ন্যায়বিচার, অবিচার ও রাজনীতি by কামাল আহমেদ
পুলিশের
ওপর হামলার ঘটনা যে বিএনপির জন্য ভালো হয়নি সে কথা দলটির নেতারাও স্বীকার
করছেনপুলিশের ওপর হামলার ঘটনা যে বিএনপির জন্য ভালো হয়নি সে কথা দলটির
নেতারাও স্বীকার করছেনস্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সম্ভবত এই প্রথম এমন একটি
মামলার রায় হতে যাচ্ছে, রাজনীতিতে যার প্রভাব বহুদিন ধরেই অনুভূত হবে।
রাজনীতিকদের জবাবদিহি ও বিচারের ভার জনতার আদালতে বলে একটি কথা বহুল
প্রচলিত। কিন্তু আইনের আদালতেও যে অপরাধের জবাবদিহির বিষয় আছে, সে কথা
অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি
সময়ের রাজনীতি যে দুজন নেত্রীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে, তাঁদেরই একজন, দশ বছর
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী এবং অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হলেন ওই মামলার প্রধান অভিযুক্ত। এই মামলা নিয়েও
রাজনীতির অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এবং বিরোধী দল যতটা না উত্তাপ তৈরি করতে
পেরেছে, তার চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা করেছে অনেক বেশি।
দেশে যখন রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু ছিল, তখন বেআইনিভাবে ক্ষমতা
দখল করে সরকার পরিচালনায় দুর্নীতির জন্য এর আগে আরেকটি রাজনৈতিক দলের
প্রধানকেও আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং তিনি দণ্ডিতও হয়েছেন।
কিন্তু সাবেক সামরিক শাসক ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক এরশাদের বিচার ও রায় নিয়ে
তেমন কোনো রাজনৈতিক উত্তাপ ছিল না। অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলকারী সাবেক ওই
সেনাশাসক ক্ষমতা ও অর্থের যতটা অপব্যবহার করেছেন, সেই তুলনায় তাঁর প্রাপ্য
বিচার এখনো হয়নি এবং তাঁর জীবদ্দশায় যে সেগুলো সম্পন্ন হবে, তেমন
সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বরং প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রের প্রতি
আস্থায় ঘাটতির সুযোগ নিয়ে তিনি গাছেরও খাচ্ছেন, তলারও কুড়াচ্ছেন। হত্যার
মতো গুরুতর অপরাধের মামলায় তাঁর বিচার শেষ হয়েও হয় না। তবে ৮ ফেব্রুয়ারি
রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ খালেদা জিয়ার যে মামলাকে নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি
হচ্ছে, সেটি তৈরিতে তাঁর ও তাঁর দলের উৎসাহে কোনো ঘাটতি নেই। তাঁর
সহযোগীদের একজন প্রতিমন্ত্রী, মসিউর রহমান রায় ঘোষণার তারিখ ঠিক হওয়ার আগেই
জনবক্তৃতায় বলেছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই খালেদা জিয়াকে জেলের ভাত খেতে
হবে। তিনি নিজেও খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমাকে আপনারা জেলে
পাঠিয়েছিলেন, এখন জেল আপনার খুবই সন্নিকটে।’ সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির এই
উৎসাহের সঙ্গে অবশ্য সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের
বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের প্রকাশিত উচ্ছ্বাসের কোনো তুলনা চলে না।
গৃহায়ণমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন মামলার রায়ের এক দিন আগে, অর্থাৎ ৭ ফেব্রুয়ারি
থেকেই দলীয় নেতা-কর্মীদের রাস্তা দখল নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘এতিমের
টাকা মেরে খাওয়ার জন্য’ খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে ঢাকা শহরের দেয়ালে
দেয়ালে পোস্টার পড়েছে। পোস্টারের ভাষা এবং মন্ত্রীদের কথায় খালেদা জিয়াকে
ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এখন তাই তাঁদের দাবিটা সর্বোচ্চ সাজার।
মামলার বিষয়ে বিএনপিও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে পিছিয়ে নেই। দলের নেতারা
৮ তারিখে দলের নেতা-কর্মীদের রাজপথে নামার নির্দেশনা দিয়েছেন। খালেদা
জিয়ার আদালতে যাওয়া-আসার সময় শত শত নেতা-কর্মী দল বেঁধে যেভাবে তাঁকে
অনুসরণ করেন, তাতে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্য থাকে।
গ্রেপ্তার-মামলা-হয়রানির পরও যে দল বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এবং তাঁদের নেত্রী যে
একা নন, সেটি বোঝানোর চেষ্টাতেই তাঁদের এই দলীয় রুটিন। এই কর্মসূচির সময়ই
গত সপ্তাহে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের যে হাঙ্গামা হয়, সেটিও এই
উত্তেজনা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল পুলিশের
ওপর হামলাকারীরা দলের কেউ নন বললেও তাঁর সহযোগী রিজভী বলেছেন উল্টো কথা।
তবে পুলিশের ওপর হামলাকারীরা বিএনপির হোক অথবা অন্য কোনো অন্তর্ঘাতক হোক,
পরিণতিটা দলটির জন্য যে ভালো হয়নি সে কথা তাঁরাও স্বীকার করছেন। দলটি তার
জাতীয় কমিটির সভা আয়োজনেও বাধার মুখে পড়েছে। দলটির সভা আয়োজনে এ ধরনের বাধা
সৃষ্টিতেও রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয়
ব্যক্তিদের বিচারের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত এবং কষ্টকর। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে
মানবতাবিরোধী অপরাধ করার দায়ে যাঁদের বিচার হয়েছে, তাঁদের কথা এখানে স্মরণ
করা যেতে পারে। শুধু সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে যত প্রাণহানি এবং
সম্পদনাশের ঘটনা ঘটেছে, তা রীতিমতো একটি দুঃস্বপ্নের বিষয়। এ রকম অপ্রীতিকর
পরিস্থিতি এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রস্তুতি স্বাভাবিক এবং
প্রত্যাশিত বিষয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের রাজপথ দখলে রাখার প্রস্তুতি মোটেও
স্বাভাবিক নয়। বরং তাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই প্রতিফলিত হয়। খালেদা জিয়ার
বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা তিন ডজনের বেশি। দুর্নীতির মামলা ১০ টির মতো,
বাকিগুলো হত্যা ও নাশকতার হুকুমদাতা হিসেবে অভিযোগ। দুর্নীতির মামলাগুলোর
মধ্যে বিস্ময়করভাবে সবচেয়ে কম আর্থিক মূল্য যে অভিযোগের, সেটিই হচ্ছে জিয়া
অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। শতকোটি টাকার দুর্নীতির মামলা রেখে এই মামলাটি কেন
অগ্রাধিকার পেল, সেই প্রশ্নটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার
বিচার চেয়ে পোস্টার পড়েছে। ভোটের রাজনীতিতে এটা চলবে ভালো। মামলায় দোষী
অথবা নির্দোষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ও এখতিয়ার একান্তভাবেই আদালতের।
গণমাধ্যমে এসব অভিযোগের সত্যাসত্য, সাক্ষ্য-প্রমাণের গুণাগুণ বা
বিশ্বাসযোগ্যতার বিচার একেবারেই অনুচিত। সুতরাং, সেসব দিক আমি সচেতনভাবে
পরিহার করে এই মামলার রাজনৈতিক বিতর্কের দিকটিতেই আলোচনা সীমিত রাখব।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে দলের অনুসারী এবং আইন পেশায় শীর্ষস্থানীয়
সাত-আটজন মামলাটিতে অভিযুক্তের পক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তারপর
খালেদা জিয়া নিজেও কয়েক দিন ধরে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন, যার অনেকটাই
রাজনৈতিক। আদালতে তিনি বলেছেন, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-০৮)
সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীকে নাজেহাল করে তাঁদের উৎখাত করতে ‘মাইনাস টু’
ফর্মুলা বাস্তবায়নের জন্য অনেকগুলো মামলা দায়ের করে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে
মামলাগুলো তাঁর ভাষায় ‘জাদুর বলে’ বাতিল হয়েছে উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন,
একই ধরনের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বিচারাধীন এই মামলাও নিষ্পত্তিতে তাড়াহুড়া
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আদালতে তিনি যেভাবে বৈপরীত্য বোঝানোর চেষ্টা
করেছেন, কূটনীতিকদের কাছেও সেই একই বার্তা দেওয়া হয়েছে। মামলায় আত্মপক্ষ
সমর্থনে খালেদা জিয়া তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলাটিকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে
তুলে ধরার চেষ্টায় কতটা সফল হয়েছেন বলা মুশকিল। কিন্তু গত কয়েক দিনে
ক্ষমতাসীন দল ও তাঁর সহযোগীদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও কার্যক্রমে মামলাটির ওপর
যে অনেক বেশি রাজনৈতিক রং পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এ ধরনের রাজনৈতিক
বিতর্কে কে বেশি লাভবান হবেন, সে বিষয়েও ইতিমধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
রাজনীতিকদের জন্য ক্ষমতার আসন এবং কারাগারের মধ্যকার দূরত্ব খুব সামান্যই।
আবার ছোটখাটো দুর্নীতির অভিযোগে জেল খেটে রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি বা ইমেজ
বাড়ার নজিরও কম নেই। দণ্ডিত হওয়ার পর আপিল প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে
অংশগ্রহণ এবং জোরেশোরে রাজনীতি করার দৃষ্টান্ত বর্তমান ক্ষমতাসীন দলেও
অনেক আছে। অনেকেই তাই বলছেন যে খালেদা জিয়া এই মামলায় খালাস পেলে যেমন
রাজনৈতিক হয়রানির দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে, তেমনি দণ্ডিত হলে ন্যায়বিচার
না পাওয়ার দাবিতে তাঁর অনুসারীরা আরও সংগঠিত হবেন। প্রায় বারো বছর ক্ষমতার
বাইরে থাকার সময় বিএনপিকে ভাঙার একাধিক চেষ্টা ব্যর্থ হলেও ক্ষমতাসীন
জোটের একাংশের ধারণা, এবার দল ভাঙা ত্বরান্বিত হবে। বিশেষ করে জোটের সহযোগী
সাবেক সেনাশাসক জেনারেল এরশাদের আশা, বিএনপি দুর্বল হলে তাঁর দল লাভবান
হবে এবং আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে পারবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য এবং
অংশীদারত্বের সমসাময়িক ইতিহাসের পটভূমিতে তাঁর এই আশা দুরাশাই রয়ে যাবে বলে
মনে হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ যে এখনো বিএনপি, সেটি অনুধাবন করার কারণেই
সম্ভবত খালেদা জিয়ার মামলা ঘিরে এত রাজনৈতিক উত্তেজনা। দুর্ভাগ্যের বিষয়
হলো, এ ধরনের উত্তেজনায় ন্যায়বিচার বা অবিচার বড় না হয়ে রাজনীতিটাই বড় হয়ে
দেখা দেয়।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক
No comments