'সোহরাওয়ার্দী' থেকে শাহবাগ-১৯৯২-২০১৩ : গণ-আদালত- প্রজন্ম চত্বর by আরিফুজ্জামান তুহিন
সব কিছুর মতো গণবিস্ফোরণেরও পরিপূর্ণতার
একটি মেয়াদ আছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়তো দুই দশক বা দুই যুগ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। এরপর যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিরানব্বইয়ের গণ-আদালত।
এখন ২০১৩ সালে শাহবাগ হয়ে গেল প্রজন্ম চত্বর। এবার দাবি আরো সুনির্দিষ্ট, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি।
অনেকটা রিলে রেসের মতো দায়িত্ব চলে আসে এক যুগ থেকে আরেক যুগে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। ২১ বছর আগে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, এবার পরের প্রজন্মের হাতে সেই যুদ্ধেরই চূড়ান্ত পর্বের সূচনা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে মঞ্চ সরে এলো শাহবাগে। দাবি একটাই, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। এবারের কাণ্ডারি তরুণরা। জন্ম ও অস্তিত্বের প্রশ্নে বিভ্রান্ত, বিভক্ত, পথহারা, নির্বিকার একটি জাতির দায়িত্ব নিয়ে নিল তরুণ একটি প্রজন্ম, ইন্টারনেটের অচেনা জগতের বাসিন্দা হিসেবে যাদের পরিপূর্ণতা অর্জন এত দিন ছিল সবার অলক্ষ্যে।
প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল স্বজন, সম্ভ্রম, মর্যাদা হারানোর তীব্র মনোবেদনা আর ক্ষোভ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া তখন ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। প্রতিকূল সেই সময়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন জাহানারা ইমাম। '৭১-এর শহীদ বীর গেরিলা যোদ্ধা রুমীর জননী তিনি। নিজের সন্তানের মতো করে দেখেছেন তরুণ প্রজন্মকে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে এক করেছিলেন তাদের। সঙ্গে পেয়েছিলেন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ মানুষদের; সংগ্রামে, মননে, চিন্তনে জাতিকে যাঁরা পথ দেখিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নারকীয় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই। চার বছর ধরে ন্যুরেমবার্গে সামরিক আদালতে ওই বিচার চলেছিল। ওই বিচারে মূল অপরাধীদের মধ্যে যাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, ফাঁসিতে ঝুলিয়েই সেই রায় কার্যকর করা হয়েছিল। অধিকৃত ইউরোপে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর স্থাপিত বন্দি নিপীড়ন কেন্দ্রগুলোতে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যার দায়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি অপরাধী দণ্ডিত হয়েছিল, যাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল পাঁচ শতাধিক।
দণ্ডিত অপরাধীদের মধ্যে ছিলেন ওই সব বন্দি শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরাও। তাঁদের কোনো দায় নেই, যুদ্ধকালে কেবল তাঁরা হুকুম তামিল করেছিলেন। যুক্তিতে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যার দায় থেকে তাঁরাও কেউ রেহাই পাননি। দণ্ডিত নারীদেরও ফাঁসি মওকুফ হয়নি। জার্মানির হ্যানোভারের একটি কারাগারেই ২০০ ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর মধ্যে ১০ জন ছিলেন নারী। সময় বাঁচানোর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মঞ্চে একসঙ্গে দুজন করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ন্যুরেমবার্গে ফাঁসির রায় কার্যকরের কিছু দৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে তখন প্রচারও করা হয়েছিল।
তখন বিচার হয়েছিল সামরিক আদালতে। বিজয়ী শক্তি, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্সের সামরিক কর্মকর্তারা সে বিচার করেছিলেন, রায় কার্যকর করেছিলেন। '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশে প্রাণহানি ঘটেছিল ৩০ লাখ মানুষের, সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন দুই লাখ নারী। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলো, বিশেষ আইনের আওতায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে উদ্বেগ প্রকাশও শুরু হলো এর স্বচ্ছতা নিয়ে, মৃত্যুদণ্ড নিয়ে।
তবু বিচার চলছিল। ২১ জানুয়ারি যখন প্রথম রায় হলো, মানুষ দেখল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এ দেশেও হয়। কিন্তু দ্বিতীয় রায়েই ঘোর কেটে গেল তাদের। ৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণার পরই দেশজুড়ে শোকের ছায়া। নিমেষেই যেন নিভে গেল সব আশা। মনে হলো, সবই যেন সাজানো, মিথ্যা। স্বজন, সম্ভ্রম, মর্যাদা হারানো মানুষ বোধ হয় কোনো দিনও আর সুবিচার পাবে না।
রাস্তায় তখনো যুদ্ধাপরাধীদের উন্মত্ত মিছিল। আইনের কুটিল ব্যাখ্যায় নিমগ্ন দেশের বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ। রাজনীতির মারপ্যাঁচে বিভোর রাজনৈতিক দলের নেতারা। কোনো উপসংহার নেই। হতবিহ্বল জাতির সামনে আশার ক্ষীণ আলো হয়ে শত শত মোমবাতি জ্বলে উঠল। শুরু করেছিলেন কয়েকজন তরুণ ব্লগার, যাঁদের বিশাল জগৎজোড়া শক্তি সম্পর্কে ধারণাই ছিল না এ দেশের রাজনীতিবিদদের, সুশীল সমাজের, সাধারণ মানুষের। শাহবাগের সেই আগুন এখন সারা দেশময় ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্মের একদল তরুণই আবার পথের দিশা দিল পুরো জাতিকে। এ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর, তাদের লক্ষ্য স্থির, দাবি পরিষ্কার : যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। অন্যকিছু নয়, অন্য কোনো কথা নয়। তারা স্থায়ী আসন গেড়েছে শাহবাগে। পুরো জাতির মনোযোগ টেনে এনেছে একটি মাত্র বিষয়ে : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। তাদের এ দাবি এখন অনুরণিত হচ্ছে দেশজুড়ে। অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত এ মৌলিক দাবির সঙ্গে একাত্ম না হয়ে উপায় নেই দেশের রাজনীতিকদের, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের। জাতির নয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই পিছিয়ে থাকার উপায় নেই কারো। তাই সারা দিন, সারা রাত ধরে শাহবাগ অভিমুখে যাচ্ছে সব বয়সী মানুষের মিছিল।
শহীদ জননীর আন্দোলন :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল জার্মানির নাজি পার্টি। তবে বাংলাদেশে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল জামায়াতে ইসলামীর ওপর। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পরও এ দলটি বিকশিত হয়েছে পলে পলে। পরাজয়ের পরপরই পালিয়ে যেতে হয়েছিল তাদের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার তাদের বিচারের প্রক্রিয়াও শুরু করেছিল। তৈরি হয়েছিল দালাল আইন। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগের দায়ে অভিযুক্তদের জেলেও ঢোকানো হয়েছিল। কিন্তু '৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সব থেমে যায়। স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৭ সালে সনামে আবির্ভূত হয় দলটি। একে একে ফিরে আসেন দলটির নেতারা, স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁদের অবস্থান ছিল স্বদেশবাসীর বিরুদ্ধে, শত্রুদের পক্ষে। রাষ্ট্রের ছত্রচ্ছায়ায় তাঁদের দৌরাত্ম্যে সন্ত্রস্ত জাতি। এভাবে পার হয়ে যায় প্রায় দেড় যুগ। অন্যতম যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম হয়ে যান বাংলাদেশের নাগরিক, নেতৃত্ব নেন জামায়াতে ইসলামীর।
স্বৈরাচারের আমলের অবসান হয়ে দেশে তখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায়। এ সময় অনেকটা নিভৃতবাস ছেড়ে এগিয়ে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সঙ্গে যোগ দেয় ৭০টি ছাত্র, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ওই বছরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসানো হয় গণ-আদালত। পুলিশের বাধা ভেঙে জমায়েত হওয়া কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ওই গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালত ১০টি অপরাধে তাঁকে 'মৃত্যুদণ্ড' দেন। গণ-আদালতের সেই 'রায়' কার্যকর করার দাবি নিয়ে তিনি নিজেই স্মারকলিপি নিয়ে সংসদে যান তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার কাছে। ১০০ সংসদ সদস্য জনতার এ রায় সমর্থন করেন। সংসদে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তবে থেমে যাননি জাহানারা ইমাম। পরের বছরের ২৬ মার্চ গঠন করেন গণতদন্ত কমিশন। ঘোষিত হয় আরো আট যুদ্ধাপরাধীর নাম। তাঁরা হলেন : আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ ও আবদুল কাদের মোল্লা।
১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনের সড়কে বিশাল সমাবেশে কমিশনের চেয়ারপারসন সুফিয়া কামাল তাঁর প্রতিবেদন পেশ করেন।
সুফিয়া কামাল ছাড়াও গণ-আদালত ও গণতদন্ত কমিশনে ছিলেন অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, ড. আহমদ শরীফ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লে. ক. (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, লে. ক. আবু ওসমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার শওকত আলী খান, কে এম সোবহান, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, আবদুল খালেক ও সদরুদ্দিনের মতো বরেণ্য মানুষ। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল রাষ্ট্রদোহের মামলা। তাঁদের বেশির ভাগই আজ আর বেঁচে নেই। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন জাহানারা ইমামও প্রয়াত হন। তবে দেশব্যাপী আন্দোলনে তাঁর সঙ্গে যেসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছিলেন, তাঁরা এখনো সক্রিয় আছেন। অসমাপ্ত যুদ্ধের শেষ পর্বে যোগ দিতে তাঁরাও এখন শাহবাগের ঠিকানায়।
শাহবাগ স্কয়ারে নতুন ভোর : ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের সাইটের মাধ্যমে মিসরসহ আরব বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে মিসরের সরকার পরিবর্তন ছিল অন্যতম। মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারকে ঘিরে এ আন্দোলন শুরু হয়।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারী বাড়লেও বড় ধরনের কোনো গণ-আন্দোলনের যাত্রা এখান থেকে শুরু হয়নি। গত সোমবার রাজধানী ঢাকার শাহবাগ অঞ্চলে সামাজিক যোগাযোগের সাইট থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন নতুন করে বিশ্ব গণমাধ্যমকে ভাবতে বাধ্য করেছে 'ঢাকার বসন্ত'-এর ব্যাপারে।
সাড়ে তিন শ খুন ও ধর্ষণের অপরাধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণার পর ঢাকার চিরচেনা শাহবাগ হয়ে ওঠে আন্দোলন, প্রতিবাদ, সংগ্রামের প্রতীক। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রায় প্রদানের দিন বিকেল থেকেই রাজধানীর শাহবাগ অঞ্চলে অবস্থান নেন। এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা সংগঠন 'ব্লগার অ্যাক্টিভিস্ট অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক' হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বস্তরের জনগণ এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। আরব বসন্তের নামের আদলে আন্দোলনকর্মীরা বলছেন 'শাহবাগ স্কয়ার'। আন্দোলনকারীদের দাবি, কাদের মোল্লাসহ সব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিতে হবে। বিচার ও রায় দ্রুত শেষ করতে হবে। গত সোমবার থেকে টানা অবস্থান করে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের রায় এবং রায় বাস্তবায়নে সরকারের ওপর তীব্র চাপ প্রয়োগ করছে তারা।
সব রাজনৈতিক মত ও পথের মানুষ এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। প্রথম দিন শতাধিক মানুষ নিয়ে বিকেল ৩টায় এ আন্দোলনের যাত্রা শুরু হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার এ আন্দোলনে কয়েক লাখ মানুষ যোগ দিয়েছে। দিনরাত অবস্থান করছে আন্দোলনকারীরা। অবস্থানের মধ্যে তারা প্রতিবাদী গান, বক্তৃতা, সিনেমা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রেখেছে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আন্দোলন শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই নয়, ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাঙালিদের মধ্যে। যারা দেশের বিভিন্ন স্থান ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে আন্দোলনে শরিক হতে পারেনি, তারা সংহতি জানাচ্ছে তাদের ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগে।
তরুণ প্রজন্ম জেগে আছে : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার অঙ্গীকার থাকায় তরুণ প্রজন্মের ভোট দলটির বাক্সে গিয়ে পড়ে। কিন্তু গত সোমবার কসাই কাদেরের যাবজ্জীবনের রায় দেওয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ শুরু করেছেন তাঁরা।
শাহবাগ স্কয়ারে যারা সমবেত হয়েছে সেই তরুণ-তরুণীরা আওয়ামী লীগকে সন্দেহ করছে। তারা বলছে, গোপনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের কোনো আঁতাত হতে পারে। এ বিষয়ে তারা সতর্ক।
জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের গোপন আঁতাত রয়েছে কি না, সে বিষয়ে আন্দোলনকারীরা এরই মধ্যে ব্যাপক প্রচার শুরু করেছে। 'বীর জনগণ' নামের একটি লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে শাহবাগ স্কয়ারের সমবেত জনতার মধ্যে। এ লিফলেটে তিনটি দাবি রয়েছে : কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, যুদ্ধাপরাধের সব রায় দ্রুত ঘোষণা কর ও সকল আঁতাত বন্ধ কর।
আন্দোলনকারীরা বলছে, 'এ ধরনের প্রচারপত্রের মাধ্যমে আমরা একটি বিষয়ে সতর্ক করতে চাই, যেকোনো ধরনের আঁতাত যদি আওয়ামী লীগ করে তাহলে পরিণতি হবে ভয়ংকর।'
অনেকটা রিলে রেসের মতো দায়িত্ব চলে আসে এক যুগ থেকে আরেক যুগে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। ২১ বছর আগে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, এবার পরের প্রজন্মের হাতে সেই যুদ্ধেরই চূড়ান্ত পর্বের সূচনা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে মঞ্চ সরে এলো শাহবাগে। দাবি একটাই, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। এবারের কাণ্ডারি তরুণরা। জন্ম ও অস্তিত্বের প্রশ্নে বিভ্রান্ত, বিভক্ত, পথহারা, নির্বিকার একটি জাতির দায়িত্ব নিয়ে নিল তরুণ একটি প্রজন্ম, ইন্টারনেটের অচেনা জগতের বাসিন্দা হিসেবে যাদের পরিপূর্ণতা অর্জন এত দিন ছিল সবার অলক্ষ্যে।
প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল স্বজন, সম্ভ্রম, মর্যাদা হারানোর তীব্র মনোবেদনা আর ক্ষোভ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া তখন ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। প্রতিকূল সেই সময়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন জাহানারা ইমাম। '৭১-এর শহীদ বীর গেরিলা যোদ্ধা রুমীর জননী তিনি। নিজের সন্তানের মতো করে দেখেছেন তরুণ প্রজন্মকে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে এক করেছিলেন তাদের। সঙ্গে পেয়েছিলেন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ মানুষদের; সংগ্রামে, মননে, চিন্তনে জাতিকে যাঁরা পথ দেখিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নারকীয় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই। চার বছর ধরে ন্যুরেমবার্গে সামরিক আদালতে ওই বিচার চলেছিল। ওই বিচারে মূল অপরাধীদের মধ্যে যাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, ফাঁসিতে ঝুলিয়েই সেই রায় কার্যকর করা হয়েছিল। অধিকৃত ইউরোপে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর স্থাপিত বন্দি নিপীড়ন কেন্দ্রগুলোতে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যার দায়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি অপরাধী দণ্ডিত হয়েছিল, যাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল পাঁচ শতাধিক।
দণ্ডিত অপরাধীদের মধ্যে ছিলেন ওই সব বন্দি শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরাও। তাঁদের কোনো দায় নেই, যুদ্ধকালে কেবল তাঁরা হুকুম তামিল করেছিলেন। যুক্তিতে নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যার দায় থেকে তাঁরাও কেউ রেহাই পাননি। দণ্ডিত নারীদেরও ফাঁসি মওকুফ হয়নি। জার্মানির হ্যানোভারের একটি কারাগারেই ২০০ ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর মধ্যে ১০ জন ছিলেন নারী। সময় বাঁচানোর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মঞ্চে একসঙ্গে দুজন করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ন্যুরেমবার্গে ফাঁসির রায় কার্যকরের কিছু দৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে তখন প্রচারও করা হয়েছিল।
তখন বিচার হয়েছিল সামরিক আদালতে। বিজয়ী শক্তি, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্সের সামরিক কর্মকর্তারা সে বিচার করেছিলেন, রায় কার্যকর করেছিলেন। '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশে প্রাণহানি ঘটেছিল ৩০ লাখ মানুষের, সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন দুই লাখ নারী। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলো, বিশেষ আইনের আওতায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে উদ্বেগ প্রকাশও শুরু হলো এর স্বচ্ছতা নিয়ে, মৃত্যুদণ্ড নিয়ে।
তবু বিচার চলছিল। ২১ জানুয়ারি যখন প্রথম রায় হলো, মানুষ দেখল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এ দেশেও হয়। কিন্তু দ্বিতীয় রায়েই ঘোর কেটে গেল তাদের। ৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণার পরই দেশজুড়ে শোকের ছায়া। নিমেষেই যেন নিভে গেল সব আশা। মনে হলো, সবই যেন সাজানো, মিথ্যা। স্বজন, সম্ভ্রম, মর্যাদা হারানো মানুষ বোধ হয় কোনো দিনও আর সুবিচার পাবে না।
রাস্তায় তখনো যুদ্ধাপরাধীদের উন্মত্ত মিছিল। আইনের কুটিল ব্যাখ্যায় নিমগ্ন দেশের বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ। রাজনীতির মারপ্যাঁচে বিভোর রাজনৈতিক দলের নেতারা। কোনো উপসংহার নেই। হতবিহ্বল জাতির সামনে আশার ক্ষীণ আলো হয়ে শত শত মোমবাতি জ্বলে উঠল। শুরু করেছিলেন কয়েকজন তরুণ ব্লগার, যাঁদের বিশাল জগৎজোড়া শক্তি সম্পর্কে ধারণাই ছিল না এ দেশের রাজনীতিবিদদের, সুশীল সমাজের, সাধারণ মানুষের। শাহবাগের সেই আগুন এখন সারা দেশময় ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্মের একদল তরুণই আবার পথের দিশা দিল পুরো জাতিকে। এ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর, তাদের লক্ষ্য স্থির, দাবি পরিষ্কার : যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। অন্যকিছু নয়, অন্য কোনো কথা নয়। তারা স্থায়ী আসন গেড়েছে শাহবাগে। পুরো জাতির মনোযোগ টেনে এনেছে একটি মাত্র বিষয়ে : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। তাদের এ দাবি এখন অনুরণিত হচ্ছে দেশজুড়ে। অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত এ মৌলিক দাবির সঙ্গে একাত্ম না হয়ে উপায় নেই দেশের রাজনীতিকদের, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের। জাতির নয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই পিছিয়ে থাকার উপায় নেই কারো। তাই সারা দিন, সারা রাত ধরে শাহবাগ অভিমুখে যাচ্ছে সব বয়সী মানুষের মিছিল।
শহীদ জননীর আন্দোলন :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল জার্মানির নাজি পার্টি। তবে বাংলাদেশে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল জামায়াতে ইসলামীর ওপর। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পরও এ দলটি বিকশিত হয়েছে পলে পলে। পরাজয়ের পরপরই পালিয়ে যেতে হয়েছিল তাদের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার তাদের বিচারের প্রক্রিয়াও শুরু করেছিল। তৈরি হয়েছিল দালাল আইন। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগের দায়ে অভিযুক্তদের জেলেও ঢোকানো হয়েছিল। কিন্তু '৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সব থেমে যায়। স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৭ সালে সনামে আবির্ভূত হয় দলটি। একে একে ফিরে আসেন দলটির নেতারা, স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁদের অবস্থান ছিল স্বদেশবাসীর বিরুদ্ধে, শত্রুদের পক্ষে। রাষ্ট্রের ছত্রচ্ছায়ায় তাঁদের দৌরাত্ম্যে সন্ত্রস্ত জাতি। এভাবে পার হয়ে যায় প্রায় দেড় যুগ। অন্যতম যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম হয়ে যান বাংলাদেশের নাগরিক, নেতৃত্ব নেন জামায়াতে ইসলামীর।
স্বৈরাচারের আমলের অবসান হয়ে দেশে তখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায়। এ সময় অনেকটা নিভৃতবাস ছেড়ে এগিয়ে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সঙ্গে যোগ দেয় ৭০টি ছাত্র, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ওই বছরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসানো হয় গণ-আদালত। পুলিশের বাধা ভেঙে জমায়েত হওয়া কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ওই গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালত ১০টি অপরাধে তাঁকে 'মৃত্যুদণ্ড' দেন। গণ-আদালতের সেই 'রায়' কার্যকর করার দাবি নিয়ে তিনি নিজেই স্মারকলিপি নিয়ে সংসদে যান তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার কাছে। ১০০ সংসদ সদস্য জনতার এ রায় সমর্থন করেন। সংসদে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তবে থেমে যাননি জাহানারা ইমাম। পরের বছরের ২৬ মার্চ গঠন করেন গণতদন্ত কমিশন। ঘোষিত হয় আরো আট যুদ্ধাপরাধীর নাম। তাঁরা হলেন : আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ ও আবদুল কাদের মোল্লা।
১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনের সড়কে বিশাল সমাবেশে কমিশনের চেয়ারপারসন সুফিয়া কামাল তাঁর প্রতিবেদন পেশ করেন।
সুফিয়া কামাল ছাড়াও গণ-আদালত ও গণতদন্ত কমিশনে ছিলেন অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, ড. আহমদ শরীফ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লে. ক. (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, লে. ক. আবু ওসমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার শওকত আলী খান, কে এম সোবহান, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, আবদুল খালেক ও সদরুদ্দিনের মতো বরেণ্য মানুষ। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল রাষ্ট্রদোহের মামলা। তাঁদের বেশির ভাগই আজ আর বেঁচে নেই। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন জাহানারা ইমামও প্রয়াত হন। তবে দেশব্যাপী আন্দোলনে তাঁর সঙ্গে যেসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছিলেন, তাঁরা এখনো সক্রিয় আছেন। অসমাপ্ত যুদ্ধের শেষ পর্বে যোগ দিতে তাঁরাও এখন শাহবাগের ঠিকানায়।
শাহবাগ স্কয়ারে নতুন ভোর : ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের সাইটের মাধ্যমে মিসরসহ আরব বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে মিসরের সরকার পরিবর্তন ছিল অন্যতম। মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারকে ঘিরে এ আন্দোলন শুরু হয়।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারী বাড়লেও বড় ধরনের কোনো গণ-আন্দোলনের যাত্রা এখান থেকে শুরু হয়নি। গত সোমবার রাজধানী ঢাকার শাহবাগ অঞ্চলে সামাজিক যোগাযোগের সাইট থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন নতুন করে বিশ্ব গণমাধ্যমকে ভাবতে বাধ্য করেছে 'ঢাকার বসন্ত'-এর ব্যাপারে।
সাড়ে তিন শ খুন ও ধর্ষণের অপরাধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কসাই কাদের ওরফে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণার পর ঢাকার চিরচেনা শাহবাগ হয়ে ওঠে আন্দোলন, প্রতিবাদ, সংগ্রামের প্রতীক। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রায় প্রদানের দিন বিকেল থেকেই রাজধানীর শাহবাগ অঞ্চলে অবস্থান নেন। এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা সংগঠন 'ব্লগার অ্যাক্টিভিস্ট অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক' হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বস্তরের জনগণ এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। আরব বসন্তের নামের আদলে আন্দোলনকর্মীরা বলছেন 'শাহবাগ স্কয়ার'। আন্দোলনকারীদের দাবি, কাদের মোল্লাসহ সব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিতে হবে। বিচার ও রায় দ্রুত শেষ করতে হবে। গত সোমবার থেকে টানা অবস্থান করে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের রায় এবং রায় বাস্তবায়নে সরকারের ওপর তীব্র চাপ প্রয়োগ করছে তারা।
সব রাজনৈতিক মত ও পথের মানুষ এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। প্রথম দিন শতাধিক মানুষ নিয়ে বিকেল ৩টায় এ আন্দোলনের যাত্রা শুরু হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার এ আন্দোলনে কয়েক লাখ মানুষ যোগ দিয়েছে। দিনরাত অবস্থান করছে আন্দোলনকারীরা। অবস্থানের মধ্যে তারা প্রতিবাদী গান, বক্তৃতা, সিনেমা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রেখেছে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আন্দোলন শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই নয়, ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাঙালিদের মধ্যে। যারা দেশের বিভিন্ন স্থান ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে আন্দোলনে শরিক হতে পারেনি, তারা সংহতি জানাচ্ছে তাদের ফেসবুক, টুইটার ও ব্লগে।
তরুণ প্রজন্ম জেগে আছে : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার অঙ্গীকার থাকায় তরুণ প্রজন্মের ভোট দলটির বাক্সে গিয়ে পড়ে। কিন্তু গত সোমবার কসাই কাদেরের যাবজ্জীবনের রায় দেওয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ শুরু করেছেন তাঁরা।
শাহবাগ স্কয়ারে যারা সমবেত হয়েছে সেই তরুণ-তরুণীরা আওয়ামী লীগকে সন্দেহ করছে। তারা বলছে, গোপনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের কোনো আঁতাত হতে পারে। এ বিষয়ে তারা সতর্ক।
জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের গোপন আঁতাত রয়েছে কি না, সে বিষয়ে আন্দোলনকারীরা এরই মধ্যে ব্যাপক প্রচার শুরু করেছে। 'বীর জনগণ' নামের একটি লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে শাহবাগ স্কয়ারের সমবেত জনতার মধ্যে। এ লিফলেটে তিনটি দাবি রয়েছে : কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, যুদ্ধাপরাধের সব রায় দ্রুত ঘোষণা কর ও সকল আঁতাত বন্ধ কর।
আন্দোলনকারীরা বলছে, 'এ ধরনের প্রচারপত্রের মাধ্যমে আমরা একটি বিষয়ে সতর্ক করতে চাই, যেকোনো ধরনের আঁতাত যদি আওয়ামী লীগ করে তাহলে পরিণতি হবে ভয়ংকর।'
No comments