প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক কাম্য নয় by আবদুল লতিফ মন্ডল

সম্প্রতি বাংলাদেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পেয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ফলে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক এবং গত ১০ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এসকে সিনহা) পদত্যাগের পর অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগে তার জুনিয়র কর্তৃক অতিক্রান্ত হন। মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আপিল বিভাগের বিচারকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, দেশের ইতিহাসে এসকে সিনহা হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন। প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ প্রদানে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এটা যার যার নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও মূল্যবোধের বিষয়। অতীতেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়েছে। যাদের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পদে থেকেছেন, বিচার কাজ পরিচালনা করেছেন। আবার কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন সব সময়ই এর বিরুদ্ধে। অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাবেন- এমনটাই তাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে’ নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগকে তিনি স্বাগত জানাচ্ছেন। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতে, প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ প্রদানে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন কখনও বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণ করাই প্রত্যাশিত ছিল, কারণ তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের এক বছরেরও কম সময়ে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদে গৃহীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (অতঃপর মূল সংবিধান নামে অভিহিত), যা ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বলবৎ হয়। এ সংবিধানের ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’ ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গৃহীত চতুর্থ সংশোধনীতে সংসদের সুপারিশ বাদ দিয়ে সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিচারককে অপসারণের ক্ষমতা এককভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বিচারক অপসারণে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা রহিত করে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিমকোর্টের দু’জন জ্যেষ্ঠ বিচারকের সমন্বয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান করেন। এতে বলা হয়, কাউন্সিল কোনো বিচারকের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে তদন্ত করে সুপারিশসংবলিত রিপোর্ট প্রদান করলে রাষ্ট্রপতি তদনুযায়ী আদেশ প্রদান করবেন। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক অপসারণের প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হলেও প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত বছরের ৩ জুলাই তা বাতিল করে দেন। এরপর শুরু হয় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন। সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রথমে আপিল বিভাগের রায়ের মন্তব্যগুলো বাদ দেয়ার দাবি তুললেও পরে দাবি তোলে পুরো রায় বাতিলের। অনেকে বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ছুটিতে যান সরকারের চাপে এবং ছুটিতে থাকাবস্থায় তিনি প্রধান বিচারপতি পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। তার পদত্যাগের পর অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার সময়কালে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য গত ২৪ ডিসেম্বর সরকার আপিল বিভাগে আবেদন করে। ১৯৭২ সালে গৃহীত মূল সংবিধানে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার বিধান করা হয়, যা আজ পর্যন্ত বহাল আছে। তবে ওই সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে কেবল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যসব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করার বিধান করা হয়।
অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতি নিয়োগদানে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রয়োজন হতো। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রের মতো প্রধান বিচারপতি নিয়োগেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দূরীভূত করা হয়। ইতিপূর্বে বিএনপি সরকারের আমলে নীতিনির্ধারকদের বলতে শোনা গেছে এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তাদের বলতে শোনা যাচ্ছে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। এটা ঠিক, সংবিধান [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)] প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে একক ক্ষমতা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্রপতি কি এ ক্ষমতা বাস্তবে প্রয়োগ করেন বা করতে পারেন? বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে রাষ্ট্রপতির কোনো স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা নেই। যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মান হবেন, রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদানে সাংবিধানিকভাবে [অনুচ্ছেদ ৫৬(৩)] বাধ্য। আপিল বিভাগের যে বিচারককে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগদানের জন্য সরকার সুপারিশ করে, তাকে নিয়োগদান ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর কিছুই করণীয় থাকে না। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই তার মৌখিক সম্মতিতে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগদানের জন্য সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ প্রেরণ করেন বলেই এতদিন জানা ছিল। ১৬ নভেম্বর একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সংবিধানের ৪৮(৩) নম্বর অনুচ্ছেদের বিধান অগ্রাহ্য করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের আমলে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের নথি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে যেত এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও একই নিয়ম চালু আছে। বিএনপি সরকারের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের বক্তব্য থেকে এর সত্যতা পাওয়া যায়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়েও প্রধানমন্ত্রীরা দেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। দলীয় সরকারপ্রধান বিচারপতি নিয়োগে যে দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন, তা বলাই বাহুল্য। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এবার নিয়ে তিনবার আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হল। ২০১১ সালের ১৩ মে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে জ্যেষ্ঠতা তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিচারক মো. মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হলে শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান পদত্যাগ করেন। এর আগেও ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে বিচারক এবিএম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সর্বশেষ আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে ডিঙিয়ে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি আমলে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক মো. রুহুল আমিন ও বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে যথাক্রমে বিচারক কেএম হাসান ও বিচারক সৈয়দ জেআর মোদাচ্ছির হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। এখন দেখা যাক, আমাদের পাশের দেশগুলোয় প্রধান বিচারপতি নিয়োগে কী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগদান ভারতে একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদ্দূর জানা যায়, ভারতের ইতিহাসে দু’বার অর্থাৎ ১৯৭৩ ও ১৯৭৭ সালে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭৭ সালের পরে আর ব্যত্যয় হয়নি। পাকিস্তানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। তবে ২০১০ সালে সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন একটি রুটিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীতে সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। আরও বিধান করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে (most senior Judge of the Supreme Court) প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এটা ঠিক, আমাদের সংবিধানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগদানে বিচারকদের জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায় নেয়ার ব্যাপারে কিছু বলা নেই। তবে এটাও অনস্বীকার্য, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে নিয়োগ দেয়া হলে তা প্রধান বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের অবসান হবে। সুতরাং আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ রেওয়াজে পরিণত হোক।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.