সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনই সময় by শিশির ভট্টাচার্য্য
২০২৪
সালের আগেই নাকি বাংলাদেশের কপালে উন্নত দেশের তকমা লাগতে যাচ্ছে। প্রশ্ন
হচ্ছে: রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের সমাধান না করে কোনো জাতি কি কখনো উন্নত হতে
পেরেছে? কাগজে-কলমে বাংলা তো বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষাই। কিন্তু কাজির গরু
কাগজে আছে, গোয়ালে নেই। যদিও আমলাতন্ত্রে এবং নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার
ব্যবহার বেড়েছে, কিন্তু সরকার ও জনগণের পছন্দের ভাষা যে বাংলা নয়, তা
বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণের প্রবণতাতেই প্রকাশ
পাচ্ছে। একটি বিভাগীয় ক্রিকেট দলের নামও বাংলায় রাখা হয়নি। অধিকাংশ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং একাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার
মাধ্যম ইংরেজি। শিক্ষা, ব্যবসা, বিচারব্যবস্থা, দেশরক্ষাসহ রাষ্ট্রের
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা এখন পর্যন্ত যোগাযোগের বাধ্যতামূলক মাধ্যম হিসেবে
ব্যবহৃত হচ্ছে না। অনেকে এই যুক্তি দিতে পারেন যে আফ্রিকার যেসব দেশের
রাষ্ট্রভাষা ফরাসি বা ইংরেজি, সেখানে কি উন্নয়ন হচ্ছে না? প্রথমত, উন্নয়ন
টেকসই হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটা বোঝা যাবে আরও কয়েক দশক পরে। দ্বিতীয়ত,
আফ্রিকার একাধিক দেশের আর বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি এক নয়। আফ্রিকার
দেশগুলো ইংরেজি বা ফরাসিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছে বাধ্য হয়ে।
কারণ, সবার কাছে বোধগম্য এমন কোনো ভাষাগোষ্ঠী বিভাজিত আফ্রিকার দেশগুলোতে
নেই। এসব দেশে যারা ফরাসি বা ইংরেজি শিখেছে, উন্নয়নের ননিটুকু তারাই খেয়ে
নিচ্ছে। কেউ খাবে তো কেউ খাবে না-এটা কখনোই টেকসই উন্নয়নের মডেল হতে পারে
না। এর ফলে আফ্রিকার সমাজে অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে; অসন্তোষ থেকে অস্থিরতা,
গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাস, বোকো হারামের জঙ্গি হাঙ্গামা। প্রথমত, বাংলাদেশের
জনগণের প্রায় শতভাগ রাষ্ট্রভাষা বাংলা ব্যবহার করে। এ পরিস্থিতিতে বাংলা
কেন বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে ব্যবহৃত হবে না? দ্বিতীয়ত,
ইংরেজিকে অবলম্বন করে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন সাধন আদৌ কি সম্ভব? ইংরেজি
শিখতে গিয়ে বাংলায় দুর্বল হয়ে বাঙালিরা একেকজন দ্বিভাষী নয়, অর্ধভাষী হয়ে
উঠবে-এমন আশঙ্কাই প্রবল। সুতরাং বাংলার দিকেই ঝুঁকতে হবে আমাদের, একান্ত
বাধ্য হয়ে। এই সিদ্ধান্ত যত দেরিতে নেওয়া হবে, উন্নয়নও তত দেরিতে হবে। ভাষা
পরিস্থিতির অপরিহার্য প্রভাবে বাংলা আগে-পরে বাংলাদেশের একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠবেই, অনেকটা ইংরেজি যেভাবে ফরাসিকে হটিয়ে ইংল্যান্ডের
রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠেছিল। অতীতে যেসব দেশ জ্ঞানচর্চায় বিনিয়োগ করেছে, শুধু
সেই দেশগুলোই উন্নত হয়েছে। জ্ঞানচর্চা শতভাগ ভাষানির্ভর। আমরা যদি
পরনির্ভরতা কমাতে জ্ঞানভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন চাই, তবে আমাদের সিদ্ধান্ত
নিতে হবে, শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যম কী হবে। অতীতে গ্রিক, রোমান,
ভারতীয়, ইংরেজ ও রুশরা যখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির শীর্ষে উঠতে
যাচ্ছিল, তখন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? রাশিয়ায়
দীর্ঘদিন রুশের তুলনায় ফরাসির গ্রহণযোগ্যতা বেশি ছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর
অপেক্ষাকৃত দুর্বল রুশকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।
চীনা ভাষার অন্তত দশটি উপভাষা ছিল, এখনো আছে। কিন্তু বিপ্লবের পর থেকে
ম্যান্ডারিনকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে। যখনই কোনো
জাতি অন্যদের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেই জাতি নিজের
রাষ্ট্রভাষাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। ইতিহাসের বিভিন্ন
পর্যায়ে গ্রিকেরা গ্রিক, রোমানরা ল্যাটিন, ভারতীয়রা সংস্কৃত, আরবরা আরবি
এবং ইংরেজরা ইংরেজি ভাষাকে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা করে তুলতে সমর্থ হয়েছে।
অস্ত্র দিয়ে দেশ জয় করা যায়, কিন্তু সেই জয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একমাত্র
ভাষাগত বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হয়। ভাষা এমন একটি অস্ত্র, যেটি যত বেশি লোকের
দখলে থাকে, ততই তার ক্ষমতা বেড়ে যায়। যখন থেকে নিজেদের অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে, তখন থেকে চীনারা গ্রিক, রোমান ও ইংরেজ
উপনিবেশকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সারা পৃথিবীতে চীনা ভাষা শিক্ষা দিতে উঠেপড়ে
লেগেছে। সর্বত্র কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট খোলা হচ্ছে। কোটি কোটি ইউয়ান বৃত্তি
দিয়ে সারা পৃথিবীর তরুণদের চীন দেশে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে চীনা ভাষা
শিখতে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা বাংলা ভাষা শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করছি।
বিদেশিদের পক্ষে বাংলাদেশে এসে (ধরা যাক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে) বাংলা
শেখার জন্য প্রয়োজনীয় ভিসা বা অনাপত্তি সনদ জোগাড় করা সহজ নয়।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রায়ই তাঁদের হাতে আসে না
বলে অনেক সময় পরীক্ষা না দিয়েই বাংলাদেশ ছাড়তে হয় তাঁদের। এই সব ঝামেলা
এড়াতে বাংলা শিখতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে না এসে যান পশ্চিমবঙ্গে।
ভাষা বা জ্ঞানগত উন্নয়নের সঙ্গে ভৌত উন্নয়নের তফাত আছে। বিদেশি কোনো
কোম্পানিকে দিয়ে রাস্তাঘাট, ভবন বা নগরের উন্নয়ন করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু
ভাষা বা জ্ঞানগত উন্নয়ন সাধন করতে হলে কোনো জনগোষ্ঠীর কয়েক দশকের নিরলস
প্রস্তুতি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে
সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি, সে দেশে জ্ঞানগত উন্নয়নের
আকাশকুসুম স্বপ্ন না দেখাই শ্রেয়। সরকার সম্প্রতি বাংলা ভাষার উন্নয়নের
জন্য প্রায় ১৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এ অর্থ ব্যয় করার উদ্দেশ্যে যে
প্রকল্পগুলো বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল হাতে নিয়েছে, সেগুলো সম্পাদন করার
উপযুক্ত ভাষাবিজ্ঞানী বাংলাদেশে নেই। যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভাষা গবেষক
সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল-যেমন বাংলা একাডেমি, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
ইনস্টিটিউট-দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য যে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের
কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কী করণীয় হওয়া উচিত,
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই।
শিশির ভট্টাচার্য্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক
শিশির ভট্টাচার্য্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক
No comments