শূন্য পদে লোক নিয়োগও আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে! by মামুন-অর-রশিদ

সরকারী শূন্য পদে খুব শীঘ্রই লোক নিয়োগ দিতে পারছে না মহাজোট সরকার। প্রজাতন্ত্রের জনবল নিয়োগ জোট সমর্থিত আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
মহাজোট সরকার গত এক বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর,উপ-অধিদফতর ও প্রতিষ্ঠানে সোয়া লাখ শূন্য পদের বিপরীতে সর্বসাকল্যে সহস্র লোকও নিয়োগ দিতে পারেনি। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেও সহস্রাধিক খাদ্য পরিদর্শক পদ, কাস্টমস ইন্সপেক্টর পদ, প্রাথমিক শিৰক নিয়োগ, স্বাস্থ্যসহকারী নিয়োগ, ভূমি মন্ত্রণালয়ে এমএলএসএ নিয়োগ, বিআরডিবির থানা পলস্নীউন্নয়ন কর্মকর্তা অথবা অডিটর এবং প্রতিরৰা অডিটরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারী চাকরিতে ৫০ হাজার লোক নিয়োগ পরীৰা হয়েছে। এক বছর পার হলেও এসব পদের কোথাও কোন নিয়োগ গত এক বছরেও দেয়া সম্ভব হয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নিয়োগ প্রদানে আমলাদের আধিপত্য, মন্ত্রী আমলার মনসত্মাত্তি্বক লড়াই নিয়োগ প্রক্রিয়া ঠেলে দিয়েছে রশি টানাটানির মধ্যে। সরকারের 'মফস্বল মন্ত্রিসভার' কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে যাচ্ছে চতুর আমলাদের লালফিতার ফাইলে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সরকারী নির্বাচনী অঙ্গীকার এভাবেই চিহৃিত কিছু সংখ্যক আমলা বন্ধ করে রেখেছে। সরকারী অঙ্গীকার পূরণ ব্যর্থ করে দেয়ার এসব আমলাদের লৰ্য কিনা-সরকারের শুভাকাঙ্খী মহলে এমন প্রশ্নও উঠেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশে বর্তমান সরকারের সময়ে আমলারা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিকতর ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে।
আমলাতন্ত্রের এমন কারসাজির প্রমাণ মিলেছে বিআরডিবিতে। বিআরডিবির ঘটনায় স্থানীয় সরকার পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক যারপরনাই ৰুব্ধ। নিয়মবহিভর্ূত পরীৰা অনুষ্ঠান এবং নিয়োগদানে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে স্থানীয় সরকার পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ 'বাংলাদেশ রম্নরাল ডেভেলপমেন্ট বোর্ড' (বিআরডিবি) থানা পলস্নী উন্নয়ন কর্মকর্তা, সহকারী থানা পলস্নী উন্নয়ন কর্মকর্তা, থানা হিসাব রৰক এবং সহকারী থানা হিসাব রৰকের চারটি পদে চার শতাধিক নিয়োগ মন্ত্রণালয় থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক জনকণ্ঠকে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বিভাগীয় প্রার্থীদের যেখানে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা সেখানে তাদের পরীৰাই দিতে দেয়া হয়নি। বয়স পার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলে বিভাগীয় প্রার্থীদের পরীৰায় অংশ নিতে দেয়া হয়নি। অথচ সংশিস্নষ্ট বিভাগীয় অভ্যনত্মরীণ প্রার্থীর অনেক কর্মকর্তার বয়স পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের ইন্টারভিউ কার্ড ছাড়া হয়েছে। শুধু তাই নয়,নিয়োগ পরীৰার সঙ্গে জড়িত ও দায়িত্বশীলদের অনেকেরই পরিবারের সদস্যরা নিয়োগ পরীৰায় অংশ নিয়েছেন যা সাধারণ নিয়োগ নিয়মের পরিপন্থী। এ কারণে বিআরডিবির নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে সংশিস্নষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সরকারী অঙ্গীকার এভাবেই চিহৃিত কিছু সংখ্যক আমলা বন্ধ করে রেখেছে। অবশ্য বিআরডিবি কর্তৃপৰের পরীৰা গ্রহণের ৰেত্রে বিজ্ঞাপনের শর্ত না মেনে পরীৰা গ্রহণ করায় অভ্যনত্মরীণ প্রার্থীরা এ যাত্রা নিয়োগের বিরম্নদ্ধে করেছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিরম্নদ্ধে মামলার দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ কমবেশি সকলেরই আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত এক বছরে বিআরডিবিতে চার শতাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ পরীৰা, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ১২শ' কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ পরীৰা হয়েছে। এছাড়া কাস্টমস ইন্সপেক্টর পদে ২শ' নিয়োগ, ২শ' ২৩ অডিট ইন্সপেক্টর নিয়োগ পরীৰা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শুরম্নতেই অনুষ্ঠিত হয় সারাদেশে ৬ হাজার ৩শ' স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ পরীৰা। স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ পরীৰার এক সপ্তাহ পর অনুষ্ঠিত হয় সারাদেশে ৩০ হাজার প্রাথমিক শিৰক নিয়োগ পরীৰা। এছাড়া সারাদেশে ৪ হাজার ১শ' ৩৩ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া কাস্টমস ইন্সপেক্টর নিয়োগ, অডিট ইন্সপেক্টর নিয়োগ পরীৰা হওয়ার কথা রয়েছে কয়েক দিনের মধ্যে। গত ২৬ ফেব্রম্নয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দু'শতাধিক পদে প্রতিরৰা অডিটর নিয়োগ পরীৰা। মহাজোট সরকারের এক বছর ধরে শুধু নিয়োগ পরীৰা হচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোন রকম কাউকে নিয়োগ দেয়া হয় না।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের এই মুহূর্তের হিসাব অনুযায়ী সরকারী চাকরির ৰেত্রে সোয়া লাখ পদ খালি রয়েছে। বিএনপি জামায়াত জোট আমলে টয়লেটের কিনার পদ থেকে দারোয়ান কিংবা ঝাঁড়ুদার সকল পদেই দলীয় লোক বসিয়ে গেছে। মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর নিজেই বলেছেন, জনপ্রশাসনে এমন দলীয়করণ করে গেছে প্রশাসন চালানোই এখন দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চাকরি দেয়ার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থলেনদেনের ৰেত্রে আমলাদের চাতুর্যের কাছে এমপি-মন্ত্রীরা একের পর এক হার মানছেন। ফলে অধিকাংশ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া মাসের পর মাস ঝুলে থাকছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে আমলাতন্ত্রে দলীয়করণ করে একচেটিয়া নিয়োগ দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ কেলেঙ্কারি, জোট আমলের সব বিসিএসর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ কেলেঙ্কারি, বনখেকো ওসমানের নিয়োগসহ নানা ধরনের নিয়োগ কেলেঙ্কারি এখনও বিভিন্ন পর্যায়ের আড্ডায় মুখরোচক আলোচনার ইসু্য। প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয়ের উপ-আনুষ্ঠানিক শিৰা প্রকল্পে ১৩শ' কোটি টাকার কাজ দেশীয় এনজিওকে বণ্টনের নামে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে দলীয় লোকদের কাজ দেয়ায় বিশ্বব্যাঙ্ক অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে সরকার প্রকল্প কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
সংশিস্নষ্ট সূত্র মনে করছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মেধার ভিত্তিতে চাকরি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমলারা চাতুর্যপূর্ণ কৌশলে বিশেষ পারিতোষিকের বিনিময়েই নিজেদের খেয়াল-খুশীমতো নিয়োগ দিতে গিয়ে মন্ত্রীদের বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ঘটাচ্ছেন। এই অভিযোগ সরকারের খোদ প্রভাবশালী মন্ত্রীদের। আর এই অভিযোগের কারনেই নিয়োগ পরীৰা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ছয় মাসের বেশি সময় ধরে আটকে আছে বিআরডিবির চার শ' কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়া।
চাকরি দেয়ার ৰেত্রে এবার আর্থিক লেনদেনের গতিপথ এখন আমলামুখী। চতুর আমলার 'ফেয়ার' নিয়োগের কথা বলেই ৰমতাসীন রাজনৈতিক দলের এমপি, মন্ত্রীদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। ফলে রাজনৈতিক লবিতে কনট্রাক্ট করে চাকরি প্রত্যাশীরা খুব শীঘ্রই কোন ফল পাচ্ছেন না। তার চেয়ে বরং আমলাদের লেজ ধরেই অনেকে কাঙ্খিত চাকরি নিশ্চিত করতে পেরেছেন। সেজন্য চাকরি পাওয়ার জন্য চাকরি প্রত্যাশীদের প্রদেয় অর্থ এখন অধিকাংশ ৰেত্রে আমলামুখী। বিভিন্ন চাকরির ৰেত্রে শিৰাগত যোগ্যতাসম্পন্ন দলীয় কর্মীদের তালিকা স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীরা সংশিস্নষ্ট কর্তৃপৰকে হসত্মানত্মর করছেন সেসব তালিকার কেউই চাকরি পাচ্ছেন না। সর্বশেষ নিম্ন আদালতে ২শ'১৯ বিচারক নিয়োগের ৰেত্রে ঘটেছে এই ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ ছাত্র যারা ছাত্রলীগ কর্মী এবং লিখিত পরীৰায় পাশ করেছে। তাদের ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ ছিল। কিন্তু সরকারী সুপারিশের কারণে কারই চাকরি হয়নি বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। উল্টো রাজশাহী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নিত শিবির ক্যাডাররা নিয়োগ পেয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে আমলাতন্ত্রের হাত ধরে অর্থের লেনদেনে চাকরি হচ্ছে। তাই এবার চাকরি দেয়ার ৰেত্রে কোন দলবাজি হচ্ছে না। হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ। যা লাল ফিতার দৌরাত্ম্যই বাড়িয়ে দিয়েছে।
এবারও নিয়োগবাণিজ্যে এগিয়ে আছে আমলারা। চতুর আমলারা অনেক মন্ত্রীকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। অর্থের বিনিময়ে চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থীদের ভাষ্য, রাজনৈতিক লবিতে টাকা দিয়ে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। তাই তারা আমলাতন্ত্রের পিছনেই ছুটছেন। এৰেত্রে আমলাদের সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের সেতু বন্ধনের কাজ করছেন দায়িত্বশীল আমলাদের শ্বশুর পৰের আত্মীয়স্বজন, আমলাদের অফিসসহকারী, পিয়ন এবং ব্যক্তিগত ড্রাইভাররা।

No comments

Powered by Blogger.