ধর্ষণের শিকারকে বিশ্বাস করবেন না কেন?
খবর
পেলাম, রাজধানীতে আরেক হোটেলে ঘটেছে আরেক দলবদ্ধ ধর্ষণ। এবারও জন্মদিনের
দাওয়াত দিয়ে এক নারীকে ধর্ষণ করলেন দুই বন্ধু মিলে। এ রকম ঘটনা গতবার
রেইনট্রি হোটেলে যখন ঘটেছিল, তখন মামলা নিতে চাননি পুলিশ কর্মকর্তা। এবার
নিয়েছেন। আমাকে এটা মনে করাল ব্যান্ডুরার ‘সোশ্যাল লার্নিং’ তত্ত্বের কথা।
ব্যান্ডুরা প্রথম বলেছিলেন, আমাদের সামাজিক পরিবেশ দ্বারা আমরা প্রভাবিত
হই। এই দুই বন্ধু আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলের থেকে কী শিখেছেন, সেটা
দেখার আর বাকি নেই। অবাক হওয়ার বিষয় একটিই, ওই রেইনট্রির ধর্ষকদের পরিণতি
দেখেও তাঁরা দ্বিধা বোধ করেননি। কেন করেননি, সে প্রশ্ন আজকে থাক। অন্যদিকে,
যিনি এর শিকার হয়েছেন, তিনিও শিখেছেন ধর্ষণের শিকার হলে পুলিশের কাছে
যাওয়া যায়। পুলিশ মশাইও শিখেছে, মামলা কীভাবে গ্রহণ করতে হয়। এটাকে হয়তো
অনেকে অগ্রগতি বলবেন। বলতেই পারেন। তার সঙ্গে মনে করিয়ে দিল আমার নিজের
গবেষণার কথা। আমার গবেষণার একটা ধারা নারী নির্যাতন নিয়ে। আমি আরেকজন
গবেষকের সঙ্গে সম্প্রতি একটা কাজ শেষ করেছি। সেখানে বিভিন্ন ধরনের অঙ্ক করে
আমরা দেখিয়েছি, বাংলাদেশে যেসব নারী নির্যাতিত বা ধর্ষণের শিকার হন,
তাঁদের মানসিক রোগ হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। তাহলে কি সদ্য
ধর্ষণের শিকার এই নারীর মানসিক রোগ হওয়া ছাড়া উপায় নেই? আমার গবেষণার কাজ
দিয়েই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। এই গবেষণার ভিত্তিতে যে নিপীড়ন আর মানসিক
রোগের মধ্যে সংযোগ পেলাম, সেটার সূত্র ধরে আমি কিছু নারীর সঙ্গে বিস্তারিত
কথা বলেছি। তাঁদের থেকে জানতে চেয়েছি তাঁদের জীবনের কথা, নিপীড়নের কথা,
মানসিক অবস্থার কথা। অনেকেই বলেছেন তাঁদের স্বামী বা প্রেমিক দ্বারা
নির্যাতিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে আমরা
জানি, নারীদের স্বামী বা প্রেমিক দ্বারা নির্যাতনের হার প্রায় ৮০ শতাংশ।
নির্যাতিত নারীরা সরাসরি এসব বলছেন, এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিথির (নাম
পাল্টানো হয়েছে নিরাপত্তার কারণে) উদাহরণ দিয়ে বোঝাই ব্যাপারটা।
তিথির
কথায়: ‘আমার আগের এক জীবনে আমি বীভৎস এক লোকের প্রেমে পড়ে তাঁকে বিয়ে
করেছিলাম। সে নানান কারণবশত আমাকে মারধর করত, মানসিক নির্যাতন করত,
গালাগালি করত, নানানভাবে জোর খাটাত। বলত, এসব নিপীড়নের কথা কাউকে জানালে সে
আমার নামে এমন সব কথা বলবে, তাতে আমার মানসম্মান বলে কিছু বাকি থাকবে না।
বাংলাদেশের যেকোনো মেয়ের জন্য এটা খুব বড় একটা হুমকি। চুন থেকে পান খসলেই
যা হয় আমাদের দেশে, কেউ আগ বাড়িয়ে বরবাদ করার চেষ্টা করলে তো শেষ হয়ে যেতে
হবে। কিন্তু আমার পক্ষে মুখ বন্ধ করে থাকা সম্ভব হয়নি। যখন জীবনটাই
ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে, তখন মানুষ কী বলবে, সেটা নিয়ে আর ভাবা যায় না। তাই তার
সেই কুৎসা রটানোর হুমকি যখন বাস্তবায়ন করা হলো, নানান ধরনের হুমকির চাপে
আমার নিজেকে বন্দী করে রাখতে হলো। আর মানুষের কথা কী বলব! তাঁরা যার যার
মনের মতো ভেবে নিয়েছেন। তাঁরা হয়তো আমাকে গালমন্দ করে নিজেদের জীবনকে আরও
সহনীয় মনে করেছেন, নৈতিক শ্রেষ্ঠতা আদায় করেছেন, নিজের কাছেই। আমাদের তো
এসব খুব পছন্দ—অন্যের দুঃখ যেন নিজের সুখ।’ একসময় ছিল—যখন এ ধরনের কথা
নারীরা ভাবতেন, তাঁদের একান্ত কথা বাইরে বলা যাবে না। অনেকে এখনো বলেন না।
হয়তো অচেনা মানুষকে এসব বলা সহজ। তাই আমরা গবেষকেরা জানতে পারি, কত বীভৎস
হতে পারে মানুষ, তাও আবার ভালোবাসার নামে। এমন না যে আমি জানতাম না, আমার
জীবনেও এ রকম ঘটনা আছে, কিন্তু গবেষণা করতে গিয়ে বুঝলাম, এ রকম নিপীড়নের
প্রাদুর্ভাব কত ব্যাপক। কত হাজার হাজার মানুষ নিপীড়িত হয়েছেন, হয়ে থাকেন
প্রতিদিন। আমি আমার জীবনে এখন এমন জায়গায় এসেছি, আমি মনে করি, সব মানুষের
মানসিক বা শারীরিক আঘাতের ইতিহাস (trauma history) আছে, সবাই আক্রান্ত
হয়েছেন কারও না কারও হিংস্র ব্যবহারে। সবাই কিছু না কিছু নেতিবাচক আচরণ
থেকে শুরু করে নিপীড়নের পর্যায় পড়ে—এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন। এবং অনেকে অনেক
কিছু লুকিয়ে রাখেন, রাখতে হয়। সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের
মতো আমারও বলতে হয়, মানুষের তিন রকম জীবন আছে: প্রকাশ্য, ব্যক্তিগত ও গোপন।
তাই সবার পক্ষে জানা সম্ভব না কার জীবনে কী ঘটনা ঘটেছে। আর আমরা জানি আর
না জানি, আঘাত পাওয়ার মানসিক প্রতিফলন নিশ্চয়ই আছে, থাকা স্বাভাবিক। যেমন
ধরুন, অনেকেই বলতে চান না ছোটবেলার জঘন্য সেই আত্মীয়ের কথা, যিনি সবার গায়ে
হাত দিতেন। অনেকেই বলেন না তাঁদের নিজ মা-বাবার হাতে নির্মমভাবে মার
খাওয়ার কথা। বলেন না তাঁদের মায়েদের মার খেতে দেখার কথা। বলেন না সেসব দেখে
নিজের জীবনের নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে হওয়ার কথা। অনেকে হয়তো বোঝেন না যে
এসব ঘটনা একটার সঙ্গে আরেকটা সংশ্লিষ্ট। কিন্তু না বুঝলেই কি তা অসত্য হয়ে
যায়? তাই আমার মানতেই হবে, আমাকে নির্যাতনের শিকার যেসব নারী তাঁদের সব
কথা খুলে বলেছেন, তা তাঁদের জীবনের সব কথা নয়। আমাকে যা বলা হয়, এবং যা বলা
হয় না, দুটো থেকেই আমি অনেক কিছু জানতে পারি। তার মধ্যে লক্ষণীয় বিষয় হলো,
আমাদের অঙ্ক করে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলেছে আমার নিজে সাক্ষাৎকার করে দেখা
তথ্য। অনেকের মধ্যে আমি একধরনের মানসিক চাপ বা বিষণ্নতার লক্ষণ খেয়াল
করেছি। লক্ষ করেছি নিজেদের দায়ী করার প্রবণতা। আজকাল যেভাবে সেলফ-হেল্প বা
নিজেকে সাহায্য করার জন্য বই লেখা হয়, মনে হয় আমরা নিজেরাই নিজেদের সব
ধরনের সমস্যা সমাধান করতে পারব।
সেটা করতে পারার প্রথম পদক্ষেপ হলো সব দোষ
নিজের ঘাড়ে নেওয়া। কিন্তু এটা কি অপরের দ্বারা নির্যাতিতের আবার নিজেকেই
নির্যাতিত করার মতো নয়? নিজেকে দোষ দিতে দিতে হয়তো সেখানে আমরা অনেকেই
পৌঁছে গিয়েছি। তবে এটাও সত্যি, অনেকেই এমনটি বললেও সবাই তা বলেননি। তিথির
কারণ তাঁর সাবেক প্রেমিকের নির্যাতন। অবশ্য তিথি (এবং তাঁর মতো অনেকেই)
এটাকে বিষণ্নতার লেন্স দিয়ে দেখছেন না, তাঁকে আমার বিষণ্ন মনেও হয়নি। কারণ,
তাঁরা তাঁদের মানসিক অবস্থার কারণ শনাক্ত করতে পারছেন, সেটাকে অতিরিক্ত
মাত্রায় ব্যক্তিগত করছেন না, নিজের হাজারটা দোষ তুলে ধরছেন না। এমনকি
কপালের দোষও দিচ্ছেন না। তাঁরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন তাঁদের মানসিক চাপ
কাঠামোগতভাবে তৈরি হয়েছে। এবং সেই কারণেই, আমার ধারণা, সেটা মানসিক রোগে
রূপান্তরিত হচ্ছে না। তবে তাহলে আমরা কি বলতে পারি, মানসিক রোগ হওয়ার
আশঙ্কা নির্ভর করে আমরা পৃথিবীকে কীভাবে দেখছি তার ওপর? আমরা কি বলতে পারি,
তিথির মতো আমরা আমাদের সমস্যার কারণ শনাক্ত করতে পারলে আমাদের মানসিক চাপ
কমবে? হয়তো। আরও গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। আরও জানার বিষয় আছে। জানার
দরকারও আছে। না জানতে পারলে আমাদের সবার হয়ে যেতে হবে ওঁদের মতো, যারা কেমন
উদাস, যেন পৃথিবীতে কিছুই আসে-যায় না। সম্প্রতি ধর্ষণের শিকার এই নারীর
কী হবে, আমরা জানি না। তবে এটা জানি, তাঁর মানসিক রোগ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই
যায়। তাঁকে সাহায্য করার উপায় অবশ্য আমাদের আছে। তাঁর সমালোচনা না করে আমরা
তাঁকে একটু হলেও শান্তি দিতে পারি। আমাদের উচিত হবে তাঁকে (বা যেকোনো
ধর্ষণের শিকার নারীকে) অবান্তর প্রশ্ন না করা। তিনি কেন ওই লোকের মনে কী
ছিল তা বুঝতে পারেননি, সেটা নিয়ে প্রশ্ন না করলেও খুব ভালো হয়। আরও ভালো
হয়, তাঁর পোশাক কী ছিল, সে ধরনের প্রশ্ন না তোলা। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা
তাঁর কথা বিশ্বাস করি। উনি কারোর মা-বোন বলে নয়, তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘন
হয়েছে, তিনি দোষ করেননি, অপরের দোষের ভুক্তভোগী তিনি। আমাদের মনে রাখতে
হবে, একজনের ওপর করা অবিচার আসলে জনগণের জন্যই অবিচার।
নাদিন শান্তা মুরশিদ: সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফালো, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক
নাদিন শান্তা মুরশিদ: সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফালো, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক
No comments