সাক্ষী নিখোঁজ রহস্য-এ দুর্বলতা গ্রহণযোগ্য নয়

শুধু মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালেই নয়, দেশের প্রচলিত আইনের ক্ষেত্রেও আদালতে বিচারাধীন মামলায় সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রদান, তাঁর উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা জানি, প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত অপরাধের সাক্ষীকে যদি না পাওয়া যায় বা সাক্ষী বারবার অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে সেই মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে বিচারককে ওই অপরাধের দায়ে অভিযুক্তকে খালাস দিতে হয়। এটাই আমাদের আদালতের বিধান। কারণ বাংলাদেশের আদালতের দৃষ্টিতে একজন নাগরিক নিরপরাধ। তার অপরাধকে সাক্ষী ও যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। অথচ এই আইনি পরিবেশের মধ্যেও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলার কার্যক্রম চলাকালে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর গণহত্যা মামলার দুই সাক্ষীসহ তিনজনকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘ ২৮ দিন নিখোঁজ করে রাখে। এ চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে কালের কণ্ঠের নিজস্ব অনুসন্ধানে। যাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে একজন ঘাটারচরের গণহত্যায় শহীদের ভাই, অন্যজন শহীদজায়া। সঙ্গে তুলে নেওয়া হয় তাঁর সন্তানকে। তাঁদের চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে আরো জানা গেছে, ওই এলাকায় কেউ মুখ খুলতেও সাহস পায় না। সংবাদকর্মীরা কিছু জানতে চাইলেও মানুষ আতঙ্কিত হয়ে সরে যায়।
এই ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে যাঁরা যেভাবেই জড়িত থাকুন, তাঁদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি ছিল, বিশেষ করে সাক্ষীদের ক্ষেত্রে। কিন্তু তা হয়নি। সরকারের এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কতটা দুর্বল যে যাঁদের কাছ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছিল, তেমন দুইজন মানুষ ২৮ দিন নিখোঁজ হয়ে রইলেন, অথচ তা দেশবাসীকে জানাতে হলো সংবাদকর্মীদের। কে তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল, কোথায়, কী উদ্দেশ্যে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা জানা এখন দেশবাসীর জন্য খুবই জরুরি। যদি সরকারের লোকরা তুলে নিয়ে গিয়ে থাকে তা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, আবার এর ভেতরে আসামিপক্ষের হাত থাকলে বলতে হবে, সেটাও সরকারের দুর্বলতারই ফল। সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন, এমন ভালনারেবল পরিস্থিতি রেখেই কি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে? আমরা মনে করি, এই স্পর্শকাতর ট্রাইব্যুনালের সব মামলার সাক্ষীকে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শুধু এই ট্রাইব্যুনাল নয়, দেশের প্রচলিত আইনে আমলযোগ্য অপরাধের (কগনিজিবল অফেন্সের) প্রত্যেক সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তা না হলে বিচার সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়ায় বিঘ্ন ঘটতেই থাকবে।
ট্রাইব্যুনালে শুধু কাদের মোল্লাই নয়, আরো বেশ কয়েকজনের মামলার বিচারকাজ চলছে। এসব বিচারে সাক্ষীদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সুষ্ঠু বিচারে সন্তোষজনক রায় নাও আসতে পারে। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, মামলার যাবতীয় নিরাপত্তা বিধান ও সুচারুরূপে বিচার সম্পন্ন হতে দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদানের দায় একমাত্র সরকারের। এ ধরনের সাক্ষী গুম হয়ে থাকার ঘটনা দেশবাসীর কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
« পূর্ববর্তী সংবাদ
   
পরবর্তী সংবাদ »
মূল পাতা সম্পাদকীয়

No comments

Powered by Blogger.