
সব ঠেলে হতে হবে পার,
কানে নিয়ে নিখিলের হাহাকার,
শিরে লয়ে উন্মত্ত দুর্দিন,
চিত্তে নিয়ে আশা অন্তহীন,
হে নির্ভীক, দুঃখ অভিহত।
ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি। মাথা করো নত।
এ আমার, এ তোমার পাপ।”
কিন্তু আমাদের সম্মিলিত পাপের বোঝা কেন বইবে অপাপবিদ্ধ শিশু?
সবাই জেনে গেছে, এই সর্বনাশের নাটের গুরু অসৎ রাজনীতিক, লোভী ব্যবসায়ী আর চাণক্য আমলার এক নষ্ট চক্র। এই চক্র ভাঙতে না পারলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, যশোর
amirulkhan7@gmail.com
“ঘোর অন্ধকারে।
যত দুঃখ পৃথিবীর, যত পাপ, যত অমঙ্গল,
যত অশ্রুজল,
যত হিংসা হলাহল,
সমস্ত উঠিছে তরঙ্গিয়া,
কূল উল্লঙ্ঘিয়া,
ঊর্ধ্ব আকাশেরে ব্যঙ্গ করি।
তবু বেয়ে তরী
সব ঠেলে হতে হবে পার,
কানে নিয়ে নিখিলের হাহাকার,
শিরে লয়ে উন্মত্ত দুর্দিন,
চিত্তে নিয়ে আশা অন্তহীন,
হে নির্ভীক, দুঃখ অভিহত।
ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি। মাথা করো নত।
এ আমার, এ তোমার পাপ।”
কিন্তু আমাদের সম্মিলিত পাপের বোঝা কেন বইবে অপাপবিদ্ধ শিশু?
সবাই জেনে গেছে, এই সর্বনাশের নাটের গুরু অসৎ রাজনীতিক, লোভী ব্যবসায়ী আর চাণক্য আমলার এক নষ্ট চক্র। এই চক্র ভাঙতে না পারলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, যশোর
amirulkhan7@gmail.com
No comments